শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২২ অপরাহ্ন

দায়গ্রস্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ খাত

রিন্টু আনোয়ার
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০২২
  • ১১৪ বার

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল কারখানার বয়লার চেম্বারের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। অনেক দেশে বর্তমানে একই সাথে তাপপ্রবাহ চলছে। ফলে আমাদের দেশেও তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। প্রকৃতিতে যেন গ্রীষ্মের তাপদাহ চলছে। তাপদাহে নাকাল রাজধানীসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার জনজীবন। বাংলাদেশে বেশ কিছু দিন থেকে তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। সামনের কিছু দিন তা আরো বাড়বে, যদি মুষলধারে বর্ষণ না হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তীব্র তাপপ্রবাহের জন্য কম বৃষ্টি, বাতাসের গতিবেগ কমে যাওয়া, জলীয়বাষ্পের আধিক্য, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য কমে যাওয়াকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আবহাওয়াবিদরা। ফলে বিগত কয়েক দিন ধরে আবহাওয়া যেন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে আছে। আকাশে শরত ও হেমন্তকালের মতো বিক্ষিপ্ত মেঘের আনাগোনা এবং একই সাথে তীব্র খরতাপ। ফলে ভরা বর্ষাকালেও বাংলাদেশের মানুষকে ভ্যাপসা গরমের যন্ত্রণা সইতে হচ্ছে।

এর মধ্যে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট (লোডশেডিং) মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। চলেছে বিদ্যুতের লুকোচুরি খেলা। এই ভ্যাপসা গরমে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ এখন সাধারণ মানুষ। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। আমাদের দেশে লোডশেডিং নতুন কিছু নয়, এটি একটি নিত্য ঘটনা। লোডশেডিংয়ের দুর্গতি অস্বীকারের বিষয় নয়। লুকানোরও জো নেই। তবে, রাজনীতির ময়দান খোলা। এ নিয়ে যার যা ইচ্ছা বলার সুযোগ অবারিত। বিরোধী মহল থেকে বলা হচ্ছে, এটি কুইক রেন্টালের নামে লুটপাটের ফল। সরকারের লক্ষ্যবস্তু বিএনপি। কেবল এই দলটিরই অভিযোগের জবাব দেয়ার গরজ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক তথা স্পোকসম্যান ওবায়দুল কাদেরের জবাব হচ্ছে, বিএনপি নেতাদের মুখে লোডশেডিং নিয়ে কথা মানায় না। জনগণ বিএনপি আমলের লোডশেডিংয়ের কথা ভোলেনি।

বিদ্যুৎ আসলে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের বিষয় নয়। আবার কাব্যগাথা চমৎকার কথামালায় অভিযোগ খণ্ডনই সমস্যার ফয়সালা নয়। এমনও নয় যে, সরকার সমাধান আনার চেষ্টা করছে না। সরকার অগ্রাধিকারে গুরুত্ব দিচ্ছে বিষয়টিতে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি তেল ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এ মন্ত্রণালয়ের মূল দায়িত্বশীল প্রধানমন্ত্রী। সব ধরনের আলোকসজ্জায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। জনগণকে গাড়িতে অহেতুক ঘোরাঘুরি না করতে, বেশি তেল না পোড়ানোর নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে সরকারি তরফে লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে বিদ্যুতের চাহিদা কমানোর চেষ্টামাত্র। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে টানা তিন ঘণ্টা বৈঠক করেছেন এ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী। সেখানে অফিস-আদালতের সময় কমিয়ে আনার কথা এসেছে। পাশাপাশি ওয়ার্ক ফর্ম হোমেরও চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক এই উপদেষ্টা। বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘যুদ্ধ’ উল্লেখ করেছেন তিনি।

যুদ্ধটা হুট করে আসেনি। এমন শঙ্কা করা হচ্ছিল গত মাস কয়েক ধরেই। কিন্তু আমল দেয়া হয়নি কার্যকরভাবে। এখন ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ বলা হলেও সরকারি মহল থেকে একে সাময়িক সমস্যাও বলা হচ্ছে। উপদেষ্টা জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রিডে সাড়ে ১৪ হাজার পর্যন্ত চাহিদা হতে পারে। সেখান থেকে যতটা সম্ভব কমানোর চিন্তা চলছে। সাশ্রয়ী হলে চাহিদা বড়জোর সাড়ে ১২ হাজার নামিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু এটি মোটেই স্থায়ী সমাধান নয়। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সেক্টরের ভেতরের খবর জানা সূত্রগুলোর কাছে খবর ভিন্ন। যার কিছুটা এই বিষয়ের প্রতিমন্ত্রীও গোপন না করে প্রকাশ করে দিয়েছেন। সমস্যার জটিলতার আভাস রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর লোডশেডিংয়ের এলাকা ভাগ করে দেয়ার পরামর্শের বক্তব্যেও। এর মাঝেই আবার জ্বালানি তেলবিষয়ক কিছুটা ইঙ্গিত রয়েছে জ্বালানি ও বিদ্যুতের এই প্রতিমন্ত্রীর। বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের জ্বালানি পরিস্থিতি জানাতে গিয়ে তিনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোরও ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেই সাথে গ্যাস ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

দেশের মানুষের জন্য অন্যতম সুসংবাদ ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ার পর লোডশেডিংয়ের বিদায় নেয়া। অনেকের কাছে তা ছিল দুঃসহ স্মৃতির মতো। সেই লোডশেডিং যন্ত্রণা আবার ফিরেছে। তা রাজধানীসহ সারা দেশেই। এ নিয়ে অতি স্বস্তি, বাহাদুরির আড়ালে ঘটে গেছে মহাসর্বনাশ। বিদ্যুতের গল্পের আড়ালে ভর্তুকিও গেছে। এ নিয়ে কথাবার্তা যে একদম হয়নি, এমনও নয়। তা আমল পায়নি।

সরকারবিরোধিতা-উন্নয়নবিরোধিতা নামে চালানোর চেষ্টা হয়েছে। সুযোগটা নিয়েছে ধড়িবাজরা। দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট। ২০৪১ সালের মধ্যে তা ৬০ হাজার মেগাওয়াটে তোলার টার্গেট রয়েছে সরকারের।
এ জন্য স্থানীয় ও বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নেয়াসহ বিদ্যুৎ খাত পরিচালনায় সরকারি কোম্পানিগুলোর দায়-দেনাও বেড়েছে। যার পরিমাণ দুই লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর ভার বহন করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোকে। উৎপাদিত বিদ্যুতের ক্রয়-বিক্রয় মূল্যের অসামঞ্জস্য ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার চার্জ পরিশোধ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-বিপিডিবি। দেনা বা ঋণের বোঝার পাশাপাশি জমেছে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ বকেয়া বিল। অন্য দিকে, সরকারের কাছ থেকে নেয়া ঋণের ওপর ভর করতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বিদ্যুৎ খাতের কার্যকর পরিকল্পনার অভাবই খাতটিকে দিনে দিনে কেবল দায়গ্রস্তই করে তুলেছে।
দেশে বিদ্যুৎ খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বেশির ভাগ অর্থায়ন করেছে রাশিয়া। প্রকল্পে দেশটির দেয়া ঋণের পরিমাণ ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৭ সাল নাগাদ। তত দিন পর্যন্ত কী হবে? এ প্রশ্নের জবাব এখনো স্পষ্ট নয়। তবে সরকারের পরিকল্পনায় ঘাটতি নেই। গেলবারের চেয়ে এ খাতে বাজেট বরাদ্দ কিছুটা কমলেও উচ্চ আয়ের দেশে উত্তরণে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা যে ক্রমান্বয়ে বাড়বে, সেই দৃষ্টে এ খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে বাজেট রয়েছে প্রচুর। বাজেট কম-বেশি শেষ পর্যন্ত সমস্যা হয় না কখনো। পরিকল্পনা থাকলে কাজ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ভারতের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিকল্পনা থেকে দীক্ষা নেয়ার বিষয়-আশয় রয়েছে।

বিদ্যুৎসঙ্কট কাটাতে ভারতে শতাধিক কয়লাখনি ফের চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এক অঞ্চল এক পথ (ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড) উদ্যোগ থেকে ভারত সরে থাকলেও প্রতিবেশীদের নিয়ে নতুন এক বলয় গড়তে কাজ করছে। পেট্রোলিয়ামের বড় উৎস হিসেবে, প্রযুক্তির বিনিময় আর আন্তনির্ভরতা তৈরির মাধ্যমে নিজের অবস্থান সংহত করতে ইন্দোনেশিয়া থেকে মরিশাস পর্যন্ত এই জ্বালানি-বলয় গড়তে চাইছে দেশটি। কেবল দেশের বাইরে হাইড্রোকার্বনের উৎস খুঁজতে নয়, ভিন্ন একটি পন্থায় কূটনীতির মাধ্যম হিসেবে তারা জ্বালানিকে ব্যবহার করতে চাইছে। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী মরিশাসে ভারত যে পেট্রোলিয়াম সংরক্ষণাগার এবং অবকাঠামো তৈরি শুরু করেছে, তা একটি আঞ্চলিক কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। ব্যাঙ্গালুরু সংশোধনাগার থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্য সরবরাহের পাশাপাশি মরিশাসে খুচরা পণ্যের বাজারেও ভারত এখন বড় সরবরাহকারী।

বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আপত্তি বা মতবিরোধ থাকলেও তা কাটানো কঠিন নয়। বিকল্প ব্যবস্থার পর্যাপ্ত সুযোগও এ দেশে আছে। দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও চিত্র পাল্টে যেতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল, এলএনজি ও ডিজেলের দাম বেড়েছে বলে বিদ্যুতে ভর্তুকি কমাতে লোডশেডিং দেয়ার যুক্তি মানুষ মানতেই থাকবে বলে ভাবা যায় না। টানা গত কয়েক বছর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎপ্রাপ্তির মাঝে দৈনিক ১২-১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকার ইতিহাস শুনতে ভালো না লাগাই স্বাভাবিক।

দেশে বর্তমানে ১৩ হাজার ৫৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। জমির প্রাপ্যতা, জ্বালানি পরিবহন সুবিধা এবং লোড সেন্টার বিবেচনায় পায়রা, মহেশখালী ও মাতারবাড়ী এলাকাকে পাওয়ার হাব হিসেবে চিহ্নিত করে বৃহৎ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মোট চাহিদার শতকরা ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যে সৌরশক্তিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ অবস্থায় উৎপাদনের নতুন প্রকল্পের চেয়ে সঞ্চালন ও বিতরণে আনুপাতিক বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি।
এখন বড় প্রশ্ন এটাই যে, আমরা কি অপচয়, পাচার ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পারব? গোষ্ঠী বিশেষের সম্পদের পাহাড় গড়ার উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রেখে সাধারণ মানুষকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানানো নিষ্ঠুর রসিকতা নয় কি?

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com