অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতিতে ‘ডেমনস্ট্রেশন ইফেক্ট’ বলে একটা কথা খুব চাউর আছে। এর বাংলা কোনো প্রতিশব্দ আছে কি না জানি না, তবে এর অর্থ হচ্ছে প্রদর্শনের প্রভাব। অর্থটা একটু খটমটে মনে হচ্ছে তাই না? অথচ দেখুন, আমরা উঠতে-বসতে, ঘরে-বাইরে সারাক্ষণ এই প্রদর্শনের প্রভাবজনিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ি। কিভাবে? আসুন, তাহলে আমরা কিছু দৃশ্যপট কল্পনা করি।
উপজেলা পর্যায়ের এক পদস্থ কর্মকর্তা দুপুরে লাঞ্চ করতে বাসায় এসেছেন। অফিসে আজ বেশ ঝামেলা গেছে। ফাইল-ওয়ার্ক, মিটিং-মাটিং, দর্শনার্থীদের সাক্ষাৎ ইত্যাদি তো ছিলই, তার ওপর ফোনে অন্যায়ভাবে ঝাড়ি খেয়েছেন তাঁর জেলা পর্যায়ের ‘বসের’। কী ব্যাপার? না, ‘বস’ তাঁকে একটা বেআইনি কাজ করার জন্য কয়েক দিন ধরে জ্বালিয়ে মারছেন স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার খোঁচাখুঁচিতে। কিন্তু কাজটি তিনি করতে পারবেন না বলে প্রথম থেকেই জানিয়ে আসছেন ‘বসকে’। তারপর আজকের এই ঝাড়ি। তিনি জানেন, ‘বসটির’ সঙ্গে ওই নেতা সাহেবের দশা আনা-ছয় আনার সম্পর্ক। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাটি তাঁর ১০ বছরের চাকরি জীবনে কখনো আদর্শচ্যুত হননি। যখনই এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দেয় তখন তাঁর মরহুম পিতার কথা মনে পড়ে যায়। চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে যখন মা-বাবার দু’আ নেওয়ার জন্য গ্রামের বাড়িতে যান তখন দরিদ্র পিতা তাঁর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ‘বাবা, জীবনে কখনো অসৎ পথে যেয়ো না, হারাম রুজি আর অন্যায় কাজ অন্তর থেকে ঘৃণা করো। দেখবে আল্লাহপাক সব সময় তোমার সহায় হবেন। ’ দরিদ্র কৃষক পিতার সেই উপদেশ তিনি চাকরির প্রথম দিন থেকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছেন। এ নিয়ে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে মাঝেমধ্যেই এক-আধ পশলা টক-ঝাল কথাবার্তা হয়, কিন্তু তিনি অনড়।
আজকে পেটে ক্ষুধার আগুন ও মনে ‘বসের’ ঝাড়ির বাক্যবাণগুলোর খোঁচার জ্বালা নিয়ে বাসায় এসে দেখেন খাবার টেবিল শূন্য। স্ত্রী বিছানায় চাদরমুড়ি দিয়ে পড়ে আছেন। বেচারা অফিসার কণ্ঠে দুশ্চিন্তা ঝরিয়ে জানতে চাইলেন স্ত্রীর কী হয়েছে। জ্বর-জারি না তার চেয়েও খারাপ কিছু। স্ত্রীর কপালে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেখলেন উত্তাপ স্বাভাবিক। তিনি তখন আবার জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে? রান্নাবান্না করনি?’ এবার স্ত্রী স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো লাফিয়ে উঠে বসলেন বিছানায়, বললেন, ‘আমার আবার কী হবে। আমি তো কাজের বুয়া মতির মা। আমার তো কাজই হচ্ছে রান্নাবান্না করা আর টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখা। জ্বর হবে তো ওই পাশের বাসার ভাবির। উনি একটা হাঁচি দিলে উপজেলা স্বাস্থ্য অফিসার থেকে শুরু করে এই শহরের সব সরকারি-বেসরকারি ডাক্তার এসে হাজির হবে। আর তাঁর বরের চোখের ইশারায় আঙ্গুর-বেদানা-আম-জাম-কলার বাগান নিয়ে এসে হাজির হবে যত কন্ট্রাক্টর আর ব্যবসায়ীর দল। আর তুমি আমার জন্য আনবে দুটো প্যারাসিটামল, আর না হয় এক প্যাকেট ওরস্যালাইন। ’ …পরবর্তী ডায়ালগগুলোর এক পর্যায়ে মোহাতারেমার ক্ষোভের আসল কারণ জানা গেল। প্রতিবেশী ভাবির আহ্বানে তিনি আজ তাঁর বাসায় গিয়েছিলেন সৌজন্য সাক্ষাতে। গিয়ে বুঝলেন ওই ভদ্রমহিলার আমন্ত্রণের আসল উদ্দেশ্য। তাঁর ওগোটি গতকাল সরকারি কাজে জেলা সদরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার সময় পেয়ারি লবেজান বিবিজানের জন্য সময়াভাবে বেশি কিছু আনতে পারেননি, শুধু লেটেস্ট ডিজাইনের এক সেট জড়োয়া আর দুটি ইন্ডিয়ান শাড়ি এনেছেন। ওগুলো দেখাতেই ওই সাদর আমন্ত্রণ। ‘আর তুমি? তুমি তো ঈদে-চান্দেও বউকে একটা সুতোও দিতে পারো না। আর জড়োয়া কী জিনিস বোঝো? তুমি তো আছ শুধু তোমার সততা, ন্যায়বিচার আর হারাম-হালাল নিয়ে। কী যে পাপ করেছিলাম, নইলে তোমার মতো অপদার্থ জোটে আমার কপালে!’
৩. আরেক ভদ্রলোক এক সরকারি অফিসের কেরানি। বউ-বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কায়ক্লেশে দিন গুজরান করেন। যে অফিসে চাকরি করেন সেখানে লোকে বলে সবাই নাকি উদার হয়ে ঘুষ খান। আর তিনি থাকেন মহামতি রামকৃষ্ণ পরমহংসের উপদেশামৃত মেনে পাঁকের মধ্যে পাঁকাল মাছের মতো। চারপাশে পচা দুর্গন্ধময় পাঁক-কাদা, তার ভেতর নিজের শরীরে এক ফোঁটা অপবিত্র কিছু না লাগিয়ে তাঁর বসবাস। আশপাশের টেবিলের তলা দিয়ে যখন মোটা মোটা খাম চালান হয় তখন কখনো-সখনো উদ্গত দীর্ঘশ্বাস চেপে চিররুগ্না স্ত্রী, আইবুড়ো মেয়ে আর বেকার ছেলেটার কথা ভাবতে বসেন তিনি। এবং তারপর একদিন পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে না পেরে নিজের স্ফটিকস্বচ্ছ বিবেকটাকে নিজের হাতে জবাই করে তিনিও টেবিলের তলা দিয়ে বাঁ হাতে স্ফীতোদর খাম গ্রহণ করতে শুরু করলেন।
৪. অভিজ্ঞতার আলোকে ওপরে যে দুটো কাল্পনিক দৃশ্যপট তুলে ধরলাম, মোটামুটি এই হচ্ছে সরকারি অফিস-আদালতের বর্তমান চিত্র। ঘুষ খাওয়া, প্রকল্পের টাকা মেরে দেওয়া, স্বজনপ্রীতি, সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি, এমনকি উৎকাচের বিনিময়ে মামলার রায় পাল্টে দেওয়া ইত্যাদি অপকর্ম সব সময়ই অল্পবিস্তর ছিল। এমন নয় যে দুর্নীতি আগের কোনো জমানায় ছিল না, এগুলো হাল আমলের আমদানি। দুর্নীতি সব সময়ই ছিল, বিশেষ করে সরকারি অফিস-আদালতে। তবে এখনকার মতো মাত্রাতিরিক্ত ছিল না। আগে হয়তো শতকরা ২০ জন দুর্নীতিবাজ ছিলেন একটি অফিসে, বাকি ৮০ জন ছিলেন দুর্নীতিমুক্ত, সৎ। এখন নাকি তা হয়ে গেছে উল্টো। ২০ জন সৎ, দুর্নীতিমুক্ত, আর ৮০ জন রক্তচোষা জোঁক। অথচ ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি আমল বা বাংলাদেশের প্রথম তিন-চার দশকের তুলনায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি বেড়েছে অনেক গুণ। বিশেষ করে কর্মকর্তাদের। তাঁদের এমন সব ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় এখন যা এই এক যুগ আগেও ছিল অচিন্তনীয়। একজন সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে তাঁর সেরা সেবাটা পেতে হলে অবশ্যই তাঁকে ‘ওয়েল ফেড, ওয়েল ক্ল্যাড’ রাখতে হবে। কথায় আছে না, পেটে খেলে পিঠে সয়। অতএব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারিতোষিক বৃদ্ধিতে ঈর্ষান্বিত হওয়ার কিছু নেই। তবে হিসাব মিলতে চায় না যখন দেখা যায় পাঁচ-ছয় গুণ বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পরও অনেকেই (শোনা যায়, সংখ্যাটি ভয়াবহ না হলেও রীতিমতো শঙ্কিত হওয়ার মতো) যেন রবীন্দ্রনাথের ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি’ এই আপ্তবাক্যের যথার্থতা প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর। শীর্ষ পর্যায়ের ‘বসদের’ পদাঙ্ক অনুসরণ করে অন্যরাও তৎপর হয়ে ওঠেন টু-পাইস কামাতে। ভাবটা এমন, সুযোগ যখন পাওয়া গেছে তখন এসো সবাই মিলে তার সদ্ব্যবহার করি। রোদ থাকতে থাকতে খড় শুকাই। আর দুর্নীতি ফুলে-ফেঁপে বেড়ে ওঠে তখনই যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা থাকেন তাঁরা বিষয়টিকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখেন না। আর স্লোগানের মতো কিছু তেজোদীপ্ত কথা (যেমন—‘জিরো টলারেন্স’। আমার মনে হয়, কথাটা এখন ‘ক্লিশে’ হয়ে গেছে। ) মুহুর্মুহু উচ্চারণ করে কিংবা রুই-কাতলাদের বাদ দিয়ে শুধু চুনোপুঁটিদের দিয়ে নাশতা করলে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে না। দুর্নীতি দমনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। ‘কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়’ হতে হবে। বাংলাদেশে কি বড় বড় দুর্নীতিবাজ নেই? নিশ্চয়ই আছে। দল-মত-নির্বিশেষে বছরে তাঁদের দুই-চারটাকে ধরে শাস্তির ব্যবস্থা করুন, তাঁদের দেশ ও জাতির শত্রু হিসেবে ঘোষণা দিন, সামাজিকভাবে বয়কট করুন, দেখবেন অভাবনীয় ফল পেয়ে গেছেন। আর কোনোভাবেই যেন এটা প্রতীয়মান না হয় যে কর্তৃপক্ষ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন না করে উল্টোটা করছে।
কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তাদের পদোন্নতির তালিকা বানানো হচ্ছে। দেখা গেল, যাঁরা কলুর বলদের মতো সারাজীবন চোখ-মুখ-কান বুজে আইন-কানুন-ন্যায়নীতি মেনে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের বাদ দিয়ে তেলবাজ-ধান্দাবাজ ঘুষখোরগুলোর নাম উঠছে তালিকায়। কারণ কাজে-কর্মে লবডঙ্কা হলেও তাঁরা নিজের জন্য ও বসের জন্য ফান্ড কালেকশনে সদা সর্বদা জান কুরবান। আমার দুঃখ, এসব দুষ্ট গরু গোয়ালের অন্য নিরীহ সুবোধ গরুদের স্বভাব-চরিত্র খারাপ করছেন। তাঁরাও একসময় জোয়াল কাঁধে নিতে, হাল টানতে কাঁই-কুঁই করে, দোহনের সময় তাঁদের স্ত্রীজাতীয় প্রাণীরা গৃহস্থকে অহেতুক লাথি-গুঁতো মারেন। তাঁরা হচ্ছেন বস্তার সেই একটি পচা আলুর মতো, যার সংস্পর্শে এসে বাকি সব সু্স্থ-সবল আলু পচতে শুরু করে। অফিস-আদালতে কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ব হচ্ছে এই সব পচা আলুগুলোকে দ্রুত চিহ্নিত করে নর্দমায় ফেলে দেওয়া। তা না করে ‘ওর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না, ও আমাদের লোক’ কিংবা ‘ও তো খুবই কাজের লোক, প্রতি মাসে আমাদের সংগঠনের তহবিলে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা সে-ই তো দেয়, ওর মতো ইফেক্টিভ স্টাফ কজন আছে’–এ ধরনের মনোভাব পোষণ করলে, খোদা না খাস্তা, পদ্মা সেতু আর মেট্রো রেল ধসে পড়তে বেশিদিন লাগবে না।
সেই ব্রিটিশ আমল থেকে প্রশাসনে ‘সিস্টেম অব রিওয়ার্ড অ্যান্ড পানিশমেন্ট’—ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য তিরস্কার প্রথা চলে আসছে। এখন অবশ্য পুরস্কার-তিরস্কার প্রদান কাজের গুণাগুণ বিচার করে হয় না। এখন ওগুলো অন্যান্য পার্থিব-অপার্থিব ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে। যেমন—প্রথমেই দেখা হয় তিনি ‘আমাদের লোক’ কি না। তা ছাড়া বড় সাহেবের পেয়ারের বান্দা হলে তাঁর কাবিরা-সাগিরা অনেক গুনাহ মাপ। তেমনি তিনি যদি আমাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ ‘আর্নিং মেম্বার’ বা ফুট ফরমাশ (প্রধানত বেগম সাহেবাদের) খাটা লোক হন, তাহলে তো আর কথাই নেই, তখন তাঁর সাত নয়, সাত দুগুণে চৌদ্দ খুন মাপ। …হায়! এসব গ্যাঁড়াকলের মধ্যে পড়ে রিওয়ার্ড অ্যান্ড পানিশমেন্টের পুরনো সালসা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এখন সব কিছু কেমন কমার্শিয়ালাইজ হয়ে গেছে। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। সবখানেই ঢুকে পড়েছে বাজার অর্থনীতি।
৫. আজকে মূলত ডেমনস্ট্রেশন ইফেক্ট বা প্রদর্শনের প্রভাব নিয়ে কথা বলব ভেবেছিলাম। সেখান থেকে প্রাসঙ্গিক অন্য কিছু কথা এসে গেছে। বকাউল্লাদের যা হয় আর কি! একবার মুখ ছুটলে তাতে লাগাম না দেওয়া পর্যন্ত থামাথামি নেই। তবে এ কথা ঠিক সরকারি চাকরি—আর শুধু সরকারিই বা বলি কেন, সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, সবখানে এই বিনাশ্রমে কোটিপতি বনে যাওয়া মানুষগুলোর ফুটানি আর জেল্লার চোটে নিরীহ ছা-পোষা মানুষদের সমাজে টিকে থাকাই দায় হয়ে উঠেছে। বউ প্রতিবেশী ভাবির জড়োয়া গয়না দেখে এসে বাড়িতে অনশন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে, ছেলে তার সহপাঠীর দামি মুঠোফোন দেখে, মেয়ে তার বান্ধবীর মেড-ইন জাপান ল্যাপটপ দেখে বাড়িতে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দেওয়ার ঘটনা আজকাল আকছারই ঘটছে। আর চিরকাল সৎপথে চলে অভ্যস্ত মানুষটারও হচ্ছে পদস্খলন। কাঁহাতক আর অন্তরিত হয়ে থাকা যায়। যে ব্যবসায়ী চিরকাল সৎপথে থেকে ব্যবসা করে আসছেন তাঁরও মনে আক্ষেপ জাগতে পারে, যখন তিনি দেখেন চারপাশে সবাই রমজান মাসে বাজার থেকে এটা-ওটা উধাও করে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে মাল ছেড়ে কাঁড়ি কাঁড়ি কাঁচা পয়সা লুটে নিচ্ছেন। তারপর পরবর্তী ঈদে তিনি আর ‘বোকামি’ না করে চালটা, তেলটা, পেঁয়াজটা বাজার থেকে গায়েব করে দেন। ‘ও করতে পারলে তুমি পারবে না কেন’ অহর্নিশ গিন্নির কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠে এই অনুযোগ শুনতে শুনতে তিনি একসময় ঝাঁকের কৈ ঝাঁকে মিশে যান।
৬. ুদুই মন্ত্রীর গল্প দিয়ে আজকের বকবকানি শেষ করি। না, না, ঘাবড়াবেন না, আমাদের দেশের মন্ত্রী না। (‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি’। ) কাহিনি দক্ষিণ আমেরিকার দুই বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশের দুই মন্ত্রীকে নিয়ে। হিজ এক্সেলেন্সি পূর্তমন্ত্রী ‘ক’ প্রতিবেশী বন্ধু পূর্তমন্ত্রী হিজ এক্সেলেন্সি ‘খ’-এর আমন্ত্রণে সফরে গেছেন বন্ধুর দেশে। হোস্ট মন্ত্রীর বাড়ি দেখে গেস্ট মন্ত্রীর তো চক্ষু ছানাবড়া। তিনি জানতে চাইলেন, ‘দোস্ত, এটা আপনার নিজের বাড়ি?’ হোস্ট সলাজ হাসি হেসে বললেন, ‘জি। এটা গরিবের নিজের বসতবাটি বটে। ’ ‘বলেন কি সাহেব’, গেস্টের কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময়। ‘যত দূর জানি, আপনি মন্ত্রী হয়েছেন বছর চারেক হলো। এর আগে তো আপনি ছিলেন স্কুল মাস্টার। তাহলে কখন, কিভাবে…। ’ হোস্ট বললেন, ‘জানতে চান? তাহলে আসুন আমার সঙ্গে। ’ এই বলে বন্ধুর হাত ধরে তাঁকে নিয়ে গেলেন বাড়ির ছাদে। ওখান থেকে দূরে শহরের এক প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলা নদী (মনে করুন, আমাদের বুড়িগঙ্গার মতো) দেখিয়ে বললেন, ‘কী দেখছেন, বন্ধু’? বন্ধু বললেন, ‘একটা বিশাল নদী। ’ ‘আর কিছু না?’ ‘জি, নদীর বুকে অনেক নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার ইত্যাদি দেখছি। ’ মেজবান বললেন, ‘আর কিছু?’ ভালো করে তাকিয়ে গেস্ট বললেন, ‘হাঁ, একটা বিশাল সেতু দেখতে পাচ্ছি নদীর ওপর। ’ হোস্ট একটা উচ্চাঙ্গের হাসি দিয়ে বললেন, ‘টেন পারসেন্ট। হা হা হা। ’
এর পরের বছর মি. টেন পারসেন্ট প্রতিবেশী বন্ধুর দাওয়াতে রিটার্ন ভিজিটে গেছেন প্রতিবেশী দেশে। প্রতিবেশী মন্ত্রীর বাড়ি দেখে এবার তাঁর মুখ খোলা ডাকবাক্সের মতো হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘কী ভাই, মাত্র, দুবছর আগে মন্ত্রী হয়েছেন। তার আগে তো ছিলেন মফস্বলের সাংবাদিক। এরই মধ্যে এই প্রাসাদের মতো বাড়ি, বিশাল বাগান, এত দামি দামি আসবাবপত্র! ঘটনা কী?’ হোস্ট তাঁর মেহমানকে বললেন, ‘চলুন ছাদে যাই। ওখানে গিয়ে বুঝিয়ে বলব। ’ ছাদে গিয়ে হোস্ট বললেন গেস্টকে, ‘সীমানাপ্রাচীরের বাইরে দূরে তাকান। কী দেখছেন?’ গেস্ট বললেন, ‘দেখছি বিশাল এক নদী। তার ওপর চলছে অনেক নৌযান। ’ ‘আর কিছু?’ জানতে চান মেজবান। ভালো করে দেখেটেখে মেহমান বললেন, ‘কই আর কিছু তো দেখছি না। ’ ‘একটা ব্রিজ দেখতে পাচ্ছেন না নদীর ওপর?’ জানতে চান মেজবান। ‘কই না তো। ’ জবাব দেন মেহমান। ‘হান্ড্রেড পারসেন্ট’, দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, হোস্ট হিজ এক্সেলেন্সি ‘ক’।
এখন বুঝলেন তো ‘ডেমনস্ট্রেশন ইফেক্ট’ কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী। একেবারে উদাহরণসহ বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি। ঠিক কিনা?
লেখক : সাবেক সচিব, কবি