মহামারী করোনার মধ্যেও দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন ব্যাপকহারে বেড়েছে। গত অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনা বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৪৩ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যাংক খাতেই বেড়েছে প্রায় ৫৪ শতাংশ। এ সময়ে দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বড় অঙ্কের নগদ লেনদেনের ঘটনা অস্বাভাবিক বেড়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স রুমে আয়োজিত এক মতবিনিময়সভায় এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে বিএফআইইউ প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস জানান, দেশ থেকে প্রতিবছর ঠিক কি পরিমাণ অর্থপাচার হয়, তার সুনির্দিস্ট কোন তথ্য বিএফআইউর কাছেও নেই। এ সময় বিএফআইইউর মহাব্যবস্থাপক এবিএম জহুরুল হুদা, পাবলিকেশন ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক জিএম আবুল কালাম আজাদ, বিএফআইইউর উপমহাব্যবস্থাপক কামাল হোসেন ও যুগ্ম পরিচালক ইকরামুল হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বিএফআইইউ বলছে, রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতার উন্নয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধি, ই-কমার্স ও এমএলএম ব্যবসায় প্রতারণামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং সরকারের জিরো টলারেন্সনীতির কারণে সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রমের রিপোর্টিং বেড়েছে। এ ছাড়া লেনদেনে বাড়তি সতর্কতা এবং অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিধিবিধান কঠোরভাবে বাস্তবায়নের কারণেও সন্দেহজনক লেনদেনর ঘটনা বেশি ধরা পড়েছে। সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনা তদন্ত করে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।
অর্থপাচার, জঙ্গি বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন, ঘুষ-দুর্নীতি বা বেআইনি কোনো লেনদেনের বিষয়ে সন্দেহ হলে দেশের ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শেয়ারবাজারে লেনদেনে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান (সিএমআই), বীমা কোম্পানি, মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন রিপোর্টিং এজেন্সিকে বিএফআইইউর কাছে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) ও সন্দেহজনক কার্যক্রম প্রতিবেদন (এসএআর) পাঠাতে হয়। একইভাবে ১০ লাখ টাকার ওপরে যে কোনো ধরনের লেনদেন হলে তা নগদ লেনদেন প্রতিবেদন (সিটিআর) হিসেবে রিপোর্ট করতে হয়। পরে বিএফআইইউ থেকে এসব লেনদেন বিশ্লেষণ ও তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে প্রতিবেদন সরবরাহ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনা বেড়ে গেলে সেটি অবশ্যই অনুসন্ধানের দাবি রাখে। কেন এত বাড়ল, সেটি তদন্ত করে দেখতে পারে বিএফআইইউ। আবাসন খাতে সন্দেহজনক লেনদেন বাড়তে পারে। কারণ এখানে বিভিন্ন উৎস্য থেকে লেনদেন হয়। অর্থপাচারও বাড়তে পারে। সীমান্তবর্তী জেলায় বড় অঙ্কের নগদ লেনদেন বৃদ্ধি নিয়ে তিনি বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকায় নগদ লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়াও সন্দেহজনক। কে বা কারা লেনদেন করেছে, কোন হিসাবে কত লেনদেন হয়েছে, সেটিও খতিয়ে দেখতে পারে বিএফআইইউ ও বাংলাদেশ ব্যাংক।
সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা বাড়ার বিষয়ে বিএফআইইউপ্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, শুধু দুর্নীতির কারণে সন্দেহজনক লেনদেনে বেড়েছে, এমনটি নয়। রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থারগুলোর সক্ষমতা ও সচেতনতা বৃদ্ধির কারণেও এ সংখ্যা বাড়তে পারে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘দেশ থেকে কত টাকা পাচার হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে এটি জানার জন্য কাজ করা হচ্ছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, কানাডার বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম এবং পিকে হালদার ইস্যু নিয়ে বিএফআইইউ কাজ করে যথাযথ সংস্থার কাছে রিপোর্ট দিয়েছে। তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বিএফআইইউর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন রিপোর্টিং এজেন্সি বিএফআইইউতে মোট ৫ হাজার ২৮০টি লেনদেন ও কার্যক্রম সন্দেহজনক মনে করে রিপোর্ট করে, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৩ হাজার ৬৭৫টি। ফলে এক বছরের ব্যবধানে সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রমের রিপোর্ট বেড়েছে ১ হাজার ৬০৫টি বা ৪৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর মধ্যে এসটিআর হিসেবে ২ হাজার ৬৯৬টি এবং এসএআর হিসেবে ২ হাজার ৫৮৪টি সন্দেজনক রিপোর্ট হয়েছে। এই সময়ে ব্যাংকিং খাত থেকে সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ৪৯৫টি এসটিআর ও এসএআরের রিপোর্ট বিএফআইইউতে এসেছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল মাত্র ২ হাজার ৯০৮টি। ফলে ব্যাংকিং খাতে এসটিআর ও এসএআর এক বছরে বেড়েছে ১ হাজার ৫৮৭টি বা ৫৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৭০টি এসটিআর ও এসএআর তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৭০৩টি। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে ১০০টি, যা আগের অর্থবছরে ছিল মাত্র ৫৭টি। সিএমআই থেকে এসেছে মাত্র ১৫টি, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩টি। আর ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে আগের অর্থবছরে ৪টি এলেও এবার তা শূন্যে নেমেছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, সন্দেহজনক লেনদেন বৃদ্ধির পাশাপাশি ২০২০-২১ অর্থবছরে নগদ লেনদেনের তথ্য প্রেরণ (সিটিআর) বেড়েছে। এ সময়ে ২ কোটি ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৩৬৫টি সিটিআর লেনদেন হয়েছে। এসব সিটিআরের মাধ্যমে ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার জমা ও উত্তোলন হয়েছে। আগের অর্থবছর ১ কোটি ৬১ লাখ ৪১ হাজার ৭২১টি সিটিআরের বিপরীতে ১১ লাখ ৭১ হাজার ৯২৯ কোটি টাকার জমা ও উত্তোলন হয়। সিটিআর লেনদেনের বড় অংশই ঢাকা বিভাগে। এর পরিমাণ ৭ লাখ ৩৬ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা, যা মোট সিটিআরের ৫১ শতাংশ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ২ লাখ ২ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা, খুলনা বিভাগে ১ লাখ ১৫ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, বরিশালে ১ লাখ ১৫ হাজার ৫০৬ কোটি, রাজশাহীতে ১ লাখ ১ হাজার ৬৮ কোটি, রংপুরে ৮৬ হাজার ৬২৯ কোটি, ময়মংসিংহে ৫৭ হাজার ৭৫৩ কোটি ও সিলেটে ২৮ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা।
দেশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলাতে নগদ লেনদেনের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়েছে। বিএফআইইউ বলছে, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো অর্থপাচার ও সন্ত্রাস অর্থায়নের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ সিটিআর লেনদেন হয়েছে যশোরে ২৭ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া কুমিল্লায় ২৭ হাজার ১০ কোটি টাকা, ময়মনসিংহে ২২ হাজার কোটি, দিনাজপুরে ২১ হাজার ২০৭ কোটি, নওগাঁয় ১৮ হাজার ৮৩ কোটি, সিলেটে ১৭ হাজার ১৫৩ কোটি, জামালপুরে ১৬ হাজার ৮৯৪ কোটি, ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ১৩ হাজার ৯১৫ কোটি, ফেনীতে ১২ হাজার ৩৩৪ কোটি, কক্সবাজারে ১১ হাজার ৪২৮ কোটি, নীলফামারীতে ১১ হাজার ৭৪৮ কোটি, চুয়াডাঙ্গায় ১০ হাজার ৪৭২ কোটি, শেরপুরে ১০ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা এবং সাতক্ষীরায় ৯ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে দেখা যায়, সীমান্তবর্তী জেলার নিকটবর্তী অনেক জেলায় লেনদেনের পরিমাণ তুলনামূলক কম। যেমন- কক্সবাজারের নিকটবর্তী জেলা রাঙামাটিতে লেনদেন মাত্র ১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। নওগাঁর নিকটবর্তী নাটোরে মাত্র ৬ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। ফেনীর নিকটবর্তী লক্ষ্মীপুরে ৫ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। সাতক্ষীরার নিকটবর্তী বাগেরহাটে ৪ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা। চুয়াডাঙ্গার নিকটবর্তী মাগুরায় ৩ হাজার ৪০ কোটি টাকা। দিনাজপুরের নিকটবর্তী জয়পুরহাটে ৫ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা।