সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৮ পূর্বাহ্ন

কেমন হতে পারে ভবিষ্যৎ ভ্যারিয়েন্ট

ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
  • ১৪৮ বার

কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিক যুদ্ধে তৃতীয় বছরে পদার্পণ করলাম। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের ওহানে আবিষ্কৃত করোনাভাইরাসের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা ও ওমিক্রন- এই মোট পাঁচটি ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্নের অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করেছি। এ ছাড়াও উল্লেখ করার মতো আরো আটটি এমন ভ্যারিয়েন্ট পেয়েছি যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট, ভ্যারিয়েন্ট আন্ডার ইনভেস্টিগেশন ও ভ্যারিয়েন্ট ইন মনিটরিং ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়েছে।

আমাদের সৌভাগ্য যে, এখন পর্যন্ত আমরা ভ্যারিয়েন্ট অব হাই-কনসিকুইন্সেস নামে কোনো ভ্যারিয়েন্ট পাইনি যাতে অনেক বেশি প্রাণহানি হতে পারত। মহামারী এখনো চলমান। আরো কতদিন তা থাকবে এবং কত নতুন ভ্যারিয়েন্টের জন্ম হতে পারে তা নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সব বিশেষজ্ঞই বলছেন, ওমিক্রনই শেষ ভ্যারিয়েন্ট নাও হতে পারে।
বিখ্যাত জার্নাল ‘নেচার’-এ সম্পতি প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ওমিক্রন ভাইরাসটি ভবিষ্যতে কী কী রূপ ধারণ করতে পারে তার সম্ভাব্য চারটি পরিস্থিতির পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।

পরিস্থিতি ১: সারসকভ-২ এর সম্ভাব্য পরিস্থির মধ্যে সবচেয়ে আশাজাগানিয়া কিন্তু সবচেয়ে কম সম্ভাবনাময় পরিস্থিতি হলো ভবিষ্যতে হামের পথ অনুসরণ করা। হাম ভাইরাসটি মূলত নতুন জন্মের ভিত্তিতে সঞ্চালিত হয়। এর কোনো ভ্যারিয়েন্ট ফরমেশনের সুযোগ নেই। অথচ সারসকভ-২ ভাইরাসের মূল চরিত্রই হলো প্রতিরোধের মুখে পড়ে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টি। এই ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টির কারণে নতুন নতুন ভাইরাল ঢেউ, ভ্যাকসিনের মাধ্যমে বা ন্যাচারাল ইনফেকশনের মাধ্যমে তৈরি এন্টিবডির কার্যকারিতা এবং স্থায়িত্ব কমে যাচ্ছে। এ ছাড়াও দিন দিন অ্যান্টিবডি ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতে ভ্যাকসিনেশন কিংবা ঘন ঘন ইনফেকশনের মাধ্যমে যদি কখনো নতুন ভ্যারিয়েন্ট ফরমেশন এমন দুর্বল পর্যায়ে নেমে আসে যে, আক্রান্ত হলেও রোগীর কোনো উপসর্গই প্রকাশ পাবে না, তা হলেই কেবল এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

পরিস্থিতি ২: শ্বাসযন্ত্রের সিনসিসিয়াল ভাইরাসের (আরএসবি) পথ অনুসরণ করার সম্ভাবনা প্রথম পরিস্থিতির চেয়েও বেশি এবং এখনো অপেক্ষাকৃত আশাব্যঞ্জক। বেশির ভাগ শিশু তাদের জীবনের প্রথম দুই বছরে এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়।

পরিস্থিতি ৩: তৃতীয় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তা অনেকটা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস টাইপের মতো, যা প্রতি বছরই বিশ্বের কোনো জায়গায় মওসুমি মহামারী আকারে হানা দেয়। এখানে ভাইরাসটির খুব দ্রæত অভিযোজনের ফলে নতুন ভ্যারিয়েন্ট আগেকার ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট ইমিউনিটিকে পাশ কাটাতে পারে। এ জন্য অবশ্য ভাইরাস ইনফেকশন কন্ট্রোল করার জন্য প্রতি বছর নতুন নতুন ভ্যাকসিনের দরকার হয় যার প্রয়োগে রোগের সিভিয়ারিটি কমে যায়।

পরিস্থিতি ৪: যে পরিস্থিতিতে সারসকভ-২ এমনভাবে অভিযোজিত হয় যে, তা মানুষের ইমিউনিটিকে কেবল ধীরে ধীরে এবং দুর্বলভাবে প্রতিহত করতে পারে, যার চরিত্র ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ-বি’র সাথে মিলে যায়। ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপÑ এ ভাইরাসটির বিবর্তন ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ-বি এর চেয়ে বেশি। শিশুরা এর মাধ্যমে বেশি আক্রান্ত হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অভিমত:

সংস্থাটি বলছে, পরবর্তী ভ্যারিয়েন্ট যা ভবিষ্যতে আসতে পারে তা বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক হতে পারে। কিন্তু এই গ্যারান্টি দেয়া যাবে না পরের ভ্যারিয়েন্ট বর্তমানের চেয়ে মারাত্মক হবে না। শুধু তাই নয়, পরবর্তী ভ্যারিয়েন্টের অ্যান্টিবডি ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা বর্তমানের চেয়েও বেশি হতে পারে। সিডিসি জানিয়েছে, ফাইজারের তৃতীয় ডোজ প্রয়োগের ১৪ দিন পর থেকে ওমিক্রনে আক্রান্ত ব্যক্তির ৯০ শতাংশকে হাসপাতাল ভর্তি করা থেকে বিরত রাখতে পারে এবং ৭৫ শতাংশকে উপসর্গযুক্ত হতে বাধা দেয়। কিন্তু বুস্টার প্রয়োগের মাত্র ১০ সপ্তাহ পর এর প্রটেকশন মাত্রা ৪৫-৫৯ শতাংশে নেমে আসে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইমার্জেন্সি ডাইরেক্টর ড. মাইক রাইন বলেছেন, ‘আমরা আশা করছি দুই এক জায়গায় এপিডেমিক রূপ দেখিয়ে এই ভ্যারিয়েন্টটি কম সংক্রামক হয়ে যেতে পারে। ফলে এটি হয়তো মওসুমি ফ্লুতে রূপান্তর বা কেবল ভালনারেবল গ্রুপকে আক্রান্তকারী ভাইরাসে রূপান্তর ঘটতে পারে। তবে যেহেতু ভ্যারিয়েন্টটি বেশ অভিযোজিত হচ্ছে, তাই বিশ্ববাসীর উচিত হবে একে কড়া নজরদারিতে রাখা।’

ভাইরাসের সাথে সহাবস্থানের প্রস্তুতি নিতে হবে
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমার্জেন্সি মেডিসিনের অধ্যাপক ড. মেগান রানি বলেছেন, ‘আমরা শুধু ডুবন্ত মানুষগুলোকে বাঁচাতে ব্যস্ত, ভাইরাসের স্রোত ঠেকাতে তত চেষ্টা করছি না।’

মহামারীর শুরুর দিকটায় আমরা মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি লকডাউন-শাটডাউন দিয়ে ঘরে অবস্থান করিয়ে। পরে ২০২১ সালের গোড়ার দিকে আমরা অবগত হলাম যে, ভাইরাসটি ভালোই মিউটেট করতে পারছে। ফলে আমাদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনগুলো কিছুটা অকার্যকর প্রমাণিত হতে লাগল নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট উদ্ভব হওয়ার কারণে। এখন আমরা বাধ্য হয়েই ভ্যারিয়েন্ট স্পেসিফিক ভ্যাকসিন আবিষ্কারে মনোযোগী হয়েছি।

কোভিড মিউটেট করছে, নতুন ভ্যারিয়েন্টও অবশ্যম্ভাবী মনে হয়, আর এই কারণে কোভিডের ওপর আমার কোনো ক্ষোভ নেই, বরং ক্ষোভটা হলো আমরা এখনো ভাইরাসের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছি না।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, কোভিড ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতে কোনো না কোনো ফর্মে টিকে থাকবে।

আগামী ভ্যারিয়েন্ট হবে অতিসংক্রামক এবং বর্তমান ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে বেশি অ্যান্টিবডি ফাঁকি দিতে সক্ষম। ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি (আইএমএ) কোভিড টাস্কফোর্স কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. রাজিব জয়াদেভেন বলেছেন, ‘ভাইরাসটি সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর পুনরায় ইনফেকশন করার ক্ষমতা ডেল্টার চেয়ে ৫.৪ গুণ বেশি। ফলে ইতঃপূর্বে ভ্যাকসিনের কারণে যাদের প্রটেকশন পুনরায় ইনফেকশনের বিরুদ্ধে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ছিল, ওমিক্রনের কারণে তা ১৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ঢেউ বছরের পর বছর বিভিন্ন রূপে পৃথিবীময় সময়ের ব্যবধানে উঠা-নামা করবে। ভাইরাসের ইতিহাস বলছে, আগামী ছয় থেকে আট মাসের মাথায় আরেকটি ঢেউ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সে সময় আসা পর্যন্ত স্বল্প মাত্রার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের ধাক্কা আমাদের সামাল দিয়ে যেতে হবে।

সারসকভ-২:

‘ফরচুনে’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমার্জেন্সি চিকিৎসক ড. মেগান রানি বলেছেন, ‘যেহেতু কোভিড বর্তমানে এন্ডেমিক ফেজে অবস্থান করছে, সেহেতু এটির ঝুঁকিমুক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ এই দুই ধরনের মিউটেশনের সম্ভাবনাই আছে।’

আলবার্ট আইনস্টাইন কলেজের ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক কার্তিক চন্ড্রন বলেছেন, ‘আমরা ওমিক্রনকে দুনিয়াতে পদচারণার যথেষ্ট সময় দিয়েছি, টিকাদানের গতিও যথেষ্ট মন্থর, সেহেতু একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট এলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন থেকে আলাদা হবে, যেমন- ওমিক্রন ডেল্টা থেকে আলাদা।’ সাধারণ মানুষের যেমনটি ধারণা যে, ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং দুর্বল হতেই থাকবে। এই ধারণারও কোনো শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে তিনি সাবধান করেছেন।

একটি চরম সত্য কথা হলো, এই প্যান্ডেমিক ডিজিজ অন্য দশটি প্যান্ডেমিক ডিজিজের মতোই একদিন শেষ হবে। করোনাভাইরাসটি প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞের মতে, সারসকভ-২ শিগগিরই আরেকটি নতুন ভ্যারিয়েন্টের জন্ম দেবে। তবে ভিন্ন মতও আছে। বিখ্যাত ডিজার্ট নিউজ পত্রিকায় ১৭ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে কোভিড-১৯-এর চারটি পরিণতির কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। বর্তমান করোনা ঢেউয়ের গতি-প্রকৃতি লক্ষ করে যে চারটি সম্ভাব্য পরিণতির কথা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ-

প্রথমত, এটি প্যান্ডেমিক আকারে না থেকে কিছুটা দুর্বল হয়ে গুচ্ছাকারে এবং দেশে দেশে এপিডেমিক আকারে উপরের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রামক রোগ হিসেবে সমাজে বিদ্যমান থাকবে।

দ্বিতীয়ত, নিজেদের মধ্যে মউটেট করে এমন পরিবর্তন আনয়ন করবে যাতে এরা শরীরের শুধু রেস্পিরেটরি ট্রাক্টকে আক্রান্ত না করে অন্যান্য অঙ্গের বিভিন্ন সেলকে আক্রান্ত করবে যা বর্তমানের চেয়ে ভালো কি মন্দ হবে এখনই প্রেডিক্ট করা যাচ্ছে না। এটাকে কোভিড-১৯-এর নতুন ভার্সন বলা হবে।

তৃতীয়ত, চলমান সক্রিয় ভাইরাসটি আরেকটি ভাইরাসের সাথে সংযুক্ত হয়ে নতুন আরেকটি হাইব্রিড ভাইরাসের জন্ম হবে এবং নতুন আরেকটি প্যান্ডেমিক পরিস্থিতি বিরাজ করবে। ঠিক এমনটিই হয়েছিল ২০১৯ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী প্যান্ডেমিসিটি তৈরির ক্ষেত্রে যেখানে মানুষ থেকে আসা একটি ভাইরাস পাখির ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সাথে মিলে হাইব্রিড জাতের ভাইরাস সৃষ্টি হয়েছিল যা ভয়ানক মানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল।

চতুর্থত, ভাইরাসটি অভিযোজিত হতে হতে এমন শক্তি অর্জন করবে যাতে এমনকি ভ্যাকসিনেটেড মানুষের রক্তের অ্যান্টিবডিকে সহজেই ফাঁকি দিয়ে ইনফেকশনের সহজ শিকারে পরিণত করবে।

২৪ জানুয়ারি, ২০২২ সালে ডেজার্ট নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইনফেকশাস ডিজিজ বিশেষজ্ঞ ড. এ ডি স্টিনেজেম বলেছেন, ‘নিশ্চিতভাবেই আরেকটি নতুন ভ্যারিয়েন্টের দিকে আমরা দ্রুত ধাবিত হচ্ছি, কিন্তু নির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না তার চরিত্র কেমন হবে। আবার ওমিক্রন ইন্ডিউসড ইনফেকশনের মাধ্যমে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি আমাদেরকে সুরক্ষাও দিতে পারে।’

প্রকৃতপক্ষে একটি ভাইরাস হলো জেনেটিক মেটারিয়ালে ভর্তি একটি ম্যাজিক বক্স। স্ট্যাবল ভাইরাস সেটাই যেটা মানুষের ভেতরে কিংবা বাইরে বেশি দিন বেঁচে থাকে। মানুষের ভেতরে যখন থাকে তখন ম্যাজিক বক্স খুলে সে চায় বংশবিস্তার কল্পে র‌্যাপলিকেট করতে। কিন্তু হাঁচি-কাশির সাথে বাইরে আসার সাথে সাথেই সে ম্যাজিক বক্সের কার্যক্রম বন্ধ করে কোনো রকমে টিকে থাকে আরেকটি হোস্ট না পাওয়া পর্যন্ত। আর মানুষের অবস্থা হলো, ভাইরাসের সাথে লড়াই করতে করতে সে ক্লান্ত না হয়ে বরং তার ইমিউন সিস্টেম ভাইরাস দমনে নতুন কৌশল খুঁজে বের করে। এভাবেই একটি প্যান্ডেমিক ভাইরাস এন্ডেমিক ভাইরাসে রূপ নিয়ে বছরের পর বছর মানব সমাজে টিকে থাকে। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতেও ভাইরাস-মানুষের সহাবস্থান টিকে থাকবে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com