প্রায় ১০ কোটি টাকা দুর্নীতি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত (ওয়ারেন্ট) আসামিকে ধরেও ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর পল্টন থানাপুলিশের বিরুদ্ধে। তিনি হলেন পেট্রোবাংলার অধীন রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির (আরপিজিসিএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবিএম ফজলে এলাহী। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় প্রধান আসামি তিনি।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার আসামি ফজলে এলাহীকে আটক করে পল্টন থানার পুলিশ। ওই দিনদুপুরে আদালতে নেওয়ার পথেই (ওয়ারী এলাকা) তাকে ছেড়ে দেয় সংশ্লিষ্টরা। পল্টন থানার এক এসআইয়ের কথোপকথনেও বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট।
এদিকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত ওই আসামি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি পুলিশের। যদিও গতকাল শুক্রবার দুপুরে ফজলে এলাহীকে পাওয়া যায়। রাজধানীর নয়াপল্টনের নিজস্ব বাসভবনে দীর্ঘক্ষণ তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। গোপনে ধারণ করা আলাপচারিতার পৌনে এক ঘণ্টার ভিডিও রেকর্ড এবং বৃহস্পতিবার বিকালে পল্টন থানার এসআই মিজানুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথোপকথনের অডিও ক্লিপ এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
পল্টন থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক শুক্রবার রাতে আমাদের সময়কে বলেন, তিনদিন ছুটি শেষে শুক্রবার সকাল থেকে অফিস করছি। বৃহস্পতিবার এবিএম ফজলে এলাহী নামে গ্রেপ্তারি পরোওয়ানাভুক্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
জানা গেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারের ৯ কোটি ৭৫ লাখ ৫৫ হাজার ৪১৩ টাকা আত্মসাৎ ও ক্ষতি করার অভিযোগে ১২ বছর আগে এবিএম ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালের ১১ মার্চ রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় বাদী হয়ে মামলাটি করেন দুদকের সিলেট জেলার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের তৎকালীন সহকারী পরিচালক মো. আবদুল মাজেদ। ফজলে এলাহী ছাড়াও মামলায় আসামি করা হয় আরপিজিসিএলের তৎকালীন শীর্ষ আরও ৫ কর্মকর্তাকে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আবদুল মাজেদ।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ফজলে এলাহী তার ওপর অর্পিত সরকারি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে অসাধু উপায়ে নিজে ও অপরকে লাভবান করার জন্য জিইআইর বিদেশি প্রতিনিধি মি. পিটার সলস্ বেরিকে মেরিন সিএনজি প্রকল্প অসমাপ্ত রেখে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেন। এতে সরকারের ৭ কোটি ৩৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা ক্ষতি করে দ-বিধির ৪০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারার অপরাধে অভিযুক্ত হন তিনি।
অভিযোগপত্রে উল্লিখিত ১১ সাক্ষীর মধ্যে ইতোমধ্যে ৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেন আদালত।অভিযোগপত্রের ওপর ভিত্তি করে এবিএম ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বর এবং ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল পৃথক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
পরোয়ানাভুক্ত আসামি ফজলে এলাহী গ্রেপ্তার হয়েছেন সূত্রের এ তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা ৯ মিনিটে ছদ্মপরিচয়ে কল দেওয়া হয় পল্টন থানার এসআই মিজানুর রহমানের সেলফোনে। এবিএম ফজলে এলাহী, যাকে আপনারা আদালতে আনতে চাইলেন, তাকে কি আজকে (বৃহস্পতিবার) আদালতে আনবেন না? প্রশ্ন রাখা হলে ওপাশ থেকে এসআই মিজানুর বলেন- ‘না না, আমাকে আরেকজন ব্যক্তি ফোন দিছিলো তাকে তো সাথে সাথে জানায় দিছি।’
সমস্যা কি জানতে চাইলে এসআই বলেন, ‘সমস্যা হলো, ওনার (ফজলে এলাহী) তো অনেক বয়স, ওসি স্যার বললেন থানায় নিয়ে যেতে, এখন ওসি স্যারের কাছে ওনাকে বুঝায় দিয়ে আসলাম।’ ওনাকে কী ছেড়ে দেবেন? প্রশ্ন রাখা হলে মিজানুর রহমান ইতস্তত করে বলেন, মনে হয় এ রকম কিছু হবে। তাকে গ্রেপ্তার করে ওয়ারী পর্যন্ত নিয়ে এলেন, আবার ব্যাক করে নিয়ে গেলেন, এটা সমস্যা হয়ে গেল না? জানাতেই এসআই বললেন-‘স্যার আমাকে বলছেন নিয়ে যাওয়ার জন্য, আবার দিয়ে আসার জন্য। আমি এইটুকুর মধ্যেই আছি।’ ওনাকে গ্রেপ্তার করছেন কবে?
জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওয়ারেন্টের কথা শুনলে কেউ থানায় আসে নাকি? দুপুর ২টায় ওনাকে (ফজলে এলাহী) কৌশল করে বলা হইছিল, আপনার কিছু কাগজ আছে, থানায় আসতে হবে। এর পর তাকে…. বলেই ইতস্তত করতে থাকেন এসআই।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে পরিচয় দিয়ে এ প্রতিবেদক এসআই মিজানুর রহমানের গ্রামীণফোন নম্বরেই ফোন দিলে তিনি বেমালুম এবিএম ফজলে এলাহীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি অস্বীকার করেন। উল্টো জানতে চান, ওনার (ফজলে এলাহী) কী হইছে। কে এই তথ্য দিল? আমি তো ওনাকে অ্যারেস্ট করি নাই, ধরিও নাই, এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। বৃহস্পতিবার দুপুরে ফজলে এলাহীকে আপনি আদালতে নিয়ে যাচ্ছিলেন বলতেই তিনি জানান, ‘ওনার ওয়ারেন্ট আমার কাছে নেই, কার কাছে আছে খবর নেন। এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’
গতকাল দুপুরে এবিএম ফজলে এলাহীর নয়াপল্টনের বাসভবনে কথা প্রসঙ্গে অভিযোগের বিষয়টি বলতেই এ প্রতিবেদকের কাছে উল্টো প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, আমাকে গ্রেপ্তার করলে এখানে (বাসা) কীভাবে আমি? দুদকের বিষয়ে আপনি সবই জানেন। যেহেতু আমি মামলার আসামি, তাই এ বিষয়ে কিছুই বলব না। আমার পেছনে ঘুরে লাভ নেই। ভালো রিপোর্টের পেছনে দৌড়ান কাজে লাগবে।
খিলক্ষেত থানার ওসি বোরহান উদ্দিন জানান, আরপিজিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবিএম ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে বলে অবগত নন তিনি। এ নামে (ফজলে এলাহী) কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়নি বলেও জানান তিনি।