মানবদেহে প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় নামে একটি অরগ্যান আছে, যা থেকে তৈরি হয় ইনসুলিন নামে হরমোন। এ হরমোনের কাজ হলো রক্তের গ্লুকোজকে শরীরের কোষে ঢুকতে সাহায্য করা। আমাদের খাবার হজমের পর বেশিরভাগ গ্লুুকোজ হিসেবে রক্তের মধ্য পৌঁছে যায়, যা ইনসুলিনের উপস্থিতিতে শরীরের বিভিন্ন কোষে গিয়ে আমাদের কাজ করার শক্তি জোগায়।
ইনসুলিন হরমোন যদি যথেষ্ট পরিমাণে তৈরি না হয় বা সঠিকভাবে কাজ না করতে পারে, তাহলে রক্তের গ্লুুকোজ কোষে ঢুকতে পারে না। ফলে রক্তের গ্লুুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। এতে কোষগুলো গ্লুুকোজের অভাবে কাজ করার শক্তি হারায়। অন্যদিকে রক্তের অতিরিক্ত গ্লুুকোজ প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে থাকে। এ কারণে ঘনঘন প্রস্রাব হয় ও শরীরের শক্তি কমে যায়। এ অবস্থার নাম ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ।
ডায়াবেটিস যত ধরন : ডায়াবেটিস দুই প্রকার। যথা- টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ-১ ডায়াবেটিস অল্প বয়সেও হতে পারে। এ অবস্থায় পানক্রিয়াসে একদমই ইনসুলিন তৈরি হয় না। রোগীকে ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। এ ধরনের ডায়াবেটিস ৫ শতাংশের মতো। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন হরমোন তৈরি করলেও তা যথেষ্ট নয়। এই ধরনের ডায়াবেটিস ৯৫ শতাংশ।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা : ব্যায়াম ও জীবনযাত্রা প্রণালীর পরিবর্তন, খাবারের অভ্যাস পরিবর্তন ও ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার উত্তম চিকিৎসা।
ব্যায়াম : ওষুধের চেয়ে অনেক বেশি উপকারী হলো ব্যায়াম করা। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিসের ওষুধ মেটফরমিনের চেয়ে ব্যায়াম রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে বেশি কার্যকর।
ব্যায়ামে উপকার : ডায়াবেটিসে ব্যায়ামের উপকারিতা হলো- ব্যায়ামে শক্তি খরচ হয়। ফলে শরীরের ওজন ও চর্বি কমে। ব্যায়ামের মাধ্যমে প্যানক্রিয়াসের বেটা সেল থেকে ইনসুলিন তৈরি বেড়ে যায়। ব্যায়াম ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। ফলে শরীরে অল্প যা ইনসুলিন তৈরি হয়, তাতেই রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে। বাড়তি ওষুধের প্রয়োজন কম পড়ে। শরীরের রক্তসঞ্চালন বাড়ে। ব্যায়ামে রক্তের ভালো কোলেস্টেরল বাড়ে ও খারাপ কোলেস্টেরল কমে। উচ্চ রক্তচাপ কমে। মন প্রফুল্ল থাকে। ঘুম ভালো হয়। হাড় ও হৃৎপি- শক্তিশালী হয়। জয়েন্টগুলো সচল থাকে। ব্যায়াম অস্টিওপোরসিস কমায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বয়সও কমিয়ে দেয়। নিয়মিত ব্যায়াম যৌনক্ষমতা অটুট রাখে। ব্যায়াম ডায়াবেটিস রোগ প্রতিরোধেও উপকারী।
ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ব্যায়াম : বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করতে পারেন। যেমন- এরোবিক ব্যায়াম, স্ট্রেংথেনিং ব্যায়াম, স্ট্রেচিং ব্যায়াম, ব্যালান্সিং ব্যায়াম ইত্যাদি।
সপ্তাহে যে কয়েক দিন ও যতক্ষণ করবেন : সপ্তাহের অধিকাংশ দিন (কমপক্ষে ৫ দিন) এবং দিনে ৩০ মিনিট এরোবিক ব্যায়াম সুফল বয়ে আনে। এক নাগাড়ে ৩০ মিনিট ব্যায়াম না করতে পারলে ১০ মিনিট করে দিনে ৩ বার ব্যায়াম করলেও হবে। প্রতিদিন ৩ বার খাওয়ার আগে ১০ মিনিট করে ব্যায়াম একটা সুবিধাজনক ব্যায়াম।
ব্যায়ামের নিয়মাবলী : ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা আছে কিনা, তার জন্য ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া ভালো। অল্প ব্যায়াম দিয়ে শুরু করবেন। ক্রমে বাড়াবেন। প্রতিদিন ৫ মিনিট করে বাড়িয়ে সপ্তাহে ১৫০ থেকে ২০০ মিনিট করে ব্যায়াম করা আপনার লক্ষ্য থাকবে। ব্যায়ামের শুরুতে কিছুক্ষণ অল্প-স্বল্প ব্যায়াম করে নেবেন। সঙ্গে কিছু স্ট্রেচিং ব্যায়াম এবং শেষ করার সময় হঠাৎ করে থেমে যাবেন না। ৫ মিনিট ধীরে ধীরে কমিয়ে ব্যায়াম করা শেষ করবেন। যত বেশি ব্যায়াম করবেন, তত বেশি শক্তিক্ষয় হবে। তত গ্লুুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে। এরোবিক ব্যায়ামের পাশাপাশি স্ট্রেংথেনিং ব্যায়াম করতে হবে সপ্তাহে ২/৩ দিন। এটা হতে পারে ওজন ওঠানো-নামানো বা স্প্রিং টানা।
যখন ব্যায়াম করবেন না : এটা নির্ভর করবে দৈনন্দিন কাজ, খাওয়ার সময়, ডায়াবেটিসের জন্য কখন কি ওষুধ খাচ্ছেন, রক্তে গ্লুুকোজের মাত্রা ইত্যাদির ওপর।
আরও করণীয় : কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। বাসার কাজ নিজে করবেন। ঘর নিজেই পরিষ্কার করবেন। সময় থাকলে বাগান বা সবজি চাষ করবেন। হাট-বাজার নিজেই করবেন। লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি দিয়ে উঠবেন। অল্প দূরত্বে যানবাহন ব্যবহার না করে হাঁটবেন। অল্প দূরের কাজ টেলিফোনে না সেরে নিজে যাবেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে, যেমনÑ অফিস টিফিনের সময় গল্প গুজবে, খাওয়াতে ব্যয় না করে একটু ঘুরে বেড়াবেন। বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করবেন। শেষ কথা হলোÑ ব্যায়ামে লেগে থাকলে সুফল নিশ্চিত। নিয়মিত ব্যায়াম করুন, ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
লেখক : চেয়ারম্যান ও চিফ কনসালট্যান্ট
ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল