২০২৩ সালে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি বক্তৃতা, বিবৃতি ও মাঠে ময়দানে সোচ্চার হচ্ছে। বিএনপিসহ মাঠের বিরোধী দলের দাবি, আগামী নির্বাচন হতে হবে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে, ইভিএমে নয় ব্যালট পেপারের মাধ্যমে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির এ দাবিকে উদ্দেশ করে বলছেন, বিএনপি দরকষাকষি করছে। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কিসের জন্য দরকষাকষি করছে? একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন তো জনগণের দাবি। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে চায়। জনগণ চায় তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। আর সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রয়োজন। বিএনপি নেতারা বলছেন, জনগণের এ দাবিই বিএনপির দাবি।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এই দুই নির্বাচন বিদ্যমান সরকারের অধীনে হয়েছিল। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসের নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনে বিতর্কমুক্ত ছিল না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অতীতের সব ইতিহাস ভঙ্গ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনের মুখে যে অমোচনীয় কালি লেপন করেছে সেই কলঙ্ক এই জাতিকে বহুকাল বহন করতে হবে। সেই জায়গা থেকেই বিএনপি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার লক্ষ্যে ২০২৩ সালের নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ সরকার ও ব্যালট পেপারের মাধ্যমে করার জন্য আন্দোলন সক্রিয় করার চেষ্টা করছে। সুতরাং বিএনপির এ দাবিকে ‘দরকষাকষি’ বলে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে ভুল বার্তা দিয়ে এটিকে বুমেরাং করতে চাচ্ছেন। এটি আওয়ামী লীগের কূটকৌশলেরই অংশ।
আওয়ামী লীগ বুঝে গেছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তাই তারা চাচ্ছে, আগামী নির্বাচন তাদের অধীনেই হবে এবং ইভিএমে হবে। বিএনপিসহ মাঠের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কোনো অবস্থায়ই এই সরকারের অধীনে ও ইভিএমে ভোট করবে না বলেই তাদের দাবি আদায়ের জন্য মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে যারাই ক্ষমতায় আসুক তাদের মেনে নিতে বিএনপির কোনো আপত্তি থাকবে না। তা হলে আওয়ামী লীগের আপত্তি কেন?
এ দাবি নিয়ে বিএনপি যখন মাঠে সরব হওয়ার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগের তখন ‘মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে’। সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এ কথা জোর দিয়ে বলতে গিয়েই তারা মনের অজান্তে ২০১৪ সালের নির্বাচনে কোনো ভোটার ভোট দেয়নি এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়েছে এ সত্যটাকে স্বীকার করে ফেলছেন এই ভাষায় যে, আগামী নির্বাচন রাতে নয়; দিনেই হবে এবং ভোট সুষ্ঠু হবে। একজন নির্বাচন কমিশনারও বলে ফেলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন রাতে নয়, দিনেই হবে। বিএনপির এ সদিচ্ছাকে আওয়ামী লীগ খুব সহজে মেনে নেবে তা কোনো কল্পনাতেই আসে না। তা হলে বিএনপিকে কী করতে হবে- এটিই আজ বড় প্রশ্ন।
আমরা যদি খুব অতীত ও সদ্য অতীতের দিকে তাকাই তা হলে দেখতে পাবো, যেসব সরকার তাদের জনগণের ওপর ফ্যাসিবাদী বা একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালু করেছিল, তাদের পতনের জন্য জনগণকেই রাজপথে নামতে হয়েছে। তারা জনগণের কোনো দাবিই সহজে মেনে নেয়নি, বরং জনগণের সোচ্চার ভ‚মিকার কারণেই তারা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। কারণ তাদের ভিত একেবারেই দুর্বল। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুবী স্বৈরশাসনের পতন হতে বাধ্য করা হয়েছিল। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন নিশ্চিত হয়েছিল জনগণের আন্দোলনের মুখে। এ ছাড়াও মুসোলিনী, হিটলারসহ যত স্বৈরাচারের জন্ম হয়েছিল সবার পতনই গণ-আন্দোলনের মাধ্যমেই হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার সদ্য বিদায়ী রাজাপাকসে সরকারের করুণ পরিণতি জ্বলজ্বলে উদাহরণ হয়ে রাজনীতির আকাশে বাতাসে ভাসছে। রাজাপাকসের পালিয়ে যাওয়া, মন্ত্রী এমপিদের কাপড় খুলে নেয়ার দৃশ্য দেখে আমাদের সরকার ভয়ে কম্পমান হয়ে আগেভাগেই বলা শুরু করেছে বাংলাদেশ কিন্তু শ্রীলঙ্কার মতো হবে না।
গণতন্ত্র নিয়ে আর ছিনিমিনি খেলা চলবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছে। ‘ডিকাব টক’ নামে পরিচিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সুষ্ঠু, অবাধ ও স্বচ্ছ জাতীয় নির্বাচন হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে জনগণের মুক্তভাবে তাদের নেতা নির্বাচিত করার অধিকার থাকবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ কিভাবে সৃষ্টি করা হবে, তা বাংলাদেশকেই নির্ধারণ করতে হবে।’ তিনি নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘এই মানদণ্ডের সুনির্দিষ্ট তালিকা রয়েছে। এর মধ্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সহিংসতামুক্ত পরিবেশ প্রভৃতি আছে। বাংলাদেশ সরকার, নির্বাচন কমিশন, জনগণ, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকেই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য মুখ্য ভ‚মিকা পালন করতে হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও নির্বাচনসংক্রান্ত কর্মকাণ্ড তদারকি করার সক্ষমতা বজায় রাখাটা জরুরি। নির্বাচনী প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তাই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য এখন থেকেই সজাগ থাকা প্রয়োজন (নয়া দিগন্ত, ১ জুন,২০২২)।’ তারা সরকারের নির্যাতন, গুম খুনের বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে এবং তাদের বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে বার বার হুঁশিয়ারি করে দিচ্ছে। এটি তো বহির্বিশ্বের প্রচেষ্টা কিন্তু মাঠের রাজনীতি? এটি জনগণকে সম্পৃক্ত করে নিজেদেরই দখল করতে হবে। সরকারের দুর্নীতি, রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা, দমননীতি, জনগণের ভোটাধিকার আদায়, সাংবিধানিক অধিকার, দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতির জন্য সরকার নিজেরাই দায়ী ইত্যাদি বাস্তব বিষয়কে সামনে এনে জনমত গঠন করে সামাজিক চাপ তৈরি করার ক্ষেত্র বিএনপির ভেতর থেকেই দলীয় নেতৃত্বকেই নিতে হবে। শুধু বিক্ষোভ সমাবেশ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করা সম্ভব হবে না। দাবি আদায়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি শুরু। এ আন্দোলন দেশব্যাপী সব পর্যায়ের নেতৃত্বকে মাঠে রেখেই করতে হবে। রাজপথে থেকেই নেতৃত্ব দিতে হবে শীর্ষ নেতৃত্বদের।
আমরা যদি পাকিস্তানের সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দিকে তাকাই তা হলে দেখতে পাই তিনি কিভাবে ক্ষমতা থেকে সরে গিয়েও মাঠের রাজনীতিকে উত্তাল করে তুলেছেন। নতুন নির্বাচনের দাবিতে রাজধানী ইসলামাবাদ অভিমুখে যে লংমার্চ করছেন সদ্য ক্ষমতাচ্যুত, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান, তাতে বাধা না দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। একই সাথে লংমার্চ থেকে আটক সব নেতাকর্মীকে ছেড়ে দেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। অথচ এই সুপ্রিম কোর্টই সংসদে দেয়া স্পিকারের রুলিংকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে রায় দিয়ে আস্থা ভোটের আয়োজন করার জন্য সময় বেঁধে দিয়েছেন। যে আস্থা ভোটে হেরে গিয়ে ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হন। ‘আজাদি মার্চ’ থেকে নতুন নির্বাচনের জন্য দেশটির সরকারকে ছয় দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন ইমরান খান; অন্যথায় গোটা জাতিকে সাথে নিয়ে আবারো রাজধানীতে আসার হুঁশিয়ারি দেন তিনি। ইমরান খান এটি করতে পারছেন কারণ তিনি জনগণকে তার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন।
বিএনপি নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তারা কোনো প্রহসনের ভোটে যাবেন না। এখানে ‘দরকষাকষির’ কিছু নেই। এ সিদ্ধান্তের ওপর অটুট থেকে বিএনপিকে দাবি আদায় করতে হলে সরকারকে কঠোর আলটিমেটাম দিতে হবে এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করে রাজপথে থেকেই সরকারকে তা মানতে বাধ্য করতে হবে। পুলিশের অনুমোদন নিয়ে আন্দোলন করলে সেই আন্দোলনে সরকার কেন, পিঁপড়াও ভয় পায় না।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপিকে বলব, দরকষাকষি করে লাভ নেই। সরকার দরকষাকষিতে ‘সংবিধান’ থেকে নড়বে না। যেভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নির্বাচন হয়, সেভাবেই সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে।’ ওবায়দুল কাদের সাহেবের তো ভুলে যাওয়ার কথা নয়, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও কিভাবে নির্বাচন হবে সংবিধানে তা লিপিবদ্ধ ছিল। তাদের আন্দোলনের ফসল সংবিধানে উল্লিখিত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন করে দু’বার ক্ষমতায় এসেছিলেন। সংবিধানের প্রতি যখন এতই দরদ, তা হলে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন কেন সংবিধানে লিপিবদ্ধ, আপনাদের আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করলেন না? আপনারাই তো আপনাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেন না তা হলে অন্যরা আপনাদের বিশ্বাস করবে কোন কারণে?
কাজেই আওয়ামী লীগকে বাধ্য করানো না গেলে কোনো অবস্থায়ই তারা বিএনপির দাবিমতো একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না। রাজপথে থেকেই বিএনপিকে এ দাবি আদায় করতে হবে। কারো অপেক্ষায় বসে থাকলে চলবে না। কেউ তাদের আপনা আপনিই ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে না। আওয়ামী লীগের ‘দরকষাকষি’ যে ঠিক নয়, তা জনগণের কাছে বিএনপিকেই প্রমাণ করতে হবে।
harun_980@yahoo.com