দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব কমছে। দেশগুলো ধীরে ধীরে ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে জনসংখ্যা ও এর আয়তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করার মতো অবস্থায় ছিল ভারত। এর আরো কারণ ছিল, স্বাধীনতার পর উত্তরাধিকারসূত্রে ব্রিটিশের কাছ থেকে প্রতিবেশীদের চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ পেয়েছে দেশটি। শিল্প ও যোগাযোগের যে অবকাঠামো ব্রিটিশরা গড়ে তুলেছিল এর বেশির ভাগই ভারতের অধিকারে যায়। ঠিক একই কারণে ভারতের প্রতিবেশীরা অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে দিল্লির চেয়ে অধিকতর দুর্বল ছিল। এ সুযোগে তখন থেকেই প্রতিবেশীদের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে আসছে ভারত।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ইসলামাবাদ ছাড়া অন্য প্রতিবেশীদের ওপর প্রভাব আরো বাড়ানোর চেষ্টা করে ভারত। রক্ষণশীল থেকে ১৯৯১ সালে ভারতীয় অর্থনীতি সংস্কারের ফলে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী হয়। কোভিড-১৯ শুরুর আগে ভারতের অর্থনীতি ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে রূপ নেয়। এ ছাড়া ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে ভারতীয় জিডিপি বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে চলে আসে। অর্থনৈতিক উন্নতিতে ভারত আরো বেশি মরিয়া হয়ে প্রতিবেশীদের ওপর নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা চালায়।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ভারতে ক্ষমতায় আসার পর প্রতিবেশীদের ওপর ভারতীয় ক্ষমতা সংহত করতে ‘প্রতিবেশী প্রথম’ (নেইবার ফার্স্ট) নীতি গ্রহণ করে। ভারতের প্রতিবেশী প্রথম নীতি গ্রহণ যতটা না প্রতিবেশীদের উপকারে এসেছে, তার চেয়ে নিজেকে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ক্ষমতাধর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা ছিল। একই উদ্দেশ্যে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা গ্রহণের দিন দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের প্রতিনিধিদের দাওয়াত দিয়েছিলেন। পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এসেছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। ক্ষমতা গ্রহণের কিছু দিন পর পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নরেন্দ্র মোদিকে ‘সম্মোহনী শক্তি বিশিষ্ট নেতা’ (ক্যারিশমেটিক লিডারশিপ) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চলছিল। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই নরেন্দ্র মোদি কিছুটা ‘চমকের কূটনীতিও’ দেখাতে চেষ্টা করেন। এরই অংশ হিসেবে প্রথমেই ভুটানে যান রাষ্ট্রীয় সফরে। ভূমিবেষ্টিত ভুটানকে ভারত প্রথম থেকেই প্রটেক্টরেট (আশ্রিত রাজ্য) হিসেবে দেখে থাকে। ভারতের এ আচরণে প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া না দেখালেও ভুটানিদের মধ্যে নীরব ক্ষোভের জন্ম নেয়। নরেন্দ্র মোদি এরপরের রাষ্ট্রীয় সফর যান নেপালে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদি দু’বার নেপাল সফলে যান। নেপাল-ভারত সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে উচ্চ শিখরে পৌঁছেছে বলে মনে করা হতো তখন। সম্পর্কটি ঐতিহাসিক বলেও প্রচার হতে থাকে। কিন্তু ভারত ও নেপালের মধ্যে মধুচন্দ্রিমার সমাপ্তি ঘটে।
২০১৫ সালে নেপালে সংবিধান সংশোধন নিয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় নেপালের মদেশিয়দের নিয়ে। মদেশিয়রা নেপালের একটি ছোট জাতি, যারা নেপালের দক্ষিণাঞ্চলে বাস করে। অভিন্ন জাতিগত মিল থাকায় ভারত মদেশিয়দের প্রতি তখন সমর্থন জানায়। ফলে নেপালের সাথে ভারতের সীমান্ত বাণিজ্য কিছু দিন বন্ধ থাকে। ভূমিবেষ্টিত বলে নেপালের সব ‘থার্ড পার্টি বাণিজ্য’ ভারতের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। অচলাবস্থার মধ্যে ৯ মাস বাণিজ্য বন্ধের পর নেপালের অর্থনীতি প্রায় ধসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ভারতের সাথে নেপালের দ্বিপক্ষীয় সব চুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়ার অবস্থায় এসে দাঁড়ালে, দিল্লিকে এ ব্যাপারে নেপাল ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৮ সালে আবার কাঠমান্ডু সফরে যান। তার সফরে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আংশিক জোড়া লাগে মাত্র। কিন্তু সার্বভৌমত্ব নিয়ে বিরোধের প্রশ্নে ফের পারস্পরিক সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। ঠিক এ সময়েই নেপালের সাথে চীনের সম্পর্ক দ্রুত উন্নতি লাভ করে।
ভুটানের সাথে ভারতের বিশেষ সম্পর্ক তখনো ছিল। এখনো ভুটানের অভ্যন্তরীণ শাসন ও কূটনীতিতে ভারত বিস্তর প্রভাব বিস্তার করে আছে। এ অবস্থায়ই চীন-ভুটানের সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়। অন্য দিকে ভারতের প্রভাবাধীন থাকার পরও শ্রীলঙ্কায় চীনারা কলম্বো পোর্ট সিটি ও হাম্বানটোটা বন্দর নির্মাণকাজ শুরু করে। তবে ভারতীয় চাপে শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা পোর্ট সিটি প্রকল্পের প্রথম দিককার চুক্তি থেকে সরে আসে। পরে ৯৯ বছরের লিজে সীমাবদ্ধ করে চীনের সাথে চুক্তিটি করে। শ্রীলঙ্কার সাথে চীনের এ দুই প্রকল্পের কাজই মসৃণভাবে এগিয়ে চলছে। শিগগিরই হাম্বানটোটা বন্দর চালু হবে। ঋণ নিয়ে ভারতের সাথে শ্রীলঙ্কার নতুন করে অস্বস্তিকর অবস্থা শুরু হয়েছে। করোনা মহামারীর সময়ে শ্রীলঙ্কা ভারতকে কিছু অনুরোধ করেছিল বাস্তবায়নে। এর মধ্যে ঋণ স্থগিত, দুই দেশের মুদ্রাবিনিময় বিষয়টি অন্যতম। এ অনুরোধ করা হয় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে। শ্রীলঙ্কার চেয়ে ভারতের বিশাল অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও কলম্বোর অনুরোধে গত পাঁচ মাসেও সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে দিল্লি। শ্রীলঙ্কার কাছে ভারতের ঋণ খুবই কম। শ্রীলঙ্কার ৫৫ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণের ২ শতাংশ মাত্র ভারতের কাছে রয়েছে। নগদ ডলার সঙ্কটে শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সহায়তা চায়। শ্রীলঙ্কাকে হতাশ করেনি ঢাকা যদিও শ্রীলঙ্কার নগদ ডলার সঙ্কট এখনো রয়ে গেছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কোনো কিছু থাকবে না, যদি শ্রীলঙ্কা তার এ সঙ্কটের উপশম চীনের কাছে চায়। তখন হয়তো শ্রীলঙ্কার আরো কাছে চলে আসতে পারে চীন।
২০১৬ সালে ভারত দক্ষিণ এশিয়া সহযোগিতা পরিষদের (সার্ক) পাকিস্তানের শীর্ষ সম্মেলনকে বাধাগ্রস্ত করে। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সার্ক দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবে পরিগণিত হলেও ২০১৬ সালে শীর্ষ সম্মেলন বানচাল হয়েছে। ভারতের দাদাগিরির কারণে পাকিস্তানের শীর্ষ সম্মেলনটি শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। সার্কের অন্য সব কার্যক্রম এখনো অব্যাহত থাকলেও শীর্ষ সম্মেলন না হওয়ায় সংগঠনটির প্রভাব চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। গত বছর করোনার শীর্ষ সংক্রমণের সময় চীনের আহ্বানে চীন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কিভাবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়; এ নিয়ে একটি ভিডিও কনফারেন্স করেন। ভারত সে ভিডিও কনফারেন্সের দাওয়াত পেলেও তাতে অংশ নেয়নি। এ ছাড়া ২০২১ সালের জুলাই মাসে চীনের চংকিং শহরে পূর্বে উল্লিখিত পাঁচ দেশ নিয়ে চীন দারিদ্র্য বিমোচন ও সহযোগিতার উদ্দেশ্যে সভায় মিলিত হয়। এতে আবারো প্রমাণিত হয়, এ অঞ্চলের দেশগুলোর কাছে ভারতের বড় ভাইসুলভ আচণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে। ভারতের এই ‘দাদাগিরির’ জন্যই নামসর্বস্ব সংগঠনে পরিণত হয়েছে সার্ক। নেতৃত্ব চলে যাচ্ছে বৃহৎ অর্থনীতি ও আধুনিক প্রযুক্তির দেশ চীনের কাছে।
অবশ্য কয়েক বছর থেকে নরেন্দ্র মোদির সরকার দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে বিকল্প পথ খুঁজছে। মোদি সরকার বে-অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টোরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) প্রতি নজর দিতে চেয়েছেন। সংগঠনটির সদস্যরাষ্ট্রগুলো হলোÑ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড। এ সংগঠনে মালদ্বীপ ও পাকিস্তানকে রাখা হয়নি যদিও ভুটান ও নেপাল বঙ্গোপসাগরীয় উপকূলের দেশ নয়। বিমসটেকের সদস্য হওয়ার পর ২০১৮ সালে নেপাল ভারতে অনুষ্ঠিত বিমসটেকের দ্বিতীয় সামরিক অনুশীলনে অংশ না নিয়ে ঠিক পরের দিন চীনের চেংডুতে অনুষ্ঠিত সাগরমাথা ফ্রেন্ডশিপ-২ সামরিক অনুশীলনে অংশ নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে তার অবস্থান।
সামরিক হেলিকপ্টার ও ভারতীয় সৈন্যদের দায়মুক্তি নিয়ে আন্দোলন করছেন মালদ্বীপবাসী। প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ জনসংখ্যার ছোট্ট দ্বীপদেশটিতে ভারতবিরোধী মনোভাব ক্রমেই চাঙ্গা হয়ে উঠছে। বাংলাদেশকে ওয়াদা দিয়েও তিস্তা চুক্তি করেনি ভারত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ভারতের সহায়তা চাইলে দিল্লি আশ্বাস দেয়া ছাড়া কার্যত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি; বরং জাতিসঙ্ঘে ভারত বাংলাদেশের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট না দিয়ে মিয়ানমারের হাতকেই শক্তিশালী করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সীমান্ত হত্যা হয়ে থাকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে। বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে ভারতের চোরাকারবারিদের ফেনসিডিল তৈরির বিপুলসংখ্যক কারখানা রয়েছে যেখান থেকে বাংলাদেশে ফেনসিডিল পাচারের অকাট্য তথ্য-প্রমাণ দিয়েছে ঢাকা। এ ছাড়া নানা পণ্য বাংলাদেশে চোরাচালান তো রয়েছেই যেগুলো ভারতীয় বিএসএফ সরাসরি সহায়তা করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের রফতানিতে প্রচুর শুল্ক ও অশুল্ক বাধা (ট্যারিফ ও নন ট্যারিফ বেরিয়ার) প্রদান করে বাংলাদেশের রফতানিকে বাধাগ্রস্ত করে এখানকার ব্যবসায়ীদের অসন্তুষ্ট করে রেখেছে। এসব কারণে বাংলাদেশের মানুষ ভারতীয় আধিপত্যের প্রতিবাদ করে থাকে সব সময়। মোদ্দা কথা, প্রতিবেশীদের প্রতি ভারত বন্ধু হিসেবে নয়, বিগব্রাদারসুলভ মনোভাব থাকায়, দক্ষিণ এশিয়ায় দিল্লির প্রভাব দিন দিন কমছে। ভারতের আধিপত্যবাদী মনোভাব কেউ পছন্দ করছে না। অন্য দিকে মিয়ানমার ছাড়া ভারতের প্রতিবেশীদের মধ্যে কারো সাথে দেশটির সম্পর্ক হৃদ্যতার নয়। অন্তত ভারতের শাসকগোষ্ঠীর আচরণে তাই প্রকাশ পেয়ে থাকে। এমনকি শুধু ক্ষমতাসীন নন, ভারতের রাজনীতিবিদদের কিছু অংশের মধ্যেও এ দাদাগিরির মনোভাব বিদ্যমান। মাঝে মধ্যে তারা প্রকাশও করে থাকেন নানা ইস্যুতে। রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ বলেই বলেছেন, ‘অমুক দেশকে দখল করে ফেলা হোক।’ এভাবে সুসম্পর্ক হয় না, বৈরিতা বাড়ে।
ভারত সব সময় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিজের পশ্চাৎভূমি হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু এসব দেশগু ভারতের মানসিকতা বা আচরণ মোটেও সহজভাবে নেয় না। ভারতের আচণের বিরুদ্ধে এসব দেশের কেউ প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করে না অথবা নীরব থাকলেও জনসাধারণের মধ্যে ভারতবিরোধী মানসিকতা গড়ে উঠছে। দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে আরো স্বাবলম্বী হতে পারলে ভারতীয় প্রভাব আরো বেশি কমবে।
লেখক : সাংবাদিক