বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। আর ঢাকাতেই সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান অবস্থিত। ভৌগোলিকভাবে ঢাকা একটি অতিমহানগরী বা মেগাসিটি। ঢাকা মহানগরী এলাকায় জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি ১০ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ ভাগ। জনসংখ্যার বিচারে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম শহর।
কিন্তু আজকে এত বহুল বসবাসযোগ্য শহরটা মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠলো। শুধু তাই নয়, ঢাকা বর্তমানে ভূমিকম্পেরও ঝুঁকিতে রয়েছে। আর পরিবেশ দূষণের শীর্ষেও অবস্থান করছে এই ঢাকা।
অথচ, আজকের ঢাকা এক সময় এমন সমস্যায় জর্জরিত নগরী ছিল না। সতেরো শতকে মোগল সাম্রাজ্যের বাংলা প্রদেশের রাজধানী ছিল ঢাকা। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে এই শহর পরিচিত ছিল জাহাঙ্গীরনগর নামে। ইতিহাস অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মুসলিন বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র ছিল ঢাকা। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসতেন। অবশ্য আধুনিক ঢাকা শহরের বিকাশ ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ শাসনামলে, এই সময় নবাবেরা ঢাকা শাসন করতেন। ওই সময় কলকাতার পর ঢাকাই দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী হয়ে ওঠে।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ হয়। এরপর ঢাকা নবগঠিত পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরে ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৯৫০-৬০ সালের মধ্যে এই শহর বিভিন্ন সামাজিক, জাতীয়তাবাদী ও গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষিত হয় ১৯৭১ সালে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। আধুনিক ঢাকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রধান কেন্দ্র। যার জন্য এতটা অসুস্থ হয়ে পড়লো ঢাকা। একটু ভাবুন তো, ঢাকাকে যদি একমাত্র রাজধানী শহর না রেখে আলাদা কোনো শহরে রাজধানী স্থানান্তর করা যায় বিষয়টা কেমন হবে! সত্যি অনেকটা শুনতে অবাক হওয়ার মতো যে, ঢাকাকে কিভাবে রাজধানী শহর থেকে বাদ দেয়া হবে। তবে হ্যাঁ এটা সম্ভব। আমরা যদি দু‘টা কেন্দ্রীয় রাজধানী গড়ে তুলি তাহলে অসম্ভব কিছু হবে না।
যেমন : প্রশাসনিক কেন্দ্রীক রাজধানী এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্রীক রাজধানী। আমরা যদি লক্ষ্য করি, ঢাকাতে সকল প্রশাসনিক ভবন এবং বাণিজ্যিক ভবন অবস্থিত। যদি আমরা বাণিজ্যিক ভবনগুলো আমদানি রফতানির জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত শহর চট্টগ্রামে স্থানান্তর করে দিই তাহলে কেমন হবে! তাহলে ঢাকা শুধু প্রশাসনিক ভবনগুলো থাকলো। বিভিন্ন সমস্যা ও কমবে।
এবার আমরা কিছু পরিসংখ্যান দেখি, ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ায় মুম্বাইয়ের পরে দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির শহর। ঢাকার জিডিপি ১৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২০ সালের হিসাবে। এছাড়া ঢাকার পিপিপি ২৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২০ সালের হিসাবে। জনঘনত্বের বিচারে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২৩ হাজার লোক বাস করে।
তাছাড়াও ঢাকাকে বিশ্বের মধ্যে রিকশার রাজধানী নামে আমরা সবাই জানি। প্রতিদিন গড়ে এখানে প্রায় চার লাখ রিকশা চলাচল করে। রিকশা ও ইঞ্জিনচালিত অটোরিকশা ঢাকার অন্যতম প্রধান বাহন, আর এই শহরে প্রায় চার লাখ-এর বেশি রিকশা চলাচল করে, তা অন্য সকল দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও সরকারি হিসাব মতে, ঢাকা শহরের জন্য মোট ৮৫,০০০ রিকশার নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। রিকশা ঢাকা শহরের রাস্তার যানজটের অন্যতম কারণ এবং কিছু বড় বড় রাস্তায় রিকশা, সিএনজিসহ তিন চাকা বিশিষ্ট গাড়িগুলো যানজটের প্রধান কারণ।
এবার যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে লক্ষ্য করি, বাংলাদেশে প্রায় ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে সরকার। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো এর মধ্যে প্রায় ৪৫টি হলো ঢাকা বিভাগে।
অন্যদিকে ঢাকার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বাংলাদেশে বর্তমানে সর্বমোট ৩৫টি পাবলিক বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি হচ্ছে ঢাকায়।
তাহলে এবার বুঝাই যাচ্ছে ঢাকা কতটা ব্যস্ত শহর। আর এখানে যদি সব কেন্দ্রীয়করণ করে রাখা হয় তাহলে দেশে সুসম উন্নয়ন সম্ভব হবে না। অথচ,আমাদের অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও গ্রামগুলোতে হাজার হাজার হেক্টর জমিসহ অনেক জায়গা, নদীর চর খালি রয়েছে। যেগুলো কোনো অর্থনৈতিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না। আমরা যদি ঢাকাতে প্রশাসনিক রাজধানী হিসেবে চিন্তা করি। আর অন্য বিভাগীয় শহরে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে চিন্তা করি বিষয়টা কেমন হয়, বলুন তো! আমরা তাহলে সুসম উন্নয়ন বণ্টনের পাশাপাশি ঢাকাকে বসবাসযোগ্য পরিবেশ এবং যানজট মুক্ত শহর গড়ে তুলতে পারবো। ফলে ব্যস্ততাও কমে যাবে মানুষের। সৃষ্টি হবে হাজার হাজার বেকার লোকের কর্মসংস্থানের।
বিশ্বের অনেক দেশে যখন এরকম বসবাস অযোগ্য পরিস্থিতি হয়েছিল তখন তারা উদ্ভাবনী উপায়ে এর সমাধানের চেষ্টা করেছে। এর একটি সমাধান হচ্ছে দুই কেন্দ্রিক দেশ। একটি হবে প্রশাসনিক কেন্দ্র, অন্যটি হবে বাণিজ্যিক কেন্দ্র। ভারতের ক্ষেত্রে যেমন দিল্লি ও মুম্বাই, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যেমন করাচি ও ইসলামাবাদ। ইউরোপের অনেক দেশেই প্রশাসনিক রাজধানী যেখানে, সেখানে কোনো বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলা হয় না। আমরা যদি বিশ্বের উন্নত কিছু দেশের দিকে তাকায়, তারা তাদের রাজধানী শহর সরিয়ে কিভাবে নিয়েছে, কিভাবে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হলো নতুন কোনো শহরে। এর মধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, কাজাখস্তান, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, মিয়ানমার বা নাইজেরিয়ার মতো দেশ।
ইন্দোনেশিয়া যদি তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, সেই তালিকায় এখন তাদের নামও যুক্ত হবে। তাহলে আমরাও কি এমনটা চিন্তা করতে পারি যে ঢাকাতে প্রশাসনিক রাজধানী রেখে বাণিজ্যিক রাজধানী আলাদা কোনো বিভাগে সরিয়ে ফেলা।
তবে আমরা জানি, একটা রাজধানী তৈরি করতে অনেক টাকার ও জায়গার প্রয়োজন। সেজন্য হয়তো বাংলাদেশ ইচ্ছা করলেই সরিয়ে ফেলতে পারবে না রাজধানী। কারণ, একটা বিমানবন্দর তৈরি করতে গেলে ও আমাদেরকে অনেক জায়গা অধিগ্রহণ করতে হয়। যেটা একটা রাজধানী তৈরি করতে আরো বেশি সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে।
তবে এরপরও আমাদের এই বিষয়টা নিয়ে পরিকল্পনা করা উচিত। আরো একটা পদ্ধতি আছে। তা হলো, বাংলাদেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০০ শহর আছে। সব শহরে যদি আমরা সুষম নগরায়ণ করতে পারি, তাহলে ঢাকার ওপর চাপ এমনিতেই কমে যায়।
কিন্তু নতুন রাজধানী যদি গড়তে হয়, একটু সঙ্কটময় হলেও চেষ্টা করলে হয়তোবা তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। কারণ, একটা রাজধানী যখন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়। তাকে বসবাসের যোগ্য করতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হবে তা দিয়ে নতুন আরেকটা রাজধানী তৈরি করাও অসম্ভব নয়।
সুতারাং, দেশের আগামীর প্রয়োজন অনুযায়ী ঢাকাকে আর কতটা বিস্তৃত করা সম্ভব, সেটা নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। আর সেটা করতে না পারলে আমাদের কী ধরনের ক্ষতি হবে (পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির ক্ষতি) তা নিয়েও চিন্তা করা দরকার। তাই ঢাকাকে দ্রুত বাসযোগ্য করার পদক্ষেপ না নিতে পারলে, বিকল্পই ভাবতে হবে।
মাজহারুল ইসলাম শামীম
শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ।
বিভাগ : ব্যবস্থাপনা (তৃতীয় বর্ষ)