বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি খরচে কিছুটা লাগাম টানা গেলেও তা আশানুরূপ নয়। কারণ বাংলাদেশের প্রতি মাসে বৈদেশিক মুদ্রায় যে আয় আসছে, আমদানিতে তার চেয়ে অনেক বেশি ডলার খরচ হচ্ছে। যার চাপ পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি এবং ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে আমদানি খরচের অস্বাভাবিক উল্লম্ফন সেভাবে কমানো যাচ্ছে না। আবার সংকটের এই সময়ে চিকিৎসা, শিক্ষা ও ভ্রমণ বাবদ বিদেশে ডলার খরচের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ফলে বৈদেশিক লেনদেনে প্রতি মাসেই প্রায় শতকোটি ডলারের বেশি ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এই ঘাটতি সামাল দিতে গিয়ে প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে রিজার্ভ, সংকটে বাড়ছে ডলারের দাম, যা অর্থনীতিতে শঙ্কা বাড়াচ্ছে। তবে বাজারে ডলার সংকট থাকলেও তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে যায়নি বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ ছাড়া সংকটকে পুঁজি করে কেউ ডলার নিয়ে কারসাজি করছে কিনা, হুন্ডি প্রবণতা বেড়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে কার্ব মাকেটের পাশাপাশি এবার জিজিটাল প্লাটফর্মে অভিযান শুরু করেছে আর্থিক খাতের এই অভিভাবক। অন্যদিকে ব্যাংক খাতে ডলারের দামে তদারকি আরও জোরদার করা হয়েছে। এখন থেকে আমদানির ক্ষেত্রে ৩০ লাখ ডলারের বেশি ঋণপত্র খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে। আগে ৫০ লাখ ডলারের বেশি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে এ বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছিল।
করোনাপরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সকল ধরনের পণ্য (খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত) মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি এবং ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই দেশে ডলারের সংকট চলছে। গত এপ্রিল থেকে এই সংকট ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কারণ এ সময়ে আমদানি যে হারে বেড়েছে, রপ্তানি সে হারে বাড়েনি। আবার প্রবাসী আয়ও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের রপ্তানি আয় হয়েছে প্রায় ৫২ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। এটি তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। একই সময়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম। অন্যদিকে গত অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানির এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার, যদিও এটি আমদানির প্রকৃত হিসাব নয়। প্রকৃত হিসাবে আমদানির পরিমাণ ৮০ বিলিয়ন ডলারের কম হবে না। প্রকৃত হিসাব পেতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাবদ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার যে আয় হচ্ছে তার পরিমাণ বছরে প্রায় ৭০ থেকে ৭৩ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে বছরে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ ৮০ থেকে ৮৩ বিলিয়ন ডলার। এই হিসাবে ঘাটতি প্রায় ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডলার। ফলে প্রতি মাসে গড়ে ঘাটতি হচ্ছে প্রায় ৮০ থেকে ১০০ কোটি ডলার। কোনো কোনো মাসে এই ঘাটতি ১১০ কোটি ডলারও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন গত মাসেই এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১১৩ কোটি ডলারেও বেশি, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে দেওয়া হয়েছে। ফলে বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাবেই রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে অবস্থান করছে। তবে নিট হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ৩১ বিলিয়নের মতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, দেশে রপ্তানির চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ার কারণেই প্রতি মাসে ডলারের ঘাটতি হচ্ছে। এই ঘাটতি ডলার বিক্রি করে মেটানো হচ্ছে। জুলাই মাসেও ১১৩ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে ডলারের সংকট আছে এটা ঠিক, তবে তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে যায়নি। তবে সংকটের সুযোগে ডলার নিয়ে কেউ কারসাজি করছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কার্ব মার্কেটের পাশাপাশি ডিজিটাল প্লাটফর্মে যেখানে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন হয় এমন প্রতিষ্ঠানেও অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান হুন্ডি বা অন্য কোনো ব্যবস্থায় ডলার কেনাবেচা করছে কিনা তা পরিদর্শন টিম দেখছে। যদি কোনো অনিয়ম পাওয়া যায় সে রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।
এদিকে ডলার সংকটের এই সময়ে বিদেশে ভ্রমণ, চিকিৎসা ও শিক্ষার খরচ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশে ভ্রমণের পেছনে খরচ হয়েছে ৩৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে একই সময়ে যা ছিল ১৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদেশে চিকিৎসা বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা খরচের পরিমাণ ছিল ১৭০ কোটি ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার। অন্যদিকে শিক্ষা বাবদ ২০২১-২২ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয় ৩৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ২৪ দশমিক ৩০ লাখ ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয় ও ডলার সংকট কাটাতে এরই মধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানি কমাতে বিভিন্ন পণ্যে ঋণ বন্ধসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর গাড়ি কেনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর আগে ব্যাংকের ডলার ধারণের সীমা (এনওপি) হ্রাস, রপ্তানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) ধারণকৃত ডলারের ৫০ শতাংশ নগদায়ন, ইআরকিউ হিসাবে জমা রাখার সীমা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিটে স্থানান্তরের সুযোগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।