সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৮ অপরাহ্ন

হজ ফরজ হওয়ার কারণ

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১২ জুন, ২০২২
  • ১১৫ বার

নামাজ, রোজা ও জাকাত ইসলামের আবশ্যিক স্তম্ভ হলেও সেগুলোতে হজের মতো জটিলতা নেই। প্রচুর অর্থ ব্যয় ও শারীরিক কষ্টের মাধ্যমে আদায় করতে হয় হজ। থাকা-খাওয়া, সফরের ক্লান্তি, অঘুম, প্রচণ্ড শীত-গরমের নানামুখী সমস্যা সহ্য করে আঞ্জাম দিতে হয় হজের যাবতীয় কাজ। গায়ে সেলাইবিহীন সাদা কাপড়। মুখে ‘লাব্বাইক’ ধ্বনি। কাবাঘর তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ায় সায়ী করতে হয়। মীনায় শয়তানকে লক্ষ্য করে প্রতীকী পাথর নিপেক্ষ, মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে শুয়ে রাত যাপন, কোরবানি, মাথা মুন্ডানোসহ আরো কিছু কাজ করতে হয়। প্রশ্ন জাগতে পারে, এ সবের কী দরকার ছিল? নামাজ, রোজা বা জাকাত কি শারীরিক ও আর্থিক ইবাদতের জন্য যথেষ্ট ছিল না? বান্দার এ কষ্টে রবের কী এমন তুষ্টি বা হেকমত নিহিত আছে যার জন্য তিনি হজের মতো কঠিন বিধান জারি করলেন?

অনেকে মনে করেন হজ না করে টাকা পয়সা গরিব মিসকিনদের দান করে দিলেও হজের চেয়ে বেশি পুণ্য মিলবে। নাউজুবিল্লাহ! এসব কথা শয়তান নেক সুরতে মানুষের মনে ঢেলে দেয়। দৃশ্যত কথাটা সুন্দর ও মানবিক হলেও প্রকারান্তরে হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধানকে অস্বীকারের নামান্তর।

মূলত হজ বা বায়তুল্লাহর জিয়ারতে গূঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে। ব্যক্তি চরিত্রের সংস্কার ও উন্নয়ন ছাড়া আদর্শ মানব হওয়া কঠিন। কোনো জীবনকে উন্নত করতে হলে সৎ, সাহসী ও জীবন্ত কোনো আদর্শের কাছে নিজেকে নিয়ে যেতে হয়। মহৎ ব্যক্তিবর্গের কীর্তি, রেখে যাওয়া স্মৃতি-চিহ্ন কাছ থেকে দেখতে হয়।

কোথায়, কখন কিভাবে তারা মহত্বের স্বাক্ষর রেখে অমর হয়ে আছেন তা অবলোকন করে হৃদয়ঙ্গম করতে হয়। মক্কা-মদিনা তেমনি এক তীর্থস্থান যেখানে মানব ইতিহাসের সূচনাকাল থেকে হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে আসা মহামানব নবী-রাসূলদের নানা নিদর্শন ও আল্লাহ তায়ালার কুদরতি চিহ্ন রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘এতে রয়েছে মাকামে ইবরাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। যে তাতে প্রবেশ করে, সে নিরাপদ হয়ে যায়। ইবাদতের জন্য নির্মিত পৃথিবীর প্রথম ঘর কাবা। (সূরা আলে ইমরান : ৯৬-৯৭) যা অদ্যাবধি সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বিশ্ব রবের অস্তিত্ব ও অপার কুদরতের জানান দিচ্ছে। জান্নাতি পাথর হাজরে আসওয়াদ, জমজম কূপসহ বহু বরকতময় নিদর্শন যা এখনো একজন মুসলিমকে দীনের পথে অনুপ্রেরণা জোগায়, সঠিক দিশা দেয়, উজ্জীবিত করে। হাজার হাজার নবী রাসূলের পদধূলিতে যে জমিন বরকতময়।

যেখানে রাসূলে আকরাম মুহাম্মাদ সা:-এর জন্ম, বেড়ে ওঠা ও ইন্তেকাল। জান্নাতি যুবকদের সরদার হাসান, হুসাইন ও খাতুনে জান্নাত ফাতিমা রা:সহ লক্ষাধিক সাহাবার স্মৃতিবিজড়িত যে নগরী। মদিনার মসজিদের পাশেই শুয়ে আছেন বিশ্বনবী সা:। যার রওজার পাশে সালাম দিলে তিনি সরাসরি উত্তর দেন প্রিয় আশেককে। পাশেই শুয়ে আছেন মহামতি আবু বকর সিদ্দিক ও অর্ধ জাহানের খলিফা ওমর ফারুক রা:। এমন পুণ্যময় ভূমিতে হাঁটা, বসা, নামাজ পড়া, শুয়ে আরাম করা, নবী ও সাহাবাগণের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো দেখা, স্মৃতিচিহ্নগুলো ছোঁয়া, মক্কা মদিনার আলো বাতাস গায়ে মাখা ইত্যািদ কর্ম থেকে উত্তম আর কী হতে পারে! হজ ফরজ না হলে এসবের বরকত থেকে মুমিন বঞ্চিত হতো। সখ করে কতজন যেত এই মরুর দেশে।

তাই আল্লাহ তায়ালা ব্যক্তিচরিত্রের উৎকর্ষ সাধন ও তাঁর অফুরন্ত নেয়ামতে বান্দাকে অবগাহন করাতে ডেকে নেন তার গৃহের পাশে, রহমতের বারিপাতে। প্রিয় বন্ধুর রওজা মোবারকের সান্নিধ্যে। যে নগরকে করছেন ‘বালাদান আমিনাহ’। যেখানে নিরাপত্তা দিয়েছেন পৃথিবীর প্রতিটা প্রাণীকে। এমনকি বৃক্ষপত্র ছেড়াটাও যেখানে নিষিদ্ধ। এমন নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে বান্দা নিজেকে গড়ে তোলে যথাযোগ্য করে। নিষ্পাপ নিষ্কলুষ হয়ে ফিরে যান নিজ দেশে, আপন আপন ঠিকানায়। আত্মায় ফিরে পান ঈমানের পূর্ণ স্বাদ হারানো আলোকরশ্মি। ব্যক্তিজীবনের হয় আমূল পরিবর্তন।

সমাজ জীবনেও হজের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। প্রতিটি মানুষ সমাজের অংশ। তাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে একটি আদর্শ সমাজ। সমাজের অপরিহার্য অংশ ইউনিটি বা একতা। আদম সন্তান হিসেবে আমরা সবাই সমান। পদ-পদবি বা যোগ্যতার বিচারে তফাৎ থাকলেও রক্তে-মাংসে সবাই এক। আদম সন্তান বিশেষ করে সব মুমিন একে অপরের ভাই। পুরো মুসলিম জাতি একটি পরিবার, একটি সমাজ, রাষ্ট্রীয় সীমানা বা কাঁটা তারে ভিন্ন হলেও। এ চরম সত্যতার পরম প্রকাশ হজের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। জাত-পাত, গোত্রে-বর্ণে আলাদা হলেও মুসলিম হিসেবে এক আল্লাহর দাস, এক রাসূলের উম্মত, এক কাবার অনুসারী, এক কুরআনের ধারকবাহক ও সর্বোপরি অহিংস, নিরহঙ্কার ভাতৃত্ববোধের মনোরম দৃৃশ্য হজের তালবিয়া, সায়ী কিংবা অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠানে দৃশ্যমান হয়। তা ছাড়া বিশ^ মুসলিম সম্মেলনের আয়োজন ঘটে হজের মাধ্যমে। এতে পরস্পরের সাক্ষাতের ফলে মুসলিম উম্মাহর খোঁজ-খবর ফেস টু ফেস নেয়া সম্ভব হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা সম্ভব হয়। যদিও বর্তমানে এ বিষয়টি অনেকটাই অবহেলিত। রাজনৈতিক উন্নয়ন আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধিসহ নানামুখী কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নেয়ারও অন্যতম মাধ্যম হতে পারে এই হজপদ্ধতি।

মহানবী সা:-এর বিদায় হজের ভাষণ বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। ব্যক্তিজীবনের উন্নয়ন ও আদর্শ সমাজ গঠনে হজ অনুষ্ঠানে এ ধরনের আবেগঘন ভাষণের প্রয়োজনীয়তা সর্বকালেই দরকার। এক কথায় হজ ব্যক্তি ও সমাজ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই হজ ফরজ হওয়া বিবেকের দাবি। এতে মানবের নানাবিধ কল্যাণ নিহিত আছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা যেন হজের মাধ্যমে তাদের কল্যাণের স্থানে উপস্থিত হয়।’ (সূরা হজ-২৮)

লেখক : শিক্ষক ও ইসলামী গবেষণা

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com