প্রতিনিয়ত কথায় ও কাজে আমরা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে চলি। অবলিলায় এগিয়ে যাই ধ্বংসের পথ। কিন্তু আমাদের স্বাভাবিক জীবনে এর কোনো ছাপ দেখতে পাই না। আমরা মনে করি, কতই তো আল্লাহর অবাধ্য হচ্ছি, তিনি তো কিছুই মনে করছেন না। আমার তো কোনো শাস্তি হচ্ছে না। কোনো কিছুতেই তো কমতি নেই আমার। ভালোই তো কেটে যাচ্ছে হারাম জীবন উপভোগ করে। আমার তো কোনো কিছুরই অভাব নেই। বনি ইসরাইলের এক সাধু বলেছিলেন, হে আল্লাহ্! কতই তো আপনার অবাধ্য হই, আপনি তো কিছুই মনে করেন না। আমার কোনো উপযোগিতায় তো টান পড়ছে না। আল্লাহ তাকে জানিয়ে দিলেন, ‘কত শাস্তি তোমাকে আমি দিচ্ছি, কিন্তু আফসোস তুমি টেরও পাও না। আমার কাছে হাত তুলে মাফ চাওয়ার ক্ষমতা কি আমি তোমার থেকে কেড়ে নেইনি?’ (আবু নুয়াইম আল-ইস্পাহানি রচিত হিলইয়াতুল আউলিয়া গ্রন্থে বর্ণিত)।
এই যে হরদম পাপের পথে হেঁটে হেঁটে জীবন পার করে দেওয়া এর চেয়ে বড় কোনো শাস্তি সত্যিকারার্থে নেই। বান্দা যদি ভুল করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তবে আল্লাহ তার বান্দার ওপর আরও বেশি খুশি হন। তাকে ক্ষমা করেন। দয়ার চাদরে আবৃত করে নেন। কিন্তু যার কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ার শক্তিও তুলে নেন সেই প্রকৃত হতভাগা। তার চেয়ে বড় দুর্ভাগা আর কেউই নেই।
ক্ষমা প্রার্থনার ফলে আমরা প্রতিনিয়ত যেসব ভুল-ত্রুটি করে থাকি তার শাস্তি মাফ হয়ে যায়। অনুতাপ ও অনুশোচনার কান্না খারাপ কাজগুলোকে ঢেকে দেয়। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বারবার ক্ষমা প্রার্থনার কথা বলেছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি আদেশ করেছেন। ক্ষমা প্রার্থনার সঙ্গে মূলত দুটি বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। তার একটি হচ্ছে, অনুতাপ ও অনুশোচনা আর অপরটি হচ্ছে, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা। বান্দা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে, আল্লাহ সেই বান্দাকে আরও আপন করে নেন। ক্ষমার চাদরে আবৃত করে নেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘এবং তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সূরা মুযযাম্মিল, আয়াত ২০।) আল্লাহতায়ালা অন্যত্র বলেন, ‘যে গুনাহ করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত ১১০।)
প্রতি মুহূর্তেই আমরা জেনে, না জেনে কিংবা বুঝে, না বুঝে ভুল করেই চলছি। পাহাড়সম ভুলে আমাদের স্বাভাবিক জীবনও কখনো-সখনো অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কিছু কিছু ভুল জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। বিশাল আকাশ ও বিস্তৃত জমিনও সংকীর্ণ হয়ে পড়ে আমাদের সীমালঙ্ঘনের কারণে। শেষমেশ অপমানিত হয়ে কেউ কেউ বাঁচার আশাও হারিয়ে ফেলে। তখনো মহান রব ক্ষমার ডালি নিয়ে ডাকেন বান্দাকে। নির্জন রাতের আঁধার ভেদ করে প্রভুর সেই আহ্বান পাপীর হৃদয়েও কড়া নাড়ে। নিজেকে পাপী ভেবে চোখের পানি ঢেলে দিয়ে বান্দা মহান রবের কাছে ফিরে এলে সবকিছু ভুলে যান তিনি। একান্ত ভালোবাসায় সিক্ত করেন পাপীকে। তাই শয়তানের ধোঁকায় পড়ে কখনো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। আনাস (রা.) বলেন, নবিজি বলেছেন, প্রত্যেক আদম সন্তানই অপরাধী। উত্তম অপরাধী তারাই যারা তওবা করে, ক্ষমা চায়। বুখারি ও মুসলিমের বর্ণনা থেকে জানা যায়, প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকতে আমাদের মহান রব নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসেন। আর বলেন, আমাকে ডাকার কেউ আছ কি? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। আমার কাছে চাওয়াার কেউ আছ কি? আমি তাকে প্রদান করব। কেউ আছে কি আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার? আমি তাকে ক্ষমা করব।
ক্ষমা প্রার্থনা করা সবচেয়ে বড় ইবাদত। এতে আল্লাহ যত বেশি খুশি হন, অন্য কোনো ইবাদতে তিনি এতবেশি খুশি হন না। এ জন্য নবিজি (সা.) দিনে প্রায় সত্তরবারেরও বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। বান্দাকে ক্ষমা চাওয়ার কত সুন্দর সুন্দর ভাষা শিখিয়ে দিয়েছেন আমাদের স্রষ্টা মহান রাব্বানা। কুরআনুল কারিমে প্রভুর শেখানো এমন অসংখ্য দোয়া রয়েছে যেগুলো পাঠ করে আমরা মহান রবের কাছে চাইতে পারি তার ক্ষমা, তার দয়া ও তার ভালোবাসা। আমাদের মনের যত ব্যাথা-বেদনা আছে, লুকায়িত যত কষ্ট আছে সবকিছু প্রাণ খুলে মহান রবকেই শুধু বলা যায়। তাই আসুন, এখনই ফিরি মহান রবের কাছে, সবকিছু বলা যায় যার কাছে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট