অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন। অবকাঠামোর উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে উন্নয়নের গতি, লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের পর্যাপ্ততা, যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকায়ন বিশেষ করে নিরাপদ ও টেকসই সড়কব্যবস্থা, দ্রুত ও আরামদায়ক নৌপথ মানুষের জীবনমান উন্নত করে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পদ্মা সেতু নির্মাণ আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের অন্যতম মাইলফলক। এটি এখন আর স্বপ্ন নয়, সত্যি। এ সেতু আমাদের চিন্তার জগতে বিরাট পরিবর্তন আনবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবে। এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিবে। কৃষির বহুমুখীকরণ ও শিল্পায়নে গতির সঞ্চার করবে।
২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর নানা পটপরিবর্তনের কারণে থেমে যায় পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেতু নির্মাণের কাজ আবারো শুরু হয়। একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংক সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। তার কথা আজ সত্যি হলো। এ পদ্মা সেতু এখন নির্মিত হয়েছে। মূলত নিজেদের দেশীয় উপকরণ দিয়ে। সেতু নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি উপরকণ হলো স্টিল ও সিমেন্ট। আমাদের দেশে যথেষ্ট ভালো মানের সিমেন্ট ও স্টিল তৈরি হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণে দেশীয় সর্বোচ্চ মানের উপকরণ ব্যবহার আমাদের আত্মবিশ্বাসকে আরো বৃদ্ধি করেছে।
জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত ১৫ বছর মেয়াদি এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কাজ করেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহজ হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহজ হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় তিন কোটি মানুষ উপকৃত হবে। পটুয়াখালীর পায়রাতে তৈরি হচ্ছে সমুদ্র বন্দর। তা ছাড়া মংলাবন্দর তো রয়েছেই। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে তৈরি করে আরো নানান শিল্প, পর্যটন কেন্দ্র। এসব সারা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার করবে। পদ্মা সেতু নির্মাণে গ্রাম ও শহরের মাঝে সেতুবন্ধ তৈরি হবে।
পরিবহন ব্যবস্থাপনা, কৃষি ও শিল্পায়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতি বছর দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে বাড়তি ১ দশমিক ২ শতাংশ বা তারও বেশি বাড়তি প্রবৃদ্ধি যুক্ত হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। বর্তমান বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু হলো চীনের ‘দানিয়াং কুনশান গ্র্যান্ড ব্রিজ’ যার দৈর্ঘ্য ১৬৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। যার কিছু গেছে পানির উপর দিয়ে, বাকিটা স্থলভাগের উপর। আমাদের পদ্মা সেতুর বিশেষত্ব এই সেতুর পাইপ বা মাটির গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত গেছে এ সেতুর অবকাঠামো। ৪১টি স্প্যানসমৃদ্ধ ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটি দ্বিতলবিশিষ্ট। নিচের অংশে ছুটবে ট্রেন, উপর দিয়ে চলছে গাড়ি। সড়ক ও রেল-দুটো একসাথে চিন্তা করলে দৈর্ঘ্যরে দিক থেকে বিশ্বের প্রথম সারির সেতুগুলোর মধ্যে পদ্মা সেতুর নাম থাকবে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শুধু ২১টি জেলা নয়, বরং সারা দেশের মানুষ নানাভাবে উপকৃত হবে। কৃষিপণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে। কৃষকরা দ্রুত ঢাকায় কৃষিপণ্য পৌঁছতে পারবে। দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের আয় দ্বিগুণ হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণে সাত-আট হাজার শ্রমিক কাজ করেছিল। এসব শ্রমিক একসময় বেকার ছিল। সেতু নির্মাণের কাজ শুরু থেকে এরা জীবনের গতি ফিরে পেয়েছে।
সেতুটি নির্মাণের ফলে সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা আরো উন্নত হলো। এর ফলে ভুটান নেপালের সাথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বাড়বে। সেতুর দুই পাশে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, শিল্প কারখানাসহ কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত কাজে নানা কারখানা তৈরি হবে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পর্যটন শিল্পের বিকাশেও সেতুটি সাহায্য করবে। নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। কৃষি উৎপাদনে তাদের মাঝে উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে। দ্রুত ও কম সময়ে পণ্যগুলো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছাতে সহজ হবে। পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা দেশের উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক। সেতুটি চালুর মধ্য দিয়ে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের সাথে পণ্য পরিবহন ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে। গুরুত্বপূর্ণ নৌ-বন্দর মংলা বন্দরের উপর্যুক্ত গ্রহণযোগ্যতা ও উপকারিতা বৃদ্ধি পাবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবে। দেশের শিল্প উৎপাদন, কৃষি উৎপাদন ও শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ সহজ করবে। এই সেতু নির্মাণ আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করবে।
পদ্মা সেতুর ফলে আমাদের শিক্ষাবিস্তারেও পরিবর্তন দেখা দিবে। দক্ষিণাঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়বে। ঢাকা বা শহরগুলোতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনার সুযোগ পাবে। এতে শিক্ষাবৈষম্য দূর হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। পদ্মা সেতুর ফলে মংলা সেতু বন্দরের গতি বাড়বে। তা ছাড়া পায়রা বন্দর নির্মিত হলে সেতুর মাধ্যমে দুই বন্দরের মাঝে যোগাযোগ সমৃদ্ধ হবে। পদ্মা সেতুর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ যাতায়াতব্যবস্থার যুগান্তকারী পরিবর্তন সৃষ্টি হবে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। কৃষিপণ্যের রফতানি বৃদ্ধি পাবে। দারিদ্র্য নিরসন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তবে সেতু নির্মাণ হলে সব উন্নয়ন আপনি আপনি হয়ে যাবে এমনটি ভাবা ঠিক হবে না। এ জন্য দরকার হবে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা। দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য সরকারের সামগ্রিক পরিকল্পনা নেয়া উচিত। পদ্মা সেতু অর্থনৈতিক গুরুত্বকে উপলব্ধি করে এ অঞ্চলের কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত। শিল্প উন্নয়নে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব শুধু সভা সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে শেষ না করে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নেয়া উচিত। পদ্মা সেতুকে ঘিরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের শিল্প কারখানা স্থাপনে আর্থিক সহায়তা ও বিনিয়োগ প্রদান করা উচিত। গ্যাস সংযোগ, বিদ্যুৎ সংযোগ বাড়ানো ও পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে যাতে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। পদ্মা সেতুর প্রেরণা কাজে লাগিয়ে আমরা ভবিষ্যতে উন্নয়ন ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হবো।
একসময় বৈদেশিক সহায়তা ছাড়া চলতে না পারা বাংলাদেশ এখন নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতুর মতো মেঘা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এ ছাড়া মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো মেঘা প্রকল্প বাস্তবায়নেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এসব প্রকল্প যথাসময়ে স্বচ্ছতার সাথে দ্রুত সম্পন্ন করে প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে। একসময়ের ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের জর্জরিত জাতি দুর্নাম ঘুচিয়ে খাদ্যে ক্রয় সয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি আমাদের জন্য অনেক স্বস্তিদায়ক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিগুলো মূল্যায়ন করা উচিত। কী কী আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি, কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা ঘাটতি রয়েছে, তা ভেবে দেখা উচিত।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ৫১ বছরে আমরা পদার্পণ করছি। অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকেই পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে। এটি আমাদের কম অর্জন নয়। তবে করোনা মহামারীর কারণে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও পেশি শক্তির দমন করে সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে কল্যাণমুখী, জবাবদিহিমূলক, জনকল্যাণমুখী, অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরির প্রত্যয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে সোনার বাংলাদেশ, গর্বের বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে থাকবে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ই-মেল : main706@gmail.com