ডিজেল, পেট্রল, অকটেনের দাম একবারে ৪৫ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। এই দাম বাড়ানোর ফলে ভোক্তা জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে পরিবহন খাতের মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রাস্তায় নেমেছে প্রতিবাদী মানুষ। তারা মিছিল করছে। সরকারের কাছে জবাব চায় তারা কেন এতটা দাম বাড়ানো হলো।
জনগণ সেটা চাইতেই পারে, কেননা সেটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। সরকারকে তার জবাব দিতে হবেই। কিন্তু এ-নিয়ে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে সেটা সরকারপক্ষ অনুধাবন করতে পারছেন বলে মনে হয় না। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ধাপে ধাপে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালে ভোক্তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া বেশি হতো। প্রতি মাসেই দাম ১০ টাকা করে বাড়াতে হতো। ফলে সেই বৃদ্ধিতে নাখোশ হতো জনগণ। তাদের ওপর আর্থিক চাপ আরো বাড়ত।
অন্য দিকে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই পরিচালক হাসিনা নওয়াজ ঠিক উল্টো কথা বললেন। তিনি বলেছেন, ধাপে ধাপে দাম বাড়ালে শিল্পপতি ব্যবসায়ী এমনকি সাধারণ মানুষের একটা প্রস্তুতি থাকত এবং তখন পরিস্থিতি সবার জন্য সহনীয় হতো। (নয়া দিগন্ত/আগস্ট ১১/২২)
এই উভয়পক্ষ, সরকার ও শিল্পপতিদের লক্ষ্য কিন্তু একই, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। দাম বাড়ানোর ফলে যে বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে গণমানুষ, সেই অবস্থা থেকে রেহাই দেবার কোনো পদক্ষেপই নেয়নি সরকার। তাদের কেন্দ্রীয় বা মূল চিন্তা হচ্ছে জ্বালানির দাম বাড়ানো। সেখানে জনগণ তাদের চিন্তার বাইরে। সরকার ও শিল্পপতিদের চিন্তাভাবনার মধ্যে এক ছটাক পরিমাণও নেই মমত্ব ও সহানুভবতা। জনগণের প্রতি তাদের কোনো কমিটমেন্টও নেই। কেবল রাজনীতির সময় ওই অস্পর্শযোগ্য উপাদানের কথা প্রকাশ্য জনসভায় প্রদর্শন করেন, যা মূলত মেকি বা ভিত্তিহীন।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাত এসে পড়ে সরাসরি ভোক্তা জনগণের ওপরে। বিষয়টি পরিষ্কার করা জরুরি। কারণ সরকার ও তাদের ব্যবসায়ী অ্যালিগণ সব সময় দোষ চাপান তৃতীয়পক্ষের ওপর। যেমন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে, অতএব বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। করপোরেশন বেশি দামে জ্বালানি কিনে এনে তো আর কম দামে বিক্রি করতে পারে না। তার তো মুনাফা দরকার। মুনাফা না হলে তো করপোরেশন লাটে উঠবে। যুক্তি হিসেবে তা অকাট্য। কিন্তু বিপিসি তো সরকারি কোম্পানি। সরকারের কোম্পানি হলে তা জনগণের মালিকানার, নাকি? জনগণের টাকায় কেনা জ্বালানির দাম ব্যবহারকারীদের কাছে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করলে তার খেসারত ভোক্তা জনগণের ওপরই গিয়ে পড়বে। জ্বালানির দাম বাড়ানোর অভিঘাতটি তাই জনগণ ভোগ করছে প্রতিদিন। সব কিছুর দাম বেড়েছে। দাম বেড়েছে ৭০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত। সৃষ্টি হয়েছে বাসভাড়ায় নৈরাজ্য। যে যেভাবে পারছে ভাড়া নিচ্ছে।
ভুক্তভোগী জনগণ রাস্তায় নামলেই বলা হবে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। সরকার মিছিলকারীদের সহ্য করতে অভ্যস্ত নয়। তাদের কৃতকর্মের সমালোচনা মানেই বিশৃঙ্খলা, ভাঙচুর, জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করার কথা বলা হয়। বলা হয়, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গেলেই পুলিশি বাধা অবধারিত এবং তা সরকার উৎখাতকর্মের ষড়যন্ত্রের ফল। এই মনন ও মানসিকতা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের সৃষ্টি। পাকিস্তানি শাসনের পর এই রাজনৈতিক লিগ্যাসি আমাদের মজ্জায় চিরস্থায়ী হয়েছে।
কাঁচাবাজারের একটি পণ্যের দাম শোনাই আপনাদের। গত (১০ আগস্ট, ২২) সন্ধেবেলায় কাঁচামরিচ কিনতে গিয়েছিলাম। এখন দোকানিরা আর দাম কেজিতে বলে না। বলে আড়াইশ বা বলে একশ গ্রাম হিসেবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাঁচামরিচের কেজি কত? উত্তর পেলাম আড়াই শ’ গ্রাম ৭০ টাকা। তার মানে কেজি ২৮০ টাকা। নিশ্চয়ই হোলসেল মার্কেটে এত দামে বিক্রি হয় না কাঁচামরিচ। আমার বাসায় রংমিস্ত্রি কাজ করছিল। সে জানাল, কাওরান বাজারে ১৬০ টাকা করে সে কিনেছে। সেটা নিয়মিত বাজার, হোলসেল বাজার নয়। পত্রিকায় পড়েছি, কাঁচামরিচ ভারত থেকে আমদানি করায় নাকি দাম কমেছে।
আমদানি করলে দাম কমে। আমদানি করলে তো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়বে। সরকার বলেছেন, সেপ্টেম্বরে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আসছে। তখন আর লোডশেডিং করতে হবে না। এর পাশাপাশি পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে কয়লায়। সেখান থেকে পাওয়ার কথা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এছাড়া আরো বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোমাত্রায় চালু হলে লোডশেডিং জাদুঘরে পৌঁছে যাবে আবারো। গত ২১ মার্চ পায়রা উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন ঘোষণা করেন। তারপরের ইতিহাসের রাজসাক্ষী ভোক্তা/ব্যবহারকারী জনগণ লোডশেডিংয়ের সুপার আলোয় ভেসে বেড়াচ্ছে।
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ব্যাখ্যা আর শিল্পপতি ব্যবসায়ীদের ব্যাখ্যায় তারতম্য আছে। তবে, তারা একটি জায়গায়ই যেতে চান। কিন্তু জনগণ ওই দুই পক্ষের কোনো পক্ষেই নেই। জনগণ আছে তাদের পক্ষে। যেমন জ্বালানি ডিজেলের ব্যবহার পরিবহন সেক্টরে বেশি, দ্বিতীয় স্থানে উৎপাদক কৃষকের। দাম বাড়ায় তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাবে, যা কাঁচামরিচের মূল্যবৃদ্ধি থেকেই অনুমান করতে পারছি। চাল, ডাল, নুন, মরিচসহ শত রকমের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামের আর্থিক চাপে এর মধ্যেই ছাতু হবার জোগাড় সাধারণ মানুষের। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাহেব তো জ্বালানির মূল্য এক লাফে বাড়িয়ে দিয়ে জনগণের ওপর আর্থিক চাপ সহনীয় করার পন্থায় নিয়েছেন। আর জনগণ আছে তারই নিচে। এটা তিনি বা সরকার উপলব্ধি করতে পারছেন না।
এর কারণ কী?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন কমে আসছে তখন বাংলাদেশ সরকার দাম বাড়াচ্ছে। আর যখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি ডিজেলের দাম বেড়ে ১৭০ ডলার পর্যন্ত হয়েছিল, তখন সরকারের টনক নড়েনি। তখন ভর্তুকি দিয়েছে।
এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে এসেছে বা অর্থে টান পড়েছে। এখন সরকার সেই টান থেকে বাঁচতে দাম বাড়ানোর টেকনিক নিয়েছে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের জন্য অর্থ প্রয়োজন। জ্বালানি তেলের দাম একধাপে বাড়ানোর পেছনে এ সব বিষয়কে বড় কারণ হিসাবে দেখেন বিশ্লেষকরা।
জ্বালানি খাতের একজন বিশ্লেষক অরুণ কর্মকার বলেন, জ্বালানি খাত থেকে রাজস্ব বাড়ানো অন্যতম একটি টার্গেট বলে তার ধারণা। এই দাম বাড়িয়ে সরকার পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বা বিপিসিকে কিছু লাভ বা মুনাফা দিতে চাইছে। একই সাথে উদ্দেশ্য হচ্ছে সেখান থেকে সরকারেরও রাজস্ব কর আদায় বাড়ানো।
তিনি উল্লেখ করেন, জ্বালানি পণ্য থেকে সরকার ৩৫ শতাংশ কর পেয়ে থাকে। এখন দাম বাড়লে সরকারের আয় আরো বাড়বে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিপিসির হাতে এখন ১৯ হাজার কোটি টাকা মজুদ আছে এবং এই টাকা দিয়ে দু’মাস তেল আমদানি করা যাবে। এরপর তেল আমদানির অর্থ নেই।
অরুণ কর্মকার মনে করেন, সরকারের এই তথ্য ঠিক হলেও তাদের শেষ মুহূর্তে জুলাই মাসের শেষে সেই হিসাব না করে অনেক আগেই তা বিবেচনা করা উচিত ছিল। এখন পেট্রল ও অকটেনের যে পরিমাণ দাম বাড়ানো হয়েছে, তাতে বিপিসির ৪৫ টাকার বেশি মুনাফা থাকবে। শুধু ডিজেলে লিটারপ্রতি আট টাকার মতো ভর্তুকি দিতে হবে।
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বিশ্ববাজারের জ্বালানি তেলের দাম আরো কিছুটা কমলে দেশে আবারো দাম কমানো হবে। (নয়া দিগন্ত/১১ আগস্ট, ২২)
বাংলাদেশে দাম কখনো কমানো হয়েছে, এমন নজির বিরল। অন্তত আমার মনে পড়ছে না সে-রকম তথ্য। হয়তো খুঁজে দেখলে মিলতেও পারে সেই অমূল্য তথ্য-রতন। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে এ কথা বলার জন্য ধন্যবাদ জানানো যেত, কিন্তু তার বর্তমান সহকর্মী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা ও অতীতের সরকাররা ওই রকম ওয়াদা জাতিকে বহুবারই দিয়েছেন, কিন্তু তার টিকি বা লেজ, কখনোই চোখে পড়েনি।
তা না পড়ুক, সরকার তো স্বীকার করছেন বিপিসির তহবিলে এখন ১৯ হাজার কোটি টাকা আছে। তার মানে দাম বাড়ানোর আগেও বিপিসি লাভ করেছে। যখন তেলের ব্যারেলের দাম ছিল, দীর্ঘদিন ছিল ওই নিম্নতম স্তরে, (৩৫ ডলার ) তখনো দেশে জ্বালানির দামে ছাড় দেয়নি বিপিসি। মানে করপোরেশন তার লাভের জায়গা থেকে সরে আসেনি। জনগণের করপোরেশনকে সে লাভের মাথাটি দেখাবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। কিন্তু তার সেই লাভের অংশটি আজ কোথায়?
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ২০২১-এর ৯ সেপ্টেম্বরে প্রথম আলোর লেখায় বলেছেন, গত সাত বছরে বিপিসির মুনাফা জমেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।… মুনাফার টাকা কোথায়? না, বিপিসির হাতে নেই, সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার উদ্বৃত্ত অর্থ প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা সরকার সম্প্রতি তুলে নিয়েছে, এর মধ্যে এই টাকাও আছে। কেন? কারণ সরকারের মেলা খরচ, দেশে সব সেতু, সড়ক, রেলপথ, ভবনসহ প্রকল্পের খরচ দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই বিশ্বের প্রধান অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থেকেও বেশি। দুর্নীতি আর অপচয়ের অনিয়ন্ত্রিত ঊর্ধ্বগতিতে মুহিত সাহেবের ভাষায় ‘সাগরচুরি’ হতে থাকলে সেই টাকা তো কোথাও না কোথাও থেকে জোগাড় করতে হবে। তাছাড়া স্যাটেলাইট কিনতে হয়, সাবমেরিন কিনতে হয়, বিলাসী বিদেশ সফরের সুযোগ দিতে হয় তল্পিবাহক লোকদের, আরাম-আয়েশ বাড়াতে হয় সরকারের লোকজনদের। টাকা তো লাগবেই। এসবের জন্য সরকার যত জায়গায় সম্ভব কর, শুল্ক, ফি, দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে। তাই ডিজেলের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেওয়া।’
এরপর আর কী বলা যায়? ইতোমধ্যেই বাজেটের যে ঘাটতি তা মেটানোর বাড়তি কোনো পথ নেই। দেশের ব্যাংকগুলোর দশাও যে করুণ, তা ব্যাংকারদের অসহিষ্ণু আচরণ প্রমাণ করে। বৈদেশিক ঋণের সুদ আর অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ গুনতেই তো বিশাল অঙ্কের টাকা চলে যাবে। বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণের সুদ আর আসল মিলিয়ে যে পরিমাণ ডলার ব্যয় হবে তাতে করে রিজার্ভের ওপর যে চাপের কথা বলা হচ্ছে, তাকে অসহনীয় বলতে হবে। অর্থনীতিবিদগণ যে সব কথা বলছেন, তা মাথায় নিলে দেশের অবস্থা ভালো হবে। না নিলে খারাপ হবে। বাকোয়াজ বাদ দিয়ে যাতে সঙ্কট মোকাবিলা করা যায়, জনগণকে রক্ষা করা যায়, সেই পথ বের করাই এখন প্রধান জরুরি কাজ।
আমদানিনির্ভর অর্থনীতিকে রফতানিমুখী অর্থনীতিতে পরিণত করা যায় কিভাবে, সেই পথ বের করতে পারলে জনগণকে জিম্মি হতে হয় না। কাজটা সরকারের। আমরা তো চাই অপ্রয়োজনীয় আমদানিই কেবল নয়, প্রয়োজনীয় খাতের জন্য নিজস্ব উৎপাদন বাড়াতে পারলে, সঙ্কট এড়ানো সম্ভব। বিকল্প জ্বালানিসহ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সেক্টরের সমস্যা সমাধানে যাওয়া যায়। সোলার প্যানেল করে দেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরকে স্বয়ম্ভর করা যেতে পারে। আগামী দিনগুলোতে ছোটবড় শিল্পকারখানাগুলোকে সোলার এনার্জির অধীনে নিয়ে যেতে হবে, সাগর ও নদীর উপক‚লে টারবাইনযুক্ত বায়ুচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের জন্য নতুন সম্ভাবনা আনতে পারে। মুষ্টি ভিক্ষার চাল দিয়ে যেমন দারিদ্র্য দূর করা যায় না, তেমনি আমদানি করে সমস্যা চাপা দেয়াও যায় না।