মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থের বিরোধ, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) জোরালো পদক্ষেপের অভাব এবং সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ পক্ষপাতিত্বের কারণে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ক্রমে এখন উবে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আরব ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের সুপরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য নির্ধারিত ভূমি গ্রাস, বেআইনিভাবে বসতি বিস্তার, এমনকি জাতিবিদ্বেষমূলক আচরণের জন্য তাদের কোথাও জবাবদিহি করতে হয় না। তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসহ (আইসিসি) জাতিসংঘ পর্যন্ত কারোরই তোয়াক্কা করে না। কারণ তাদের পেছনে রয়েছে বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন, সে কারণেই বিভিন্ন অজুহাতে ইসরায়েলের সব অনৈতিক ও বেআইনি কার্যকলাপ পার পেয়ে যায় ‘দায়মুক্তির’ বিভিন্ন শয়তানি অপকৌশলে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বারবার শুধু একটি বুলিই আওড়ে চলেছে, আর তা হচ্ছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের প্রতিরক্ষা কিংবা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পূর্ণ অধিকার রয়েছে এই ইহুদিবাদী দেশটির।
বিশিষ্ট ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও আলজাজিরার প্রতিনিধি শিরীন আবু আকলেহ ফিলিস্তিনের জেনিন শরণার্থীশিবিরের একটি সাম্প্রতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে কর্তব্যরত সাংবাদিকের প্রতিরক্ষা পোশাক পরিহিত অবস্থায় গুলিতে নিহত হয়েছেন। সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েল প্রথমে বলেছে, এ কাজ তাদের নয়, ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসীদের। তাঁকে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত যখন বিভিন্ন মহল প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে, তখন ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ একটি তদন্তের কথা প্রকাশ করেছে। কিন্তু কেউ চায় না ইহুদিবাদীদের একচোখা তদন্ত। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসসহ সবাই চান এ ব্যাপারে একটি আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ তদন্ত। তাঁরা এর তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে দুই সপ্তাহ চলে গেলেও জেরুজালেমের বীরকন্যা শিরীন হত্যার কোনো তদন্ত এখনো শুরু হয়নি। শিরীন আবু আকলেহ একজন ফিলিস্তিনি প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান। একজন বস্তুনিষ্ঠ, সৎ ও সাহসী সাংবাদিক হিসেবে তিনি দুই দশক ধরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ দখলদার ইহুদিবাদী ইসরায়েলিদের অন্যায় ও অবৈধ কার্যকলাপের তথ্য বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরছিলেন। এর আগে আগ্রাসী ও সম্প্রসারণবাদী ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের হাতে আরো ২০ জন কর্তব্যরত সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের হত্যার কোনো সুষ্ঠু তদন্ত কিংবা বিচার হয়নি। সেসব ঘটনাকে বিংশ কিংবা একবিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত জঘন্য হত্যাকাণ্ড এবং কলঙ্কজনক অধ্যায় বলে উল্লেখ করা হলেও আজ পর্যন্ত তার কোনো আইনি ফায়সালা হয়নি। আগ্রাসী ইহুদিবাদীরা বারবার দায়মুক্তির সনদ পেয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় ইসরায়েলের হাইকোর্টের একটি রায় বিশ্বব্যাপী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষকে অত্যন্ত হতবাক করেছে। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের মাসাফির ইয়াত্তা নামক ইসরায়েলের একটি দখলকৃত এলাকার ঘরবাড়ি থেকে ৫০০ শিশুসহ এক হাজার ২০০ ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করে সেই ভূমি ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীকে প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে এ বিষয়টি একটি যুদ্ধাপরাধ বলে বিবেচিত হচ্ছে। জাতিসংঘের আইনজীবীদের মতে, কোনো দখলদার শক্তি স্থানীয় অবরুদ্ধ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে সেই ভূমি ব্যবহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইন কিংবা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সেটি একটি যুদ্ধাপরাধ। দখলকৃত ভূমি থেকে স্থানীয় মানুষকে উচ্ছেদ করে নিজেদের (ইহুদি) নাগরিকদের জন্য বসতি স্থাপনও বেআইনি। এটিও একটি অমার্জনীয় অপরাধ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা তা ভালো করেই জানেন। তবু এ ব্যাপারে ইসরায়েলকে বাধা দেওয়ার মতো ক্ষমতা তাঁরা দেখাচ্ছেন না, বরং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আল-কুদস নামে পরিচিত পূর্ব জেরুজালেম, এমনকি সিরিয়ার গোলান হাইটসসহ আরবদের ভূমিতে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সম্মতি দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী দেশগুলোর প্রত্যক্ষ সমর্থনে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের আরব ভূখণ্ডে ইসরায়েল নামে একটি ইহুদিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইহুদিবাদী সেনাবাহিনী অতর্কিতে হামলা করে ৭৮ শতাংশ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে নেয়। এরপর ১৯৬৭ সালে আবার একতরফা যুদ্ধে ইসরায়েল সম্পূর্ণ ফিলিস্তিন অঞ্চল দখল করে নেয়। তখন তারা (ইহুদি) তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি আরবকে তাদের নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করেছে। সেসব ফিলিস্তিনি এখন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রে শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সেখানেই থেমে ছিল না দখলদার ইহুদি সেনারা। তারা ইহুদিদের নতুন বসতি গড়ে তোলা কিংবা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন সময়ে আরো তিন লাখ ফিলিস্তিনিকে শুধু বাস্তুচ্যুত নয়, দেশছাড়া করেছে। সম্প্রসারণবাদী ইহুদি সরকারের গোপন পরিকল্পনা হচ্ছে, ক্রমে পুরো পশ্চিম তীর কিংবা বৃহত্তরভাবে সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসতি বিস্তার করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য নির্ধারিত জায়গাটি কবজা করে নেওয়া। তাতে কোথায় প্রতিষ্ঠিত হবে প্রস্তাবিত ‘দুই রাষ্ট্র’ ভিত্তিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন? কোথায় স্থাপিত হবে ফিলিস্তিনি অফিস-আদালত কিংবা শিল্প-কারখানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান? কিভাবে স্বাধীন স্বদেশে ফিরে আসবে দেশ থেকে বহিষ্কৃত ফিলিস্তিনি বাসিন্দারা? এ পরিস্থিতি সামনে রেখে কী করছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, জর্দান কিংবা এমনকি তুরস্ক? সামরিক কিংবা অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এখন ইহুদিবাদী ইসরায়েলের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সখ্য গড়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফিলিস্তিনের মুক্তিপাগল অবরুদ্ধ মানুষের কথা কতটুকু মনে পড়ছে তাদের? এ ধরনের শত শত প্রশ্নের সম্মুখীন এখন ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ, তাদের অস্তিত্ব। তাই প্রশ্ন উঠেছে আরব জাতীয়তাবাদ কিংবা ইসলামিক আদর্শ নিয়ে। ইহুদিবাদী ইসরায়েলের পক্ষ হয়ে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে বিভিন্ন চাপের মুখে ফিলিস্তিন ইস্যুটি সম্পূর্ণভাবে ভুলিয়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম ইরান।
নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখা কিংবা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বিভিন্ন রাষ্ট্র তার হস্ত সম্প্রসারিত করে শত্রুশিবিরে, অবিশ্বাস্যভাবে। যেমন—বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জ্বালানিসংকট মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য চাচ্ছে ইরান কিংবা ভেনিজুয়েলার কাছে। ভারত নিজের স্বার্থের প্রশ্নে রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানিসংকট মোকাবেলায় তৎপর হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ নয়। পাকিস্তান চীনের পক্ষপুট থেকে বেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আনুকূল্য পাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে ভিন্ন পথে। কারণ তার বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাহায্য প্রয়োজন। এ অবস্থায় গত ঈদুল ফিতর উপলক্ষে হোয়াইট হাউসে এক পার্টির আয়োজন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেই পার্টিতে জো বাইডেন ইসলামের অনেক গুণগান করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের অবদানের কিছু কথাও তুলে ধরেছেন। বলেছেন, বিশ্বে আজ মুসলিমরা বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। কিন্তু ইহুদিবাদী ইসরায়েলের হাতে ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে একটি কথাও বলেননি। জো বাইডেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একজন নির্ভরযোগ্য প্রতিভূ এবং প্রাজ্ঞ রাজনীতিক। ইহুদিবাদী ইসরায়েলিদের হাতছাড়া করা চলবে না তাঁর। কারণ ইহুদিরাই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অর্থনীতি চালায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। অসামান্য প্রতিভা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী তারা। তাদের ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী বিশ্ব, সমরনায়ক, অস্ত্র ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের দৃষ্টি এখন নতুন খাতে প্রবাহিত করেছে। পশ্চিমা ক্ষয়িষ্ণু আধিপত্যবাদের এ দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় তাদের এখন চাই নতুন মিত্র, সহযোগী শক্তি এবং অবলম্বন। জাতিসংঘের পর ৫৭ সদস্যবিশিষ্ট বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান ওআইসির সব মুসলিম সদস্য দেশেরই এখন সার্বিক সমর্থন প্রয়োজন জো বাইডেনের। তিনি এখন নতুনভাবে জোট বাঁধতে চান তাদের সঙ্গে। ‘তোমাদের কী প্রয়োজন চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে? এসো আমরা এক হয়ে কাজ করি। ’—বাইডেনের এমন মনোভাবের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী ও আধিপত্যবাদীদের চরিত্রের কথা।
ফিলিস্তিনের আরব ভূখণ্ড বিপর্যস্ত ও ধ্বংস করে ১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তির সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যে গঠিত হয়েছিল ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। সেই থেকে প্রতিবছর ১৫ মে ফিলিস্তিনিরা এই দিবসটিকে ‘আল নাকবা’ বা বিপর্যয়ের দিন হিসেবে পালন করে থাকে। সে উপলক্ষে কংগ্রেস উওম্যান, ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত রাশেদা তালেব, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে এই দিনটির স্বীকৃতির জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। এ প্রস্তাবে তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন ডেমোক্রেটিক দলীয় সদস্য বেটি ম্যাককালাম, বেরি নিউম্যান, ইলহাম ওমর ও আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিয়া কর্টেজ। ইহুদি প্রভাবাধীন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে সে প্রস্তাব পাস হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসেও এখন ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে কথা বলার লোক তৈরি হয়েছে। ইহুদিবাদী ইসরায়েলের স্বার্থের প্রশ্নে অন্ধ না হয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাও যুক্তরাষ্ট্রকে এখনই ভাবতে হবে। নতুবা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সভ্যতা বিপন্ন হবে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ‘প্যালেস্টাইন—এক সংগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রণেতা