বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা ফেরাতে এবার ডলারের একক দাম বেঁধে দিল বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ দাম হবে ৮৯ টাকা। এর মাধ্যমে আরেক দফা কমানো হলো টাকার মান, প্রায় ১ টাকা ১০ পয়সা। প্রবাসী আয় আহরণ ও রপ্তানিকারকদের বিল নগদায়নের ক্ষেত্রে এ হার অনুসরণ করবে ব্যাংকগুলো। আর আমদানিকারকদের কাছে এই দামের চেয়ে ১৫ পয়সা বেশি যোগ করে ডলার বিক্রির সুযোগ পাবে তারা।
অর্থাৎ এখন থেকে বিলস ফর কালেকশন (বিসি) রেট হবে ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা। বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) প্রস্তাব পর্যালোচনা করে গতকাল এই রেট নির্ধারণ করা হয়েছে। এ রেট আজ সোমবার থেকে কার্যকর হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলারের একক দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার এই সিদ্ধান্তকে যুগান্তকারী ও ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের চলমান অস্থিরতা ঠেকাতে ফলপ্রসূ হবে। কারণ ডলারের দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করায় হুন্ডি কমে বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়বে। গতি ফিরবে রপ্তানি আয়েও। আমদানি নিরুৎসাহিত হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ কমবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আন্তঃব্যাংক মদ্রাবাজারে প্রতি ডলারে ৮৯ টাকা এবং বিসি সেলিং রেট ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই দুই রেটের সমন্বয় করে এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো ডলার বিক্রি করবে। তিনি আরও বলেন, এরপরও কোনো ব্যাংক ডলারের দাম বাড়াকে অসম প্রতিযোগিতা করছে কিনা, সেটাও নজরদারিতে রাখা হবে।
সাধারণত স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা লাভবান হন। কারণ আগের তুলনায় ডলারের বিপরীতে বেশি হারে টাকা পাওয়া যায়। আবার মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কারণ রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে এবং আমদানি কমলে সামগ্রিক চাহিদা বাড়ে। আর সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির প্রভাবে প্রকৃত জিডিপি ও মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা থাকে। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি বেশ খানিকটা বেড়েও গেছে। তবে নতুন করে টাকার অবমূল্যায়নে মূল্যস্ফীতিতে তেমন প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ বাজারের ঊর্ধ্বগতি রেটের অনেক নিচে ডলারের একক দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ডলারের দামে একক রেট নির্ধারণ করে দেওয়াটা কোনো সমাধান নয়। কিছুদিন পর হয়তো আরেকটা রেট নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে এ রেট নির্ধারণ করা হলো। অবশ্যই ডলারের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে নয়। আমি মনে করি, হার ঠিক করে দেওয়াটাকে কোনো সমাধান হতে পারে না। এর পরিবর্তে দেখা দরকার ছিল ডলারের চাহিদা কেন বেশি হলো। একক দাম ডলারের বাজারে অস্থিরতা কমাতে সহায়ক হবে কিনা হবে সে বিষয় এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই গভর্নর।
বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা ঠেকাতে বেশকিছু দিন ধরেই টাকার অবমূল্যায়ন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল অবমূল্যায়নের মধ্য দিয়ে চলতি মাসে চতুর্থ দফায় টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ানো হলো। এর আগে গত ২৩ মে ডলারের বিপরীতে টাকার দর ৪০ পয়সা বাড়িয়ে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে নির্ধারণ করা হয় ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা, যা গতকাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। যদিও ব্যাংকগুলোই এ দামের চেয়ে ৭ থেকে ৮ টাকা বেশি দামে তথা ৯৫ থেকে ৯৭ টাকায় ডলার বিক্রি করে আসছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তার আগে ৯ মে ডলারের বিনিময় মূল্য ২৫ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। তারও আগে এ বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘বাফেদা ও এবিবির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের একক দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই নির্ধারিত দরে ডলার বেচাকেনা হলে পরিস্থিতি ভালো হবে। তিনি বলেন, ‘কোভিডপরবর্তী অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু নতুন করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পৃথিবীব্যাপী অস্থিরতা চলছে। তবে এটা কেটে যাবে। ডলারের বাজারও স্বাভাবিক হবে।
ডলারের বাজারে অস্থিরতা কাটাতে গত ১৯ মে বাফেদার পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি পাঠানো হয়। বাফেদার প্রস্তাবের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এবিবির নেতাদের বাফেদার মধ্যে গত ২৫ মে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রবিবার বাফেদার পক্ষ থেকে ডলারের দামের একটি প্রস্তাব করার পর সেটি পর্যালোচনা করে একক দাম নির্ধারণ করার করার কথা ছিল। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এর আগে রবিবার সকালে বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান এবং এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের সিইও সেলিম আরএফ হোসেন স্বাক্ষরিত পাঠানে এক চিঠিতে ডলারের রেট নির্ধারণে প্রস্তাব করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো তাদের প্রস্তাবে টাকা ও ডলারের আন্তঃব্যাংক বিনিমর হার ৮৯ দশমিক ৮০ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। আমদানিকারকদের জন্য ডলারের বিক্রির মূল্য নির্ধারণে প্রস্তাব করা হয় ৮৯ টাকা ৯৫ পয়সা। এ ছাড়া রপ্তানি বিল নগদায়নে ৮৮ দশমিক ৯৫ টাকা এবং প্রবাসী আয় আহরণ তথা এক্সচেঞ্জ হাউসের জন্য ৮৯ টাকা ৭৫ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছিল।
এর আগে গত ১৯ মে ডলারের বাজারে অস্থিরতা নিরসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দিয়ে চিঠি পাঠায় বাফেদা। সংগঠনটির প্রস্তাবের মধ্যে অন্যতম ছিল বৈধভাবে পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রণোদনা আড়াই শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে পাঁচ শতাংশ করা, বাজারের চাহিদা বিবেচনা করে ডলার সরবরাহ করা, বাজারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণসাপেক্ষে ডলার ক্রয়-বিক্রয়ে আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার পুনর্নির্ধারণ। আর সব অনুমোদিত ডিলার (এডি) ব্যাংক বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো থেকে ‘একক বিনিময় হারে’ লেনদেন এবং সেই হার আন্তঃব্যাংকের মধ্যে লেনদেনের থেকে কমপক্ষে শূন্য দশমিক ১ শতাংশের কম হবে। এই একক বিনিময় হার কঠোরভাবে তদারকি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাফেদার প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছিল, এডি ব্যাংকগুলো রপ্তানির ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী কর্তন মূল্যের সুযোগ নিশ্চিত এবং রপ্তানির কাগজপত্র যাচাই করবে। এ ছাড়া একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানির এলসি বিল ও সরকারি বাধ্যতামূলক পাওনা পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার বাড়তি চাহিদার তারল্য সরবরাহ করবে। আর রাষ্ট্রায়ত্ত এডি ব্যাংকগুলো নিজস্ব উৎস থেকে কেবল সরকারের বাণিজ্য ও বাধ্যতামূলক পাওনা বড়জোর তিন মাসের জন্য পরিশোধ করবে। তবে এসব ব্যাংক সরকারের আন্তঃব্যাংক বাজার পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার উৎস হিসেবে ব্যবহার হবে না।
করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য ক্রমেই বেড়ে চলছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে জাহাজ ভাড়াও। এর ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে পণ্য আমদানি বেড়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। একই সময়ে বিভিন্ন পণ্যের এলসি বেড়েছে প্রায় ৪৬ শতাংশ। ফলে আমদানিতে ডলারের চাহিদা বেশ বেড়েছে। কিন্তু ব্যাংকের কাছে ডলার আসার উৎস রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। এর চাপ গিয়ে পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, এখন রিজার্ভ রয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। এই রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তবে ডলারের এত সংকটের পরও প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই মুদ্রার মান তুলনামূলক কম অবমূল্যায়ন করেছে।