ডলারের শক্তির ওপর কেন্দ্রীভ‚ত মার্কিন ডলার সূচকটি বর্তমানে এমন মাত্রায় অবস্থান করছে, যা দুই দশকেও দেখা যায়নি। সম্প্রতি সূচকটি ১০৪-এর উপরে স্পর্শ করেছে। গত সপ্তাহে এটি ২০২২ সালের হিসাবে প্রায় ১০% বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে এবং উঢণ সূচকে ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে। এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ইতোমধ্যে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর আমদানি মূল্যকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং উদ্ভূত সমস্যা বিশ্ব-অর্থনীতিকেও একধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।
ডলারের উচ্চমূল্য বিশ্ব-অর্থনীতির গুটিকয়েক দেশে কিছুটা সামঞ্জস্য আনতে পারলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলো অতিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর রফতানি বাড়াতে এটি হয়তো কিছুটা সাহায্য করবে এবং আমদানির খরচ কমিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু কিছু দেশে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানতে সহায়ক হবে। কিন্তু মোটা দাগে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ডলারের দ্রুত মূল্যবৃদ্ধি করোনা-পরবর্তী বিশ্ব-অর্থনীতিতে যে দেশগুলো ইতোমধ্যে কিছুটা উন্নতি করেছিল তাদের এবং বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর বর্তমান অস্থিতিশীল আর্থিক বাজারকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। ঝুঁকিগুলো বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য খুবই তীব্র হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে যেসব দেশ ইতোমধ্যে জ্বালানিসহ খাদ্য এবং ঋণের সমস্যা নিয়ে সঙ্কট মোকাবেলা করছে তাদের জন্য আরো ভয়াবহ হতে পারে। ডলারের উচ্চমূল্য বেশির ভাগ দেশের আমদানি মূল্যকে আরো অধিক হারে ব্যয়বহুল করাসহ বাহ্যিক ঋণ পরিষেবা এবং আর্থিক অস্থিতিশীলতাকে আরো বৃহত্তর ঝুঁকিতে নিয়ে যাবে।
বিশেষ করে এ ধরনের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এমন দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করবে যারা ইতোমধ্যে করোনাকালীন বিপর্যয় থেকে লড়াই করে মাত্র কিছুটা সামলে উঠেছিল। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং আলিয়াঞ্জ-এর প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মোহাম্মদ এল-এরিয়ান বিশ্বকে সতর্ক করে বলেছেন যে, ডলারের ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী শক্তি আগুনে তেল দেয়ার মতো অবস্থা তৈরি করতে পারে যাকে তিনি “ষরঃঃষব ভরৎবং বাবৎুযিবৎব ংুহফৎড়সব,” বলে অভিহিত করেছেন। এই ঊর্ধ্বগতি অর্থনৈতিক ও আর্থিক অস্থিতিশীলতাকে বহুগুণে ত্বরান্বিত করতে পারে এবং এটি বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে দিয়ে ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়ানোসহ সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভ‚-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে বিপজ্জনক মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে। তিনি আরো বলেছেন যে, The spillbacks to the advanced economies are potentially more problematic than any direct effect on them of dollar appreciation,”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই জাতীয় অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান স্থবিরতা বাহ্যিক প্রবৃদ্ধির নিয়ামকগুলোকে দুর্বল করার পাশাপাশি চলমান আর্থিক বাজারে চরম অস্থিরতা তৈরি করবে; বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলো যারা ইতোমধ্যে একাধিক ঝুঁকি নিয়ে বহুমাত্রিক আর্থিক অস্থিরতা মোকাবেলা করছে। শ্রীলঙ্কার উদাহরণ আমাদেরকে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মার্কিন ডলার সূচকটি সাধারণত ইউরো, জাপানিজ ইয়েন, ব্রিটিশ পাউন্ড, কানাডিয়ান ডলার, সুইডিশ ক্রোন এবং সুইস ফ্রাঙ্কের বিপরীতে “এৎববহনধপশ” কার্যক্রম অনুসরণ করে চলে। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদদের ধারণা, তিনটি কারণ উঢণ সূচকটিকে ২০ বছরের সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে এসেছে। প্রথমত, মনে করা হচ্ছে যে, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অগ্রসর অর্থনীতিতে অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর তুলনায় আরো আক্রমণাত্মকভাবে সুদের হার বাড়াবে। দ্বিতীয়ত, পুঁজিকে সমৃদ্ধ এবং আকৃষ্ট করে এমন মার্কিন অর্থনীতির লোভনীয় পারফরম্যান্স এবং তৃতীয়ত, মার্কিন আর্থিক বাজারের আপেক্ষিক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা।
আমি মনে করি, ডলারের মূল্য খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বা এর দ্রুত বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো বা ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করে অর্থনৈতিক এবং পলিসিগত সংস্কারের মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতার লাগাম টেনে ধরতে না পারলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি খুব দ্রুত আরো অবনতির দিকে ধাবিত হবে।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান
ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (আইএফআইএল)