সরকারের দেওয়া বিশেষ সুবিধা উঠিয়ে নেওয়ায় কালোটাকার মালিকরা সাদা করার আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বাজেটে করহার বৃদ্ধি ও জরিমানা আরোপ করায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ গ্রহণে ভাটা পড়েছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১২ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ২০ হাজার কোটি কালোটাকা সাদা করেন। এর মধ্যে নগদ সাদা করেন প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।
অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) মাত্র ৬৯২ জন কালো টাকার মালিক টাকা সাদা করেছেন। নগদ টাকার পাশাপাশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ও জমি-ফ্ল্যাট কিনে তারা কালো টাকা সাদা করেন। এর বিপরীতে সরকার গত পাঁচ মাসে মাত্র ২৬ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি করহার বৃদ্ধি ও জরিমানা আরোপ করায় এবার কালোটাকার মালিকরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তবে আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪তে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ রয়েছে। সেটা হচ্ছে প্রচলিত কর পরিশোধ করে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে করদাতারা তাদের অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ পাবেন। ফলে ব্যবসায়ীদের তেমন আগ্রহ নেই।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) মাত্র ৬৯২ জন কালোটাকার মালিক নগদ টাকার পাশাপাশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ও জমি-ফ্ল্যাট কিনে টাকা সাদা করেছেন। গত পাঁচ মাসে জমি ও ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ দেখিয়ে সবচেয়ে বেশি কালোটাকা সাদা করা হয়েছে।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে এনবিআর ‘বিশেষ’ সুবিধা দিয়েছিল। যেখানে একজন করদাতাকে বিনা প্রশ্নে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। চলতি অর্থবছরে অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবীদের চাপের মুখে এনবিআর আইনটি পরিবর্তন করে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ২৫ শতাংশ করের পাশাপাশি ৫ শতাংশ জরিমানা আরোপ করা হয়। অর্থাৎ শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ করতে চাইলে ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কর পরিশোধ করতে হবে। এত বিশাল কর ব্যবধান বিনিয়োগে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছর লুকানো নগদ অর্থ, সব ধরনের ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র রিটার্নে প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও কর বাড়িয়েছে এনবিআর। যেমন গতবার লুকানো অর্থ রিটার্নে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর দিলেই চলত। এবার সেটি বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। অবশ্য চলতি অর্থবছরে উৎপাদনশীল খাতে কালোটাকা বিনিয়োগের বিশেষ সুবিধা (১৯এএএএএএ) দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের যে কোনো জায়গায় ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকায় শিল্পকারখানা করা যাবে। এ পদ্ধতিতে টাকা সাদা বা বিনিয়োগ করলে দুদক বা অন্য কোনো সংস্থা প্রশ্ন করবে না। যদিও ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকেই ১০ শতাংশ কর দিয়ে (১৯ডিডি) শিল্পে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। তবে সেটি শুধু হাইটেক পার্ক বা অর্থনৈতিক অঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ সুবিধার ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত থাকবে।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) মাত্র ৬৯২ জন কালোটাকার মালিক নগদ টাকার পাশাপাশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ও জমি-ফ্ল্যাট কিনে টাকা সাদা করেছেন। গত পাঁচ মাসে জমি ও ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ দেখিয়ে সবচেয়ে বেশি কালোটাকা সাদা করা হয়। গত অর্থবছরের একই সময়ে সব মিলিয়ে ৭ হাজার ৫৫ জন করদাতা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছিলেন। নগদ টাকা, ব্যাংকে রাখা টাকা, সঞ্চয়পত্র, শেয়ারবাজার, জমি-ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, কালোটাকা সাদা করা বাবদ গত পাঁচ মাসে মাত্র ২৬ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়া গেছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঢালাওভাবে সুযোগ দেওয়ার পরও এই চিত্রটি আশাব্যঞ্জক নয়। কালোটাকার মালিকরা বিদেশে পাচার করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সরকারের উচিত হবে এ সুযোগ না দিয়ে বরং চাঁদাবাজি, ঘুষের মতো কালোটাকার উৎসগুলো বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
কালোটাকায় ফ্ল্যাট-জমি কিনেছেন সাড়ে পাঁচশ করদাতা। গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫৫৮ জন করদাতা ফ্ল্যাট ও জমিতে বিনিয়োগ দেখিয়ে কালোটাকা সাদা করেছেন। গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রায় পাঁচ হাজার করদাতা জমি-ফ্ল্যাটে কালোটাকা বিনিয়োগের কথা জানিয়েছিলেন। এলাকাভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলেই ফ্ল্যাট ও জমি কেনার টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করবে না এনবিআর। চলতি অর্থবছরের উল্লিখিত ৫ মাসে ৪৬০ জন করদাতা এনবিআরকে জানিয়েছেন, তারা কালোটাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। ৯৮ জন করদাতা জানিয়েছেন, তারা জমিতে কালোটাকা বিনিয়োগ করেছেন।
এনবিআর সূত্রে আরও জানা গেছে, গত জুলাই থেকে নভেম্বর সময়কালে ১২৩ জন করদাতা নগদ টাকা কিংবা সঞ্চয়পত্র, এফডিআরে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা করেছেন। গত অর্থবছরের একই সময়ে সব মিলিয়ে ১ হাজার ৬৮৩ জন নগদ টাকা, সঞ্চয়পত্র ও এফডিআরে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা করেছিলেন।
শেয়ারবাজারে গেছেন মাত্র ১৩ জন : গত জুলাই-নভেম্বরে মাত্র ১৩ জন বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ করেছেন। তারা সব মিলিয়ে ৫০ লাখ টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। গত অর্থবছরের একই সময়ে ২৮৬ জন করদাতা শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। বর্তমানে শেয়ারবাজারে ২০ লাখের বেশি সক্রিয় বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব আছে। সেই বিবেচনায় কালোটাকা বিনিয়োগ করেছেন, এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, বিনিয়োগ কমে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। নিয়মিত আয়করের অতিরিক্ত জরিমানা দিয়ে কেউ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে আসবে না। গতবার বিশেষ সুযোগ দেওয়ায় বিনিয়োগ বেড়েছিল। এবার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় কালোটাকার অপব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হবে।
সব সরকারের আমলেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল ছাড়া আর কোনো সরকারের সময় কালোটাকা সাদা করায় খুব বেশি সাড়া পাওয়া যায়নি। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছিল। এরপর গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৮৮৯ করদাতা কালোটাকা সাদা করেছিলেন। তাতে ওই বছর ২০ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর থেকে নানাভাবেই কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। মূলত কালোটাকাকে অর্থনীতির মূলধারায় আনতে এ সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৭১-৭৫ সাল পর্যন্ত ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা সাদা করা হয়। সে সময়ে সরকার এ থেকে মাত্র ১৯ লাখ টাকা আয়কর পায়। পরবর্তীকালে এ সুবিধা বহাল থাকায় প্রতিবছরই কালোটাকা সাদা করার পরিমাণ বাড়তে থাকে।
’৭৬-৮০ সাল পর্যন্ত ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা করা হয়, সরকার আয়কর পায় ৮১ লাখ টাকা। ’৮১-৯০ পর্যন্ত ৪৫ কোটি টাকা সাদা হয়, সরকার আয়কর পায় ৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ’৯১-৯৬ পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা সাদা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৫ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছিলেন। এতে বৈধ হয় ৩ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা এবং সরকার রাজস্ব পায় ৬৮৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।