বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। মুদ্রাবাজারে চলছে ডলার সংকট। চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে। যার বিপরীতে টাকা আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এতে করে টাকার তারল্যে টান পড়েছে। আবার বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়ে প্রায় ১৪ শতাংশ হয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্য কমছে। নগদ টাকার সংকট মেটাতে অনেক ব্যাংক কলমানির পাশাপাশি এখন নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে।
মাস খানেক আগেও কলমানিতে ধার দেওয়া অনেক ব্যাংক এখন নিয়মিত টাকা ধার করছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালীসহ এরকম কয়েকটি ব্যাংক আন্তঃব্যাংক কলমানির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিনিয়ত ধার করছে। এসব ব্যাংককে বর্তমানে তুলনামূলক বেশি এলসি খুলতে হচ্ছে। গত রোববার কলমানি থেকে ১৫টি ব্যাংক ৬ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা ধার করে। একই দিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেয় আরও ৭ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। প্রতিদিনই এভাবে কলমানি ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিচ্ছে বিভিন্ন ব্যাংক। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে গত ১৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা নেয় ১৯টি ব্যাংক।
রাষ্ট্রীয় মালিকানার অগ্রণী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, শুধু জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৩৪ কোটি ডলারের বেশি কিনে তারা ৩ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এ কারণে তাদের সাময়িক সংকট মেটাতে টাকা ধার করতে হচ্ছে। মঙ্গলবার তারা ২ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলার হয়েছে। এ সময় রপ্তানি আয় ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার ৯২৫ কোটি ডলারে উঠেছে। রপ্তানি আয় অনেক বাড়লেও আমদানির সঙ্গে ব্যবধান বেড়েছে। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩ হাজার ৩২৫ কোটি ডলার। একই সময়ে আবার রেমিট্যান্স ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কমে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলারে নেমেছে। এতে করে চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়ে ১ হাজার ৮৭০ কোটি ডলারে উঠেছে। আগের অর্থবছর যেখানে ঘাটতি ছিল মাত্র ৪৫৮ কোটি ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরিস্থিতি ঠিক রাখতে আমদানি কমানোর বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১২৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বিপরীতে ব্যাংক থেকে উঠে এসেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছর বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢোকে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো। অথচ ২০১৯-২০ অর্থবছরে যেখানে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে উল্টো বাংলাদেশ ব্যাংক ৭৯৩ কোটি ডলার কিনেছিল। তখন ব্যাংকগুলোকে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা সরবরাহ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে কারণে তখন বাজারে তারল্যে ভরপুর ছিল।
সংশ্নিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রির ফলে একদিকে টাকার তারল্যে টান পড়েছে, আরেক দিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। গতকাল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৯ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা তীব্র থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত এক বছরে ডলারের দর ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে সর্বশেষ ৯৪ টাকা ৭০ পয়সায় নির্ধারণ করেছে। ব্যাংকগুলোতে ডলারের দর বেড়েছে অনেক বেশি হারে। আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স পর্যায়ে এখন ১০০ টাকার বেশিতে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে। অবশ্য জুলাই মাসে এলসি খোলার হার কমেছে। রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। রেমিট্যান্সও বেড়েছে ১৪ শতাংশের মতো। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, আমদানি ঋণপত্র খোলা কমা এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমে আসবে। তখন টাকার ওপরও চাপ কমে যাবে। তিনি বলেন, কোনো ব্যাংক যেন ডলার নিয়ে কারসাজি করতে না পারে, সেদিকে কঠোর নজর রাখতে হবে। শোনা যাচ্ছে, ডলার থাকার পরও আমদানিকারককে বাজার থেকে সংগ্রহ করে দিতে বলছে কোনো কোনো ব্যাংক। আমদানিকারক তখন ব্যাংককেই যে কোনো দরে ব্যবস্থা করতে বলছেন। এভাবে বাধ্য হয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি দরে এলসি খুলতে হচ্ছে। এ প্রবণতা রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হঠাৎ পরিদর্শনে যেতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য কমে গত মে শেষে ১ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত ডিসেম্বরে যা ২ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা ছিল। আর গত বছরের জুনে ছিল ২ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে, করোনা-পরবর্তী অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা এবং বিভিন্ন পণ্যের দর বৃদ্ধির প্রভাবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে। গত জুন শেষে বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়ে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে যা ছিল ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। তার আগের অর্থবছর শেষে ছিল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। অবশ্য সাম্প্রতিক ঋণ বৃদ্ধির মানে যে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে, তেমন নয়। মূলত বেশিরভাগ পণ্যের দর বৃদ্ধির প্রভাবে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রির ফলে টাকা আটকে যাচ্ছে। এতে করে তারল্যের ওপর টান পড়বেই। তবে ব্যাংকে ঋণযোগ্য তহবিলে কোনো সংকট নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে তারল্য বাড়াতে এরই মধ্যে সিএমএসএমই খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। এখান থেকে ব্যাংকগুলো মাত্র ২ শতাংশ সুদে অর্থায়ন নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে ৭ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে। গম ও ভুট্টা উৎপাদন বাড়াতে নতুন করে আরও একটি পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।