‘ভাই অবশ্যই তোপাকপি প্যালেসে যাবেন। সেখানে মূসা (আ:)-এর বিখ্যাত লাঠিটি আছে। টিকিট কিন্তু ৪৫০ লিরা (টাকায় সাড়ে তিন হাজার টাকা)’। মূসা (আ:)-এর সেই লাঠিটি ইস্তাম্বুলে এসে দেখব না এটা কী করে হয়। আল্লাহর নির্দেশে যে লাঠির আঘাতে লোহিত সাগরের পানি দুই ভাগ হয়ে রাস্তা তৈরি হয়েছিল, যে লাঠি মাটিতে রাখলে সাপ হয়ে যেত, এত কাছে এসে কেন সেই নিদর্শন স্বচক্ষে দেখতে যাবো না। তাই তুরস্ক প্রবাসী বাংলাদেশী হাফিজুল ইসলামের কাছে তথ্যটি পেয়ে টাকার চিন্তা আর মাথায় নিইনি। লম্বা সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে তোপাকপি প্যালেসের জাদুঘর অংশে প্রফেট হাউজে (নবীর ঘর) ঢুকে তো রীতিমতো বিস্মিত। শুধু মূসা (আ:)-এর লাঠিই নয়, এই ঘরে সংরক্ষিত আছে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর পানি খাওয়ার বাটি, দাড়ি, দাঁত, যুদ্ধে ব্যবহৃত তরবারি, তরবারির খাপ, তীর ছোড়ার ধনুক। সে সাথে হজরত দাউদ (আ:)-এর তরবারি। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে দাউদ (আ:)-কেই আল্লাহ তায়ালা প্রথম শিখিয়েছেন লোহার ব্যবহার। অটোমান সাম্রাজ্যের সময় মিসর থেকে ইস্তাম্বুলে নিয়ে আসা হয় নবী ও খলিফাদের ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো।
তুরস্কের সাবেক রাজধানী ইস্তাম্বুল। অটোমান বা উসমানীয় সালতানাতের সময় বসফরাস প্রণালীর দুই প্রান্তে অবস্থিত এই ইস্তাম্বুল ছিল দেশটির রাজধানী। পরে রাজধানী আঙ্কারায় স্থানান্তরিত হয়। এই ইস্তাম্বুলের ফাতি জেলায় অবস্থিত তোপাকপি প্যালেস ও জাদুঘর। মেট্রো বা বাসে নামতে হবে সুলতান আহমেদ স্টেশনে। সেখানেই পাশাপাশি অবস্থিত সুলতান আহমেদ মসজিদ বা ব্লু মসজিদ, হাজিয়া সোফিয়া মসজিদ এবং তোপাকপি প্যালেস ও জাদুঘর। একেবারেই বসফরাস প্রণালী লাগোয়া এই তোপাকপি প্যালেসের অবস্থান। তুর্কি সেনাপতি ফাতি জয় করে ছিলেন এই হাজিয়া সোফিয়া। তাই তার নামে এই জেলা। তোপাকপি মানে কামানের গেট। ১৫ ও ১৬ শতকে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রধান কার্যালয় এবং সম্রাটের বাসস্থান ছিল এখানে।
জাদুঘরে অটোমান সুলতান আহমেদের সিংহাসন, তার সভাকক্ষ আছে। তবে যত কড়াকড়ি ‘নবীর ঘরে’ প্রবেশের সময়ই। প্রবেশপথেই তুর্কি নিরাপত্তারক্ষীদের উচ্চৈঃস্বরে বারবার ঘোষণা, ‘কোনো ছবি তোলা যাবে না। করা যাবে না ভিডিও।’ সে সাথে কাউকে বেশিক্ষণ দাঁড়াতেও দেয় না এক স্থানে। পাশাপাশি খেয়াল রাখছে কেউ ছবি তুলছে কি না।
প্রফেট হাউজে প্রবেশের সময় সব মহিলাকে মাথায় ওড়না দিতে হবে। কারো ওড়না না থাকলেও সমস্যা নেই। প্রবেশপথেই রাখা আছে প্রচুর ওড়না। তা মাথায় দিয়ে অন্য গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় তা খুলে জমা দিতে হয়। তবে খুবই দুঃখজনক বিষয়- কিছু মহিলা এমন পোশাকে আসে যা বিব্রতকর। সবার জন্য আসলে মাথা ঢাকারই বাধ্যবাধকতা।
প্রফেট হাউজে ঢুকতেই চোখে পড়বে ইমাম হোসেন (রা:)-এর জামা। যিনি মহানবী সা:-এর নাতি এবং হজরত ফাতেমা (রা:)-এর ছেলে। অনেকটা হাফ শার্ট আদলে সাদা রঙের জামা। পাশেই ফাতেমা (রা:)-এর জামা। ফাতেমা (রা:)-এর জামার ডান দিকের নিচের অংশ ছিঁড়ে গেছে। অনেকটা সাদা রঙের এই জামা। কাচ দিয়ে ঘেরা জামা দু’টি। অন্য সব সরঞ্জামও কাচ দিয়ে ঢাকা। এরপরই বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের তরবারি। সাথে আরো দুই সাহাবির তরবারি।
এরই বাম পাশে রাখা মূসা (আ:)-এর লাঠি। কালো রঙের লাঠিটিতে বেশ কয়েকটি খাঁজ আছে। হালকা বাঁকানো চিকন আকৃতির লাঠিতে ঢালের আরেকটি অংশের সংযুক্তি। এর একেবারেই পাশে রাখা দাউদ (আ:)-এর তরবারি। রয়েছে ইউসুফ (আ:) এবং ইয়াহিয়া (আ:)-এর একটি নিদর্শন। তবে এই নিদর্শনগুলো কী তা বোঝা যায়নি।
এরপরই মহানবী সা:-এর ব্যবহৃত জিনিস। নবীজির পানি পানের বাটির বাইরের অংশ ডিজাইন করা। সাথে আরবি লেখা। ধনুকের সাথে এর খাপও আছে। ধনুকটি সেভাবেই রাখা হলেও খাপটি ডিজাইনে আবৃত। মহানবীর তরবারির হাতলে ডিজাইন করা এবং তরবারির খাপেও তাই। তবে তাঁর দাড়ি এবং দাঁতের পাত্র এমনভাবে ডিজাইন করা যে, রুমের অল্প আলোর কারণে দাড়ি ও দাঁত ঠিকমতো দেখা যায় না। রাখা আছে পায়ের ছাপ। সোনালি রঙের পাত্রের মধ্যে সেই ছাপ। ফলে ছাপটাও সেই রঙ ধারণ করেছে। প্রফেট হাউজে সংরক্ষিত আছে মহানবী সা:-এর ব্যবহৃত সিলমোহরও। এরপর রাখা হয়েছে ইসলামের চার খলিফা হজরত আবু বকর (রা:), হজরত ওমর (রা:), হজরত উসমান (রা:) এবং হজরত আলী (রা:)-এর তরবারি। উসমান (রা:)-এর তরবারি একটু চিকন। আলীর (রা:)-এর তরবারি একটু চওড়া আকৃতির। এ ছাড়া কাবা শরিফের দরজার চাবি এবং একটি কাঠের খুঁটিও সংরক্ষণে আছে তোপাকপি জাদুঘরে।
ছবি তোলা নিষেধ হলেও জাদুঘর থেকে বের হয়ে ফের প্রবেশমুখে এসে দূর থেকে ইমাম হোসেন (রা:)-এর জামার ছবি তোলার সুযোগ হয়েছে।