রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০৭ অপরাহ্ন

বকাঝকা নয়, শিশুদের সাথে গল্প করুন

মো: তোফাজ্জল হোসাইন
  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০২২
  • ২৭২ বার

শিশুরাই দেশ, সমাজ, জাতির ভবিষ্যতের কর্ণধার। মা-বাবার কাছে সন্তানের চেয়ে বড় আর কিছুই হতে পারে না। তাদের ঘিরেই তো সমস্ত পরিকল্পনা, সব স্বপ্ন। কিন্তু সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়।

এই ‘মানুষ’ করতে গিয়েই সমস্যার শুরু। শুরু বকাঝকা, চর-থাপ্পড়, স্কেলের আঘাত- এমন নানা রকম শাস্তির। আর পত্র-পত্রিকা খুললেই শিশু নির্যাতন, শিশু ধর্ষণের খবর। আমাদের সমাজে হাজারো কাজের চাপ, আর্থিক টানাপড়েনসহ মানসিক চাপে কিংবা অনেক সময় নেহায়েত অভ্যাসের বশেও বাবা-মা ছেলেমেয়ের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। আমি, আপনি বা আমাদের চেনাজানা অনেকের জীবনেই এমন ঘটনা ঘটেছে, ঘটে চলেছে এখনো।

প্রশ্ন হলো, এমন শাস্তি কি সত্যিই শিশুদের প্রাপ্য? তারা মানবসমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আজকের শিশুরাই আগামীর সম্ভাবনার উৎস। তাদের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। তাই তাদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা, সহমর্মিতাপূর্ণ আচরণ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ কারণেই প্রিয় নবী সা:-এর হৃদয়ে শিশুদের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ। শিশুদের প্রতি নবীজীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ ছিল উম্মতের জন্য শিক্ষা। তাতে ফুটে ওঠে ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য। শিশুকে গায়ের জোরে বা শাস্তি দিয়ে কি সত্যিই কিছু শেখানো যায়? জোর করে খাওয়ানো, পড়তে বসানো, খেলতে বারণ করা- এসব আদতে কোনো কাজে আসে কি না, সে কথা কখনো ভেবে দেখেছেন? বরং এতে করে সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের দূরত্ব বাড়ে বলেই মনে হয়, বাড়ে উভয় পক্ষের মানসিক যন্ত্রণা, দ্ব›দ্ব, এমনকি অনেক সময় বিপথগামীও হয়ে যায় ছেলে বা মেয়ে।

শিশুদের যত্ন প্রয়োজন। তাদের আদর করে, নিয়ম করে হাঁটতে-দৌড়াতে-খেতে-পড়াশোনা করতে শেখাতে হয়। বন্ধুর মতো কাছে বসে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো সামনে তুলে ধরতে হয়। আসলে প্রকৃত শিক্ষা বলতে যা বোঝায়, সেটি তো শুধু স্কুল-কলেজের লেখাপড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। চারিত্রিক ও আত্মিক উন্নয়নের বিষয়গুলোও যে এ শিক্ষার সাথে জড়িত। আর সেই শিক্ষা বোধ হয় শুরু হয় জন্মের পর পরই।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে প্রায়ই দেখা যায় শিশুর সাথে, এমনকি শিশুর বয়স তিন থেকে সাত বছর পর্যন্তও, ‘ওলে বাবালে’, ‘আমার সোনা মনা’-এ সব আদুরে ভাষায় কথা বলতে। এভাবে কথা বলা মানেই কি ভালোবাসা প্রকাশ করা? না, কখনো না। আমাদের তো মনে হয়, এতে শিশুরা ঠিকমতো কথা বলতে শেখে না, শেখে না নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে।

আবার দু-তিন বছরের বহু শিশুকেই দেখা যায় খেলনা, জিনিসপত্র নষ্ট করতে, যা খাচ্ছে তার অর্ধেক ফেলে দিতে, খাওয়ার বা অন্য কোনো কাজের সময় অহেতুক লাফালাফি করতে। আচ্ছা, এর জন্যও আমরা, মানে অভিভাবকরাই কি দায়ী নই? আমরা কি বলি না- ‘ও তো বাচ্চা, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে’ অথবা ‘আমার ছেলেমেয়েটি ভীষণ দুরন্ত, কী করি, বলুন তো?’ আর তারপর শিশু আরো একটু বড় হয়ে যখন ওই একই কাজ করে, আমরা কি তখন তার পিঠে এক ঘা লাগাই না অথবা কান মলে দিই না?

নিজেকে একবার জিজ্ঞাসা করুন তো, আপনি কি আপনার সন্তানকে নিয়ম করে একটি জায়গায় বসিয়ে খাইয়েছেন? হাতে মোবাইল ফোন, আইপ্যাড অথবা টেলিভিশন ছেড়ে নয়, বসিয়ে প্রতিদিন গল্পের বই পড়ে শুনিয়েছেন? আপনি নিজে কি সময়মতো খান? বই পড়েন? বা সব জিনিস গুছিয়ে রাখেন? ভুলেও আপনি কখনো তাদের সামনেই ঝগড়াঝাঁটি করেন না তো? দেন না তো গালাগাল? শিশু-কিশোরদের মন থাকে সরল, কোমল ও পবিত্র। তারা কিন্তু ছয় মাস বয়স থেকেই শিখতে শুরু করে। তখন থেকেই তারা যেমন আদর বোঝে, বোঝে ধমকও। বয়স দুই পেরোতে না পেরোতেই শিশুদের নিয়ম-শৃঙ্খলা, সৌন্দর্যবোধ, গুছিয়ে রাখা, নষ্ট না করা, কোনটা করা উচিত এবং উচিত নয়- সেসব বোঝার ক্ষমতা আসে। এরপর ছয় বছরের মধ্যে তাদের মস্তিষ্ক পূর্ণতা পায়। এ বয়সের মধ্যে সে যা কিছু দেখে, শোনে এবং বোঝে, পরবর্তী জীবনে তার প্রতিফলন ঘটে। স্বার্থপরতা অথবা উদারতা, মায়া-মমতা এগুলো কিন্তু সে আমাদের দেখেই শেখে, অথবা শেখে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে।

ধরুন, আপনার সন্তান প্রতিদিন টিফিন ফেরত আনে। আপনি তখন তাকে যদি বলেন, ‘তুমি টিফিন খাও না কেন? তোমার বন্ধুরা খায় কেন? তুমি বোকা, না গাধা? আজ থেকে তোমার টিফিন বন্ধুরা যেন না খায়।’ এমনটা বলে তাকে কি আপনি আত্মকেন্দ্রিকতাই শেখালেন না? কেন বললেন না মিলেমিশে খাওয়ার কথা? আবার আপনার সন্তান খারাপ রেজাল্ট করার পর তাকে আপনি হয়তো বললেন, ‘তোমার খালাতো ভাই কত বুদ্ধিমান! খেলাধুলাতেও ভালো।’ অথবা ‘রানা কত ভালো রেজাল্ট করেছে, দেখেছ? তুমি তো কিছুই পারো না।’ এতে করে আপনি আপনার সন্তানটিকে উৎসাহিত না নিরুৎসাহিত করলেন?

এখানেই শেষ নয়। ঘরে যদি ছেলে থাকে, মেয়েও থাকে, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাবা-মা ছেলেটিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। তার পাতে বড় মাছটা, দুধের গ্লাসটা তুলে দিচ্ছেন। ছেলেটিকে খেলতে পাঠাচ্ছি অনায়াসে, অথচ মেয়েটিকে, সে যদি ছেলেটির চেয়ে বয়সে ছোটও হয়, তাকে বলছি ঘরের কাজে হাত লাগাতে। কেন? এটা কি বৈষম্য নয়? এতে করে আপনার ছেলেটি কি কোনো দিন মেয়েদের সম্মান দিতে শিখবে? বড় হয়ে ওরাই কি মেয়েদের উত্ত্যক্ত করবে না, বলুন? আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। শিশুদের সাথে অতি সহজেই তিনি মিশে যেতে পারতেন। তার ভালোবাসা এতটাই নিখাদ ও আন্তরিক ছিল যে, শিশুর সাথে মিশতে গিয়ে তিনি নিজেও শিশু হয়ে যেতেন। তার আচরণ ও কথাবার্তা হয়ে যেত নিতান্ত শিশুসুলভ।

নজরুলের মধ্যে শিশুসুলভ সারল্য ছিল। শুধু তা-ই নয়, তার মনটা ছিল শিশুর প্রতি আশ্চর্য সংবেদনশীল। তিনি দেখতেন শিশুর মধ্যে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল স্বপ্ন আর মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, শিশুর জীবন অসীম সম্ভাবনাময়। তারা চেষ্টা করলেই পারবে তাদের সম্ভাবনাময় জীবন কাজে লাগাতে।

এ কথাটিতে তিনি সুদৃঢ়ভাবে আস্থা রেখেই লিখেছেন-

আমি চেয়ে আছি তোদের পানে রে ওরে ও শিশুর দল,
নতুন সূর্য আসিছে কোথায় বিদারিয়া নভোতল।’
তুমি নও শিশু দুর্বল, তুমি মহৎ ও মহীয়ান
জাগো দুর্বার, বিপুল বিরাট অমৃতের সন্তান।’
অথচ আমি, আপনারা, আমরা যদি ছোট থেকে ছেলেমেয়েকে এক চোখে দেখতাম, যদি সান্নিধ্য, সাহচর্য দিয়ে, তাদের সাথে প্রাণখুলে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতাম, গল্প করতাম, বয়ঃসন্ধিতে বন্ধু হতাম- তাহলে হয়তো তাদের প্রতি আমাদের কঠোর হতে হতো না। প্রয়োজন হতো না গায়ে হাত তোলার, বকাঝকা করার। আর আমাদের কারো কারো সন্তানও হয়ে উঠত না নিষ্ঠুর, সহিংস এবং পিতৃতন্ত্রের প্রতিভূ। আমাদের শৈশবের সময় মা-বাবা ও দাদা-দাদীরা রাতে ঘুমানোর আগে কিংবা যেকোনো সময় সুযোগ পেলে রূপকথার গল্প শোনাতেন সততার শিক্ষা দেয়ার জন্য। গল্পগুলো আমাদের শুনতে বড়ই মধুর লাগত। তাই আমরা সেই গল্প বারবার শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করতাম! রূপকথার গল্পগুলো কাল্পনিক হলেও কিন্তু সততা নিয়ে লেখা। আগের সমাজে মানুষ অভাব ও সুবিধাবঞ্চিত জীবন যাপন তথা প্রশাসনবিহীন থাকলেও অন্যায়, অনিয়ম অপরাধ তেমন ঘটেনি। এই রূপকথার গল্পগুলোই তাদের আইন ও শৃঙ্খলা শেখাত। তাদের মধ্যে সততা ছিল, পারস্পরিক বন্ধন-সৌহার্দ্য ছিল। আজ নেই সেই রূপকথা, নেই সেই বন্ধন, ভ্রাতৃত্ব আর সততা। তবে গ্রামেগঞ্জে এখনো সেই রূপকথার গল্প আছে; আছে সততা আর মানবতাও!

অথচ বর্তমান সভ্যতায় প্রশাসনের সামনেই প্রতিদিন অগণিত অন্যায়-অনিয়ম, অবিচার-অত্যাচার ঘটেই চলেছে। মনকে অন্যায়-অনিয়মের মোহজাল থেকে রক্ষার্থে শৈশব থেকেই মনকে পাহারা দিতে হবে। কথায় আছে, কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস।’ ঠিক তেমনি ছোট থাকতেই প্রজন্মকে সততার শিক্ষা দিতে হবে। অন্যায়-অবিচারের সমাজে বড় হলে সে অন্যায়-অবিচারই করে যাবে। তাই প্রজন্মের কল্যাণে সততার সান্নিধ্যেই শিশুদের গড়ে তুলতে হবে। পরিশেষে বলা যায়, শিশুদের আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে লালন করতে হবে। যথার্থভাবে যত্ন নিয়ে আদব-কায়দা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শেখাতে হবে। তা হলেই তারা সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত হবে, দেশ ও জাতির সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে।
tafazzalh59@gmail.Com

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com