সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৪ পূর্বাহ্ন

দেশকে ভালোবেসে দুর্নীতিকে ‘না’ বলি

এম জসীম উদ্দিন
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
  • ১৫২ বার

দুর্নীতি এমন একটি কার্য, যেখানে অনৈতিক অর্থ প্রদানের কারণে তৃতীয় কোনো পক্ষ সুবিধা পায়, যার ফলে তারা বিশেষ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করে, এতে করে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত পক্ষটি এবং তৃতীয় পক্ষ উভয়ই লাভবান হয় এবং এই কার্যে দুর্নীতিগ্রস্ত পক্ষটি থাকে কর্তৃপক্ষ।

দুর্নীতি বিভিন্ন মানদণ্ডে ঘটতে পারে, আওতা বা বিস্তৃতি ছোট হলে এবং তাতে যদি অল্পসংখ্যক মানুষ জড়িত থাকে তবে তাকে ‘ক্ষুদ্রার্থে’ (petty corruption) আর যদি সরকার বড় আকারে প্রভাবিত হয়ে পড়ে তবে ‘ব্যাপকার্থে’ (Grand Corruption) দুর্নীতি হিসেবে নির্দেশিত হয়।

দুর্নীতি শব্দটি যখন বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন সাংস্কৃতিক অর্থে ‘সমূলে বিনষ্ট হওয়া’কে নির্দেশ করে। দুর্নীতি শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন অ্যারিস্টটল, এর পর সিসারো, যিনি ঘুষ এবং সৎ অভ্যাস ত্যাগ প্রত্যয়ের যোগ করেছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মরিস লিখেছেন, দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার।

স¤প্রতি বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) পরিচালিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে এবার বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে ১২তম অবস্থান থেকে ১৩তম অবস্থানে এসেছে। অবশ্য দুর্নীতির এই সূচকে বা স্কোরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো অগ্রগতি হয়নি। ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬, গতবারও একই ছিল। চার বছর ধরেই একই স্কোর রয়েছে। তবে বিপরীত দিক দিয়ে, অর্থাৎ সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০ দেশের মধ্য এক ধাপ পিছিয়ে হয়েছে ১৪৭তম। গতবার ছিল ১৪৬তম। টিআইর দুর্নীতির ধারণা সূচকে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ তালিকার এক নম্বরে ছিল। অর্থাৎ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়, ২০০৭ সালে সপ্তম, ২০০৮ সালে দশম, ২০০৯ সালে ১৩তম, ২০১০ সালে দ্বাদশ, ২০১১ সালে ১৩তম, ২০১২ সালে ১৩তম, ২০১৩ সালে ১৬তম, ২০১৪ সালে ১৪তম, ২০১৫ সালে ১৩তম, ২০১৬ সালে ১৫তম, ২০১৭ সালে ১৭তম এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম।

বাংলাদেশে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতির এই ধারণা সূচকের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাপিতা। কারণ ১০ বছর ধরে প্রবণতা হলো স্কোরটি এক জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা দেখানোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলেও সেটি ঠিকমতো কার্যকর হচ্ছে না। কারণ যাদের হাতে এই দায়িত্ব, তাদের একাংশই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী এবারও ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের বিবেচনায় শীর্ষে অবস্থান করছে। দক্ষিণ সুদান এবারও সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায়।

দুর্নীতি দমন কমিশনের দাবি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এই সূচক এবং ব্যাখ্যা সঠিক নয়। সংস্থাটির কমিশনার মোজাম্মেল হক খানের মতে, দুদকের কাজের প্রতি বাংলাদেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ আস্থা প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ এতটা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে সা¤প্রতিককালের উন্নয়ন কাজে এতটা সাফল্য পেত না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে জরিপ পরিচালনা করলে টিআইবির এমন প্রতিবেদন টিকবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন। মি. খান মনে করেন প্রত্যাশা বেশি হওয়ার কারণে তাদের প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসছে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশ দুর্নীতির ধারণা সূচকে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের স্মরণ আছে, সরকার গঠনের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণে আমি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শোধরানোর আহ্বান জানিয়েছিলাম। আমি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করি। মানুষের কল্যাণের জন্য আমি যে কোনো পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করব না।’

দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি আবারও সবাইকে সতর্ক করে দিতে চাই দুর্নীতিবাজ যেই হোক, যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতি আহ্বান থাকবে, যে-ই অবৈধ সম্পদ অর্জনের সঙ্গে জড়িত থাকুক, তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসুন। সাধারণ মানুষের হক যাতে কেউ কেড়ে নিতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।’

দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও কার্যকরভাবে সম্পন্ন করতে সরকার দুর্নীতি দমন কমিশনকে চাহিদা মোতাবেক পর্যাপ্ত আইনি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আসছে। কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কমিশনের সামগ্রিক কার্যক্রমকে পূর্ণাঙ্গভাবে করার পরিকল্পনা রয়েছে। কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তদন্ত ও মামলা পরিচালনাসংক্রান্ত কাজ সঠিকভাবে পরিবীক্ষণের জন্য ওয়েবভিত্তিক সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হবে। দুর্নীতি দমনে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ অব্যাহত রাখবে।

দুদকের সা¤প্রতিক কিছু কার্যক্রম মানুষের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি এই কাজে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উৎসাহ জুগিয়েছে। তবে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা না গেলে দুদকের একার পক্ষে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।

দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘একদিনে তো দুর্নীতির এই অবস্থা তৈরি হয়নি। এটা একদিনে যাবেও না। তবে দুদক যে কার্যক্রম চালাচ্ছে তাতে কিছু ইতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। তবে শুধু দুদকের একার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে সুশাসন ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি জরুরি।’

দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বল প্রয়োগে পিছপা না হওয়া, রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখা, রাজনৈতিক মানসিকতার পরিবর্তন, ব্যক্তিস্বার্থের পরিবর্তে জনস্বার্থরক্ষার মানসিকতা তৈরি, সর্বোপরি সদিচ্ছাই পারে আমাদের দেশ থেকে দুর্নীতিকে বিতাড়িত করতে। এর বাইরে কোনোভাবেই দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। তাই আসুন দেশকে ভালোবেসে দুর্নীতিকে না বলি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে সহায়তা করি।

 

এম জসীম উদ্দিন: সহকারী তথ্য কর্মকর্তা

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com