স্নায়ুতন্ত্রের রোগ পার্কিনসন্সে আক্রান্ত হওয়ায় মস্তিষ্কের যে ক্ষতি হয়, তা সারিয়ে তুলতে স্টেম সেল ব্যবহার করা যেতে পারে। সুইডেনের একদল বিজ্ঞানী ইঁদুরের ওপর পরিচালিত গবেষণা চালিয়ে এ কথা জানিয়েছেন। তাঁদের এই গবেষণা পার্কিনসন্স রোগের কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রচেষ্টায় একটি ‘বড় অগ্রগতি’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের আশা, অদূর ভবিষ্যতে স্টেম সেল প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মানুষের পার্কিনসন্স রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। পার্কিনসন্স রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় করার চিকিৎসা এখনো আবিস্কৃত হয়নি। তবে সচেতনতা দরকার। ওষুধ প্রয়োগ করা এবং মস্তিষ্কে উদ্দীপনা তৈরির মধ্য দিয়ে রোগটি সাময়িকভাবে উপশম করা যায়। সুইডেনের লান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, স্টেম সেলনির্ভর চিকিৎসাপদ্ধতিটি তারা ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করে ‘বড় সাফল্য’ পেয়েছেন।
মস্তিষ্কে স্নায়ুকোষ কমে যাওয়ার কারণে পার্কিনসন্স রোগ হয়ে থাকে। স্নায়ুকোষগুলো ডোপামিন নামের একধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদন করে, যা মানুষের মন-মেজাজ ও নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে। সুইডেনের ওই গবেষকরা পার্কিনসন্স রোগের মাত্রা বৃদ্ধিতে ইঁদুরের মস্তিষ্কের এক পাশের ডোপামিন উৎপাদনকারী স্নায়ুকোষগুলো মেরে ফেলেন। তারপর তারা মানবদেহ থেকে সংগৃহীত আদি বা ভ্রƒণ স্টেম সেল ডোপামিন উৎপাদনকারী স্নায়ুকোষে রূপান্তর করেন। সেগুলো ইঁদুরের মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়ে (ইনজেক্ট) দেখেন, পার্কিনসন্সের প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষতিগুলো সারিয়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে। তবে যুক্তরাজ্যের পার্কিনসন্স বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের ওপর এই চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগের আগে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নিবিড় যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। লান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এবারের দিবসলগ্নে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, স্টেম সেল থেকে তৈরি মস্তিষ্ক-কোষ বিকাশের গবেষণায় একটি বড় অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসায় স্টেম সেল প্রতিস্থাপনের গবেষণার পথ সুগম হয়েছে। স্টেম সেল থেকে তৈরি স্নায়ুকোষ এখন পর্যন্ত মানুষের চিকিৎসায় প্রয়োগ করা হয়নি। তবে গবেষকেরা বলছেন, তারা ২০১৭ সালেই এ-সংক্রান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। লান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিজেনারেটিভ নিউরোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মালিন পারমার বলেন, পার্কিনসন্স রোগের পরীক্ষামূলক চিকিৎসায় স্টেম সেল প্রয়োগের ব্যাপারে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
চিকিৎসা পদ্ধতি : পার্কিনসন্স রোগের চিকিৎসায় সীমিতসংখ্যক রোগীর ওপর যে চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে, তাতে মস্তিষ্ক রোগমুক্ত করতে একাধিকবার অপসারিত ভ্রƒণ কোষ থেকে টিস্যু সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষামূলক একাধিক চিকিৎসায় মিশ্র ফলাফল পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেগুলো বর্জন করা হয়। তবে রোগীদের এক-তৃতীয়াংশের মস্তিষ্কের ভ্রƒণ কোষগুলো ২৫ বছর পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। ভ্রƒণের স্টেম সেল ব্যবহার করার ব্যাপারে বাড়তি আগ্রহের কারণ হচ্ছে, প্রতিস্থাপনের জন্য এগুলো গবেষণাগারে ব্যাপক হারে উৎপাদন করা যায়। এ ছাড়া স্টেম সেলের উৎস হিসেবে এগুলো ব্যবহার করলে নৈতিকতা লঙ্ঘনের অভিযোগটাও পরিপূর্ণ কোষ ব্যবহারের তুলনায় কম আনা হয়। তবে যুক্তরাজ্যের গবেষকরা মনে করেন, মানুষের চিকিৎসায় স্টেম সেল ব্যবহারের জন্য আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
দাতব্য প্রতিষ্ঠান পার্কিনসন্স ইউকের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক আর্থার রোচ বলেন, সুইডেনের ওই গবেষণাটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি ভবিষ্যতে পার্কিনসন্স রোগের চিকিৎসায় স্টেম সেল ব্যবহারের ধরন কেমন হতে পারে, সে ব্যাপারে ইঙ্গিত দেয়।
যে বয়সে রোগটি বেশি হয় : গড়ে ৬০ বছর বয়সী ব্যক্তির মধ্যে পার্কিনসন্স রোগ দেখা দিতে পারে। তবে ১০ শতাংশ রোগীর মধ্যে ৪০ বছর বয়সেই রোগটির উপসর্গ পাওয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে পার্কিনসন্স রোগ শনাক্ত করা হয়েছে। আশার আলো হচ্ছে মনোবল শক্ত রেখে রোগীর পরিবার যেন রোগীর প্রতি যত্নশীল হয়ে উঠি এবং সচেতন থাকলেই জীবন যাপনে একটুখানি বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। রোগীকে সবসময়ই ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে যেতে হবে। তাকে সংঘ দিতে হবে। কোনো রূপ দুশ্চিন্তা, দুঃখের বা দুঃসংবাদ দিতে পারবেন না। কুষ্ঠকাঠিন্য থেকে সতর্কতা রাখতে হবে। খাবার খেতে হবে পুষ্টিকর। শরীরের অন্যান্য রোগ ডায়াবেটিস, থাইরয়েড থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। সূত্র : রিয়া নভোস্তি
লেখক : অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগ
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব
নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল