আজ ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস। পানির আরেক নাম জীবন। পৃথিবীর সব প্রাণের উৎস পানি এবং সবাই পানির ওপর নির্ভরশীল। অন্য দিকে অসংখ্য মৃত্যুর কারণও পানি। সুপেয় পানির সঙ্কট আজ বিশ্বব্যাপী। এ সঙ্কট নিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র পৃথিবী আজ উদ্বিগ্ন। বিশ্বব্যাপী এ সঙ্কটের পেছনে প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট দুটো কারণই দায়ী। প্রকৃতির প্রতি মানুষের অপরিণামদর্শী আচরণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে। সুপেয় পানির সবচেয়ে সহজ এবং বড় উৎস নদীর ওপর মানুষ আজ দেশে দেশে বাঁধ দিচ্ছে, পাহাড় ধ্বংস করছে, নির্বিচারে পানি দূষণ করছে, যত্রতত্র খনন ও অবকাঠামো নির্মাণ করে পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত করছে। অনেকে ধারণা করছেন, ভবিষ্যতে সুপেয় পানির সঙ্কট হয়ে দাঁড়াবে আরো ভয়াবহ। এমনকি সুপেয় পানির অধিকার নিয়ে আগামীতে বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেতে পারে বলেও ধারণা করেন কেউ কেউ।
ইউনিসেফের এক জরিপ বলছে, চীনের ১০ কোটি ৮০ লাখ, ভারতের ৯ কোটি ৯০ লাখ ও নাইজেরিয়ার ছয় কোটি ৩০ লাখ মানুষ সুপেয় পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত। অন্য দিকে ইথিওপিয়ায় চার কোটি ৩০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় তিন কোটি ৯০ লাখ ও পাকিস্তানে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ সুপেয় পানি পান না। আমাদের দেশে আছে চরম সঙ্কট। এখানে প্রায় দুই কোটি ৬০ লাখ লোক পানি সঙ্কটের মধ্যে দিনাতিপাত করছে।
বর্তমানে পৃথিবীতে ২৬০টির বেশি আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকা রয়েছে। বিশ্বের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ এসব নদীর ওপর নির্ভরশীল; যে কারণে শত শত আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে পানি সম্পদের ওপর চাপ বাড়ছে। এই চাপ মোকাবেলায় নদী অববাহিকায় উজানের দেশগুলো গড়ে তুলেছে বিশালাকার বাঁধ বা ড্যাম। যার খেসারত ভাটির প্রাণ ও প্রকৃতিকে দিতে হচ্ছে। এসব নদনদীর পানির হিস্যা নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে তৈরি হচ্ছে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সম্পর্কের অবনতি, যা দেশগুলোর মধ্যকার ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেশগুলোর চলমান প্রতিদ্বন্ধিদ্বতার মুখে শত শত আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি টিকবে কি না, তা নিয়ে নতুন করে তৈরি হচ্ছে ধোঁয়াশা। এর একটি জ্বলজ্বলে উদাহরণ হচ্ছে নীল নদ নিয়ে ইথিওপিয়ার রেনেসাঁ নির্মাণ প্রকল্প। তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যকার বিবাদের আড়ালে ও রয়েছে ইউফ্রেটিস নদীর পানি বণ্টনজনিত সমস্যা। এ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বহু দেশ লড়ে যাচ্ছে পানির জন্য। নীল নদের ওপর রেনেসাঁ ড্যাম তৈরির জের ধরে ইথিওপিয়া ও মিসরের দ্ব›দ্ব নিয়ে চিন্তিত বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর ৫৪টি এসেছে ভারতের মধ্য দিয়ে, তিনটি এসেছে মিয়ানমার থেকে। বাংলাদেশ ভাটির দেশ হিসেবে নদীগুলোর পানির নায্য হিস্যার দাবিদার। অভিন্ন ৫৪টি নদীর মধ্যে ৪৭টি নদীর গতিপথে ছোটবড় পাঁচ শতাধিক বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। এতে প্রবাহ কমে শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সাগরের পানি ঢুকে ভাটি অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়াচ্ছে। আবার বর্ষাকালে বন্যার তোড়ে এতদঞ্চলের পানীয় জলের স্থানীয় উৎসগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। মোট কথা বাংলাদেশের পানীয় পানির সমস্যা দিন দিন ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে।
পানি নিয়ে দেশে দেশে নদী-বিরোধ ও পানি সঙ্কট বাড়ছে। অনেক দেশের রাজ্য বনাম রাজ্য, কৃষি খাত বনাম শিল্প খাত পর্যন্ত একাধিক পক্ষ তৈরি হয়ে নতুনরূপে শুরু হয়েছে পানি নিয়ে কোন্দল। ভারতের কাবেরি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে কর্নাটক ও তামিলনাড়ূ রাজ্যের বিবাদ বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কেনিয়ার বিভিন্ন আদিবাসী গেত্রের মধ্যে পানি নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। সুদানের দারফুরে গৃহযুদ্ধ শুরুর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পানি সঙ্কট। যেমন লেবানন ও ইসরাইলের মধ্যে হাসবানি নদীর পানি নিয়ে বিরোধ, তেমনি তুরস্ক সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যে ইউফ্রেটিস নিয়ে, সিরিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে গ্যালিলি সাগর নিয়ে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন ও জর্দান নদী নিয়ে সুদান, মিসর, ইথিওপিয়া ও আরো দেশের মধ্যে নীল নদ নিয়ে, সেনেগাল ও মৌরিতানিয়ার মধ্যে সেনেগাল নদী নিয়ে, ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে হেলমান্দ নদী নিয়ে বিবাদ রয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনা ও পানি নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।
পানির অধিকার যেমন সবার রয়েছে, পানির অপচয় ও অপব্যবহার রোধ করা সবার দায়িত্ব। কিন্তু পানির অধিকার আইন দিয়ে রক্ষা করা যাবে না। প্রথমে চাই পানির সরবরাহ। এর পর অধিকারের প্রশ্ন। তাই পানি প্রাপ্তির বিষয়ে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। জাতিসঙ্ঘ বলছে, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ পর্যাপ্ত পানি পায় না। ২০৫০ সাল নাগাদ ৯৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭০০ কোটি মানুষ পানির সমস্যায় পড়বেন। কাজেই এ সমস্যা মোকাবেলা করতে হলে পানির অপচয়রোধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে হুঁশিয়ার করেছেন, খাবার পানি নিয়ে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে একুশ শতকের মাঝামাঝি গৃহযুদ্ধ লাগতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছে পানি নিয়ে বিশ্ব যুদ্ধ হবে। বাংলাদেশে পানি সঙ্কট নেই, কিন্তু বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট প্রকট।
ভূপৃষ্ঠের ৭১ ভাগজুড়ে রয়েছে আদিগন্ত বিস্তৃত সুবিশাল পানিরাশি। কিন্তু এক গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বে ১১০ কোটি মানুষ প্রতিদিন পান করার জন্য পর্যাপ্ত পানি পায় না। আর বছরে ৩৬ লাখ লোক পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। পৃথিবীর ৮০টি দেশে পানির অপ্রতুলতার কারণে কৃষি, শিল্প ও জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে।
অনেকের মতে, এক বিংশ শতাব্দীতে পানি পেট্রোলিয়ামের চেয়ে দামি হয়ে উঠবে। আমেরিকার বহুমুখী বিনিয়োগকারী ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্স ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছে, পানিই হবে আগামী শতাব্দীর পেট্রোলিয়াম। সে দিন আর খুব দূরে নয়। যে দিন হয়তো কথাচ্ছলে ‘পানির দামে কেনা’ বলতে দুষ্প্রাপ্যতা বোঝাতে হবে। পানির অধিকার মানে জীবনের অধিকার। আর পানির সঙ্কট মানে জীবনের সঙ্কট। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে আর যোগ হবে ২০০ কোটি মানুষ। বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পানির প্রাপ্তি যথেষ্ট নয়, মাথাপিছু পানির পরিমাণের ভিত্তিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ দেশ কানাডা, সবচেয়ে সঙ্কটে কুয়েত। কানাডায় কুয়েতের চেয়ে ১০ হাজার গুণ বেশি পানির মজুদ রয়েছে।
পৃথিবীর সব প্রান্তে পানি সঙ্কটের চিত্র এক হবে না। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল পানির উৎসকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে ও পৃথিবীর বেশির ভাগ শহরের গোড়াপত্তন ঘটেছে কোনো না কোনো পানির উৎসকে কেন্দ্র করে। স্পষ্টত পানি জীবনের অস্তিত্বের পাশাপাশি গড়ে তুলেছে সভ্যতা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কালের বিবর্তনে বিশ্বের বড় শহরগুলো পানি সঙ্কটের সম্মুখীন হচ্ছে। এদের মধ্যে কিছু শহর একেবারে পানিশূন্য হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। বিশ্বের বৃহত্তম শহরগুলোর মধ্যে কেপটাউনের পানি ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া এ তালিকায় রয়েছে লন্ডন, ইস্তাম্বুল, জাকার্তা, কায়রো, বেইজিং, বেঙ্গালুরু, সাওপাওলোর মতো আরো শহরের নাম। এসব শহরে পানি সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে।
পানির এ ঘাটতি পূরণের জন্য বিগত এক দশকে প্রযুক্তিনির্ভর ডিস্যালাইশেন প্রক্রিয়া (সমুদ্রের পানি লবণমুক্ত করার প্রক্রিয়া) প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কুয়েতের কথা বলা যায়। কুয়েতে প্রাকৃতিক সুপেয় পানির ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশটি জনগণের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছে ডিস্যালাইনেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তবে এই প্রক্রিয়া খুবই ব্যয়বহুল। সব দেশের পক্ষে এটি অনুসরণ করা অসম্ভব।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড যে কৃষি তার মূল উৎস মিষ্টি পানি। পানিবিহীন ফসল বাংলাদেশে হয় না বললেই চলে। ফলে কৃষি খাত বাঁচিয়ে রাখতে মিষ্টি পানির কোনো বিকল্প নেই। মোট কর্মসংস্থানের শতকরা ৪৫ ভাগই কৃষি খাতে নিয়োজিত। পানির ওপর বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য ও কর্মসংস্থানের বেশির ভাগ নির্ভর করছে। তবে নদীমাতৃক এই দেশ এখন শুকিয়ে মরুভূমি হতে চলেছে। একসময় যে নদীতে প্রবল স্রোত ছিল সে নদী এখন মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রায় ৭০০ নদী ও শাখা নদী, ৯৮ হাজার জলাধার এবং ২৪ হাজার কিলোমিটার অধিক নদীনালার একটি বিশাল অংশ শুকিয়ে ভরাট হয়ে গেছে। মোটা দাগে বাংলাদেশের মিষ্টি পানির সার্বিক চিত্র এটি। এই চিত্র থেকে বোঝা যায়, যতটুকু মিষ্টি পানি রয়েছে, তার যথেচ্ছ ব্যবহার এবং দূষণের ব্যাপারে সচেতন নই। রাজধানীতে পানি দূষণের কারণে বছরে ক্ষতি হয় কয়েক হাজার কোটি টাকা। এক দিকে শিল্প কারখানা বিপুল পরিমাণ পানি ব্যবহার করছে, অন্য দিকে অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্য ফেলে নদীর পানি দূষণ করা হচ্ছে।
কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংক বলেছে, তেল নিয়ে বিংশ শতকে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। একবিংশ শতকে যুদ্ধ বাধতে পারে পানি নিয়ে, যদি না এখন থেকে এই পানি সংরক্ষণ ও এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যায়। পানিকে ‘নেক্সট অয়েল’বা ভবিষ্যতের তেল হিসেবে আখ্যায়িত করে কেউ কেউ বলেছেন, পানি দখলে রাখা নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। এখনই এর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো প্রচ্ছন্নভাবে হলেও ওয়াটার পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়েছে। এর কারণ সুস্পষ্ট। প্রতিটি দেশে জনসংখ্যা এবং পানি ব্যবহারের পরিমাণ বাড়ছে। সে তুলনায় পানির উৎস কমে যাচ্ছে এবং যে পানি রয়েছে তার ব্যাপক অপব্যবহার হচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট