বিশ্ব অর্থনীতি কি মন্দা না মহামন্দার মুখোমুখি, এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে আসুন আমরা দেখি মন্দা ও মহামন্দা কী। সর্বজনীনভাবে যখন একটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) টানা ছয় মাস হ্রাস পায়, তখন এই সময়কালকে অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক মন্দা বলা হয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত নেতিবাচক হওয়ার আগে বেশ কয়েকটি ত্রৈমাসিকের জন্য মন্থর হবে। মন্দায় পরপর দুই বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে জিডিপি সঙ্কুচিত হতে পারে। মন্দা দেখা দিলে পাঁচটি অর্থনৈতিক সূচকে প্রভাব পড়ে; যেমন- প্রকৃত মোট দেশজ উৎপাদন, ম্যানুফ্যাকচারিং, খুচরা বিক্রয়, আয় ও কর্মসংস্থান। এ সূচকগুলোর পতন হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতীয় জিডিপিতে রূপান্তরিত হয়। তবে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে যদি কোনো দেশের জিডিপি ১০ শতাংশের বেশি কমে যায়, তাহলে তাকে ডিপ্রেশন বলে। মন্দার ঘটনার একটি কড়া উদাহরণ হলো গ্রেট রিসেশন। যেমন- ২০০৮ এবং ২০০৯ সালে পরপর চারটি ত্রৈমাসিক নেতিবাচক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল।
অন্য দিকে, মহামন্দা হলো- অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে কয়েক বছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি সঙ্কোচন। অর্থাৎ দীর্ঘ সময়ের জন্য ডিপ্রেশন থাকে ও আয়, উৎপাদন, খুচরা বিক্রয়- সবই বছরের পর বছর ধরে প্রভাবিত হয়। যেমন- ১৯২৯ সালের গ্রেট ডিপ্রেশন টানা ছয় বছরের জন্য জিডিপি নেতিবাচক হওয়ার কারণ হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, ১৯৩০-এর দশকে মহামন্দা এসেছিল, যাকে বলা হয় দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন।
নথিভুক্ত ইতিহাসে এখন পর্যন্ত বিশ্ব মাত্র একবার গ্রেট ডিপ্রেশনের মুখোমুখি হয়েছে। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল। সে সময় ওই দেশের উৎপাদন বাড়ে, কমে যায় বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতিও ছিল অনেক কম, ১ শতাংশের ঘরে। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায় ১৯৬৫ সাল থেকে। বাড়তে থাকে বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি। এ পরিস্থিতি ছিল ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। ১৯৮০ সালে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। এ সময়কেই বলা হয় দ্য গ্রেট ইনফ্লেশন। এর মধ্যেই অভিজ্ঞতা হয় স্ট্যাগফ্লেশনেরও।
মূলত এর পর থেকেই একটি আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভ‚মিকা কী হবে তা নির্ধারিত হয়; অর্থাৎ তখনই ঠিক হয় যে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম বড় কাজ। সেভাবেই ভূমিকা পালন করে আসছে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেড। উন্নত দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে আসছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন রোনাল্ড রিগ্যান ১৯৮১ সালে, সে সময়ের মূল্যস্ফীতি দেখে বলেছিলেন, ‘মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ছিনতাইকারীর মতো হিংস্র, সশস্ত্র ডাকাতের মতো ভয়ঙ্কর ও খুনির মতোই প্রাণঘাতী।’ উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে বাঁচতে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে অর্থনৈতিক মন্দাকে বেছে নিয়েছিল। মার্কিন ফেড মুদ্রা সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়, বাড়ায় নীতিনির্ধারণী সুদহার। তাতে কমে যায় উৎপাদন। মানুষের হাতে নগদ অর্থও হ্রাস পায়। এতে কমে চাহিদা। ফল হিসেবে ১৯৮৫ সালে মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছিল সাড়ে ৩ শতাংশে।
কোন পথে যাচ্ছে বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি?
একদিকে টানা দুই বছর বিশ্ব অতিমারীর প্রভাব অন্য দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এটিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না বলে রাশিয়া বনাম পশ্চিমা দেশগুলোর যুদ্ধ বললে বাস্তব অবস্থা আরো পরিষ্কার হবে যা পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। দু’টি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য- খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি উৎপাদন এবং সরবরাহ ব্যাহত করে বিশ্বকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সাথে তাইওয়ান নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধও হাতছানি দিচ্ছে। এতেও হয়তো জড়িয়ে পড়বে অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার অনেক দেশ। এক কথায়, বিশ্ব অর্থনীতির চিত্র যেন, জলে কুমির ডাঙায় বাঘ পরিস্থিতি। সুতরাং বিশ্ব অর্থনীতি এখন কোন পথে যাচ্ছে- এক কথায় এর উত্তর দেয়াটা সহজ নয়।
অর্থনীতিকে কোন পথে যেতে হবে, এ নিয়ে নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও আছে নানা মত। তবে সবাই একমত যে, সামনের সম্ভাব্য প্রতিটি পথই খারাপ; কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি। অর্থনীতিতে প্রভাব মূলত তিনটি- উচ্চ মূল্যস্ফীতি, স্ট্যাগফ্লেশন ও মন্দা। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস গত মাসে বলেছেন, বেশির ভাগ দেশই মন্দার দিকে। এমনকি বিশ্বে ১৯৭০ দশকের সেই স্ট্যাগফ্লেশনও ফিরে আসতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা গত সপ্তাহেই বলেছেন, বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন ও আরো অনিশ্চিত।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের সাথে অনেক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদসহ নানা পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ জড়িত। প্রতিষ্ঠানটির অর্থনীতিবিদদের মতে, সাধারণত পরপর দুই প্রান্তিকে অর্থনীতি সঙ্কুচিত হলে তাকেই মন্দা বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে পরপর দুই প্রান্তিকেই অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে, যদিও এখনো মন্দার ঘোষণা আসেনি। তবে মন্দা যে আসছে, তাতে সবাই কমবেশি একমত। সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনীতি কি মন্দার পথে, নাকি ফিরে যাচ্ছে স্ট্যাগফ্লেশন পেরিয়ে মহামন্দার দিকে?
প্রশ্ন হলো- তা যদি হয় তবে কবে থেকে? একের পর এক অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের শুরুতে বিশ্ব মন্দার ঝুঁকি আরো গুরুতর হবে। ব্লুমবার্গের অর্থনৈতিক মডেল বলছে, ২০২৪ সালে মন্দা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। জার্মানির ডয়েচে ব্যাংকের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দা দেখা দেবে ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলস ফারগো অ্যান্ড কোম্পানির মতে, মন্দা হবে ২০২৩ সালের শুরুতে আর জাপানের আর্থিক কোম্পানি নমুরা হোল্ডিং বলছে, মন্দা দেখা দেবে চলতি ২০২২-এর শেষ দিকেই।
উল্লেখ্য, আশির দশকে ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেড মন্দাকে বরণ করে নিয়েছিল। তবে এবার ফেডের চেষ্টা হচ্ছে, মন্দায় না ঢুকেই মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। কেননা, মন্দা দেখা দিলে উৎপাদন কমবে, কর্মসংস্থান কমবে, মানুষের আয়ও কমে যাবে। এ পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য মোটেই সুখকর হয় না যদিও মার্কিন অর্থনীতির জন্য মন্দা মোটেই নতুন কিছু নয়। বার্তা সংস্থা সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮৫৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মার্কিন অর্থনীতিতে ৩৪ বার মন্দা দেখা দিয়েছিল। এর অর্থ প্রতি পাঁচ বছর পরপর মন্দা দেখা দেয় আর গড়ে এর স্থায়িত্ব ১৭ মাস। তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ মন্দার কবলে পড়লে এর প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বে। কেননা, চীনের অর্থনীতিও সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপ পড়ে আছে তীব্র জ্বালানি সঙ্কটে।
আসলে, ২০১৯ সাল থেকে করোনা মহামারীর বিপর্যয়ের মুখোমুখি গোটা বিশ্ব। পৃথিবী এখনো তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেখা দেয়। এ যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ই গম এবং বার্লির মতো অনেক শস্যের প্রধান রফতানিকারক। যুদ্ধের কারণে তাদের পণ্য উৎপাদন এবং রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও হচ্ছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন যে, অনেক দেশের সামনেই খাদ্য সঙ্কট পরিস্থিতি।
এ মুহূর্তে গোটা বিশ্ব কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি। ভারতে মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, যা ১৯৯৮ সালের নভেম্বরের পর সর্বোচ্চ হয়। ইউরোপের অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত যা স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ১ শতাংশ, যা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অর্থাৎ সেই আশির দশকের উচ্চ মূল্যস্ফীতির পর এটিই সর্বোচ্চ। এবারের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফেড চলতি বছরে এখন পর্যন্ত চারবার সুদের হার বাড়িয়েছে। এর মাধ্যমে মুদ্রা সরবরাহ কমাতে চায় তারা। মূলত কোভিড-১৯-এর দুই বছরে চাহিদা ঠিক রাখতে মানুষের হাতে অর্থ তুলে দেয়া হয়েছিল। সেই অর্থই তারা ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে।
এর পরেও, সারা বিশ্বই মূলত তাকিয়ে থাকে ফেডের দিকে। সুদহার বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্ত সবার জন্যই একটি সঙ্কেত। তা ছাড়া প্রায় সব দেশই উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আছে, তাই সবাই অনুসরণ করছে ফেডকে। ফেডের চেয়ারম্যান জেরোমি পাওয়েল বলেছেন, মূল্যস্ফীতি না কমা পর্যন্ত তারা সুদহার বাড়িয়েই যাবেন। এখন অনেকেরই আশঙ্কা, ফেডের এই নীতিই আসলে মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতিকে।
আগেই বলেছি, আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ইতোমধ্যে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য চারবার সুদের হার বাড়িয়েছে। এতে বিশ্ব বাজারে ডলারের সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। ডলারের বিপরীতে প্রায় প্রতিটি দেশেই নিজস্ব মুদ্রার মান হারিয়েছে, এমনকি ইউরোপের মুদ্রা ইউরো প্রতি ইউনিট মান ডলারের চেয়েও কমে গেছে। ডলারের সরবরাহ কমে যাওয়ায় প্রতিটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। ফলে বেশ কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে দেউলিয়া ঘোষণা দিয়েছে ও আরো অনেক দেশ সেই দিকে এগোচ্ছে।
মন্দার চেয়েও যা ভয়াবহ অবস্থা
মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে এখন ফেডসহ সবাই সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এতেও যদি কাজ না হয়? যদি এমন হয় যে, মূল্যস্ফীতি মোটেই কমল না, বরং সঙ্কুচিত হলো অর্থনীতি। এ পরিস্থিতিকেই বলা হয় স্ট্যাগফ্লেশন। অর্থাৎ ইনফ্লেশন ও রিসেশনের মিশ্রণ, যা দেখা দিয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে। ওই সময়ে সৌদি আরব ও অন্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সমর্থক দেশগুলোর কাছে জ্বালানি তেল বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে এসব দেশের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। উৎপাদনও হ্রাস পায়। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৯ শতাংশ আর মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৫ শতাংশ। এটিই সেই কুখ্যাত স্ট্যাগফ্লেশন, যাকে অনেকেই সবচেয়ে কুৎসিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বলে মনে করেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে
বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর মন্দা বা স্ট্যাগফ্লেশন নির্ভর করে না। বরং বিশ্ব অর্থনীতিতে তা দেখা দিলে বাংলাদেশকেও মেনে নিতে হবে। সুতরাং এর অভিঘাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বা কৌশল ঠিক করাই হবে প্রধান কাজ। মার্কিন অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তারা আসলে ২০২১ সালে অতিরিক্ত খরচ করে ফেলেছেন। সুতরাং খরচ কমাতে হবে। বাংলাদেশও প্রণোদনা হিসেবে কম সুদে ঋণ দিয়েছে। সহজে পাওয়া এসব ঋণের একটি অংশ খেলাপি হয়ে গেছে, অর্থাৎ উৎপাদনে ব্যবহার হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহারও নির্দিষ্ট করে রেখেছে যদিও সুদহারের ওপর বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নির্ভর করে, তা অনেকেই বিশ্বাস করেন না। বরং ব্যাংকঋণ সস্তা হলে খেলাপি ঋণ বাড়ে। আর মুদ্রানীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এমনটিও দেখা যায়নি।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ মূলত রাজস্বনীতির ওপরই বেশি ভর করছে। এর আওতায় শুল্ক বাড়ানোর কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এতে কিছু বিলাসী পণ্যের আমদানি কমেছে ঠিকই, তা উল্লেখযোগ্য নয়। এ ছাড়া বেশ কিছু সাশ্রয়ী পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে যদিও অর্থনৈতিক তত্ত্ব বলে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাজস্বনীতি নয়, মুদ্রানীতিই বেশি কার্যকর।
তবে বৈশ্বিক প্রভাবের সাথে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক অব্যবস্থা দায়ী। দুর্নীতি, দেশ থেকে মুদ্রা পাচার, রাজনৈতিক বিরোধের ফলে পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিরোধীদের মতের অসহযোগিতা, সব মিলিয়ে যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। দেশীয় জ্বালানি অন্বেষণ না করে বিদেশী জ্বালানিনির্ভর হওয়া, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও অর্ধ লাখ কোটি টাকা প্রদান, তথ্য মতে, ১১ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার ইত্যাদি মাত্রা যোগ করেছে। অধিকন্তু, বাংলাদেশের ২০১৫ সালের চার হাজার ৯১০ কোটি বৈদেশিক ঋণ ২০২২ সালে এসে বহু গুণ বেড়ে ৯৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই ঋণের বেশির ভাগই মেগা প্রজেক্টের জন্য যা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি, ফলে এই প্রজেক্ট থেকে কোনো বেনিফিট শিগগিরই আসছে না। অথচ ২০২৩ সাল থেকেই এর সুদসহ ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে।
এ অবস্থায় অর্থনীতির চাপ সামলাতে আগামী দিনগুলোতে সরকারকে গভীর মনোযোগ রাখতে হবে বিশ্ব অর্থনীতির দিকে। পণ্যমূল্য কমতে শুরু হলেও তা অর্থনীতির মন্দার লক্ষণ। তৈরী পোশাক খাতও ক্রয়াদেশ আগের তুলনায় কম পাচ্ছে। প্রবাসী আয় আগের মতো আসছে না। আমদানি বেড়েই যাচ্ছে, যদিও সরকার আমদানি কমানোর বিভিন্ন উদ্যোগ ইতোমধ্যে নিয়েছে। তারপরও বৈদেশিক বাণিজ্যের পাশাপাশি চলতি হিসাবে হচ্ছে বিশাল ঘাটতি। আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত কমাতে গেলে দেশজ উৎপাদন ব্যাহত হয়ে রফতানিতে প্রভাব ফেলতে পারে; তার সাথে যোগ হচ্ছে বিদ্যুতে লোডশেডিং।
সুতরাং বৈশ্বিক ঘাটতির সাথে অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থা মিলে এক কঠিন অবস্থার পূর্বাভাস দিচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। আইএমএফের হিসাব মতে, তা ৩১ বিলিয়ন ডলার মাত্র। এ পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে মাত্র তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপ কমাতে সরকার আইএমএফের কাছে ঋণসহায়তা পেতে চিঠি দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে, আইএমএফের সাথে আলোচনা ও ঋণ পাওয়ার শর্ত নির্ধারণ করা।
শর্তের মধ্যে যদি থাকে জ্বালানির দাম বাড়ানো, ভর্তুকি কমানো, তাহলে তা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে, সীমিত আয়ের মানুষদের জীবনযাত্রা আরো কঠিন হবে। অন্য দিকে, করব্যবস্থা ও আর্থিক খাত নিয়ে বড় ধরনের সংস্কার অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে যদিও এ ক্ষেত্রে বাধা আসবে প্রভাবশালীদের দিক থেকে। সুতরাং বিশ্ব অর্থনীতির অভিঘাত থেকে দেশের অর্থনীতিকে কতটুকু রক্ষা করা যাবে, তা পুরোটাই নির্ভর করছে দেশের নীতিনির্ধারকদের ওপর। অর্থনীতির কঠিন এ সময়েও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না সরকার। সুতরাং মাঠের খেলোয়াড় একমাত্র সরকারই।
মন্দার বিপদ এড়াতে ব্যক্তিপর্যায়ে করণীয়
এমন অনেক কারণ রয়েছে, যা মন্দার আগেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই লক্ষণগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে, মন্দা আসার জন্য অপেক্ষা না করে, এর প্রভাব হ্রাস করার জন্য কোন ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। মন্দা যখন দেখা দেয় তখন বেকারত্ব দেশের প্রবণতা হয়ে ওঠে। বেকারত্বের হার বৃদ্ধির কারণে ক্রয় ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ব্যবসায় প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যক্তিরা দেউলিয়া হয়ে যায়, তাদের আবাসন সম্পত্তি হারায়। কারণ তারা আর ভাড়া পরিশোধ করতে পারে না। বেকারত্ব তরুণদের শিক্ষা ও ক্যারিয়ার পছন্দের জন্য নেতিবাচক। উৎপাদন শিল্পে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। নির্মাতারা বড় অর্ডার পাওয়ার পরও সময়ের সাথে সাথে অর্ডার কমে যায়, নির্মাতারা লোক নিয়োগ বন্ধ করে দেয়। ভোক্তাদের চাহিদা পায়। বিক্রয় হ্রাস পায়।
মন্দার বিপদ এড়াতে সবার আগে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে হবে। খরচ কমিয়ে জরুরি তহবিল গঠন করা খুবই জরুরি। অন্তত বেঁচে থাকার জন্য প্রতি মাসে আপনার কত টাকা প্রয়োজন তা হিসাব করুন। চেষ্টা করা উচিত যে, আপনার অন্তত ছয় মাসের খরচের জন্য একটি জরুরি তহবিল রয়েছে। ক্রেডিট কার্ড, ধারে লেনদেন এড়িয়ে চলা জরুরি। শেয়ারবাজার, ক্রিপ্টোর মতো অস্থির খাতে বিনিয়োগ এড়িয়ে চলতে হবে। অন্য দিকে, সোনা এ ধরনের খারাপ সময়ের জন্য খুব ভালো বিনিয়োগ হিসেবে প্রমাণিত হয়।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক