রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৮ পূর্বাহ্ন

ভারতে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানো হচ্ছে

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০২২
  • ১১২ বার

ভারতে সংখ্যালঘু বিশেষত মুসলমানদের সাথে যে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে, তা ভারতের কল্যাণকামী মানুষের মাঝে দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। এদেরই একজন ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজন, যিনি সম্প্রতি বেশ সহমর্মিতা ও অন্তর্জ্বালা নিয়ে এমন কিছু কথা বলেছেন, যেগুলো নিয়ে প্রতিটি সাচ্চা ভারতীয়ের ভাবা উচিত। তিনি রায়পুরে এক কনফারেন্সে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানোর যেকোনো প্রচেষ্টাই দেশের জন্য কল্যাণকর হবে না। এটা দেশকে টুকরো করে দেবে।’ তিনি এ কথাও বলেন যে, ‘শক্ত অর্থনীতির জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও আবশ্যক। এটা ব্যতিরেকে আমরা দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব না।’ রঘুরাম রাজনকে দেশের সেসব সচেতন কর্মকর্তার একজন হিসেবে গণ্য করা হয়, যারা নিজেদের চোখ-কান খোলা রাখেন এবং কারো অন্ধভক্ত হন না।

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তার পরিচিতি বেশ সুদৃঢ়। তিনি উপরিউক্ত কথাগুলো এমন এক সময় বলেছেন, যখন দেশের ভেতর সংখ্যালঘু এবং বিশেষত মুসলমানদের কোণঠাসা করার চেষ্টা প্রবল। এমন গোষ্ঠীকে প্রকাশ্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও শত্রুতার ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। কষ্টের বিষয় হচ্ছে, সরকার এই বিপজ্জনক গোষ্ঠীর প্রতি চোখ বুজে রেখেছে এ কথা ভেবে যে, এদের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদের অ্যাজেন্ডা শক্তি অর্জন করবে। সরকারের ঢিলেমিপনার ফলেই দিন দিন মুসলমানদের তাদের ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে টার্গেট করা হচ্ছে এবং তাদের হেয় করার চেষ্টা হচ্ছে। মিডিয়ার একটি বড় শ্রেণী এমন সুযোগের সন্ধানে সদা তৎপর। এর ভিত্তিতে তারা যেন মুসলমানদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে এবং তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরি করতে পারে। এ বিষয়ে কেউই নিরাপদ নয়। কোনো সাধারণ মুসলমান হোক কিংবা এমন কোনো ব্যক্তি যিনি তার সারাটি জীবন দেশের সেবায় ব্যয় করেছেন, কেউই এই উগ্রপন্থীদের কাছে নিরাপদ নয়।

আপনারা দেখেছেন, এর আগে কিভাবে পাকিস্তানের নাম নিয়ে অর্বাচীন ভঙ্গিতে সাবেক উপরাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ হামিদ আনসারিকে আঘাত করা হয়েছে। এ কাজ অন্য কেউ নয়, স্বয়ং বিজেপির এক মুখপাত্র সম্পূর্ণ নির্লজ্জতার সাথে করেছে। বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মাও এক টিভি আলোচনায় রাসূলুল্লাহ সা:-এর অবমাননার অপরাধ করল। আজ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বরং তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ কার্যক্রমের ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যখন ভারতের মর্যাদা হানি হলো এবং বহু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিবাদ করল, তখন অবশ্য সরসারি দফতরগুলোতে একটু অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এ বাস্তবতাকে স্বীকার করেছেন যে, এ ঘটনার দ্বারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতের মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার যদি এ বিষয়ে বিবেচক হতো, তাহলে তারা এমন গোষ্ঠী, যাদের তারা ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’ (প্রান্তিক উপাদান) নাম দিয়েছিল, তাদের শক্ত বার্তা দিয়ে দিত। কিন্তু তা হয়নি। ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ওই গোষ্ঠীর চক্রান্ত আজো অব্যাহত রয়েছে।

বাস্তবতা হলো, দেশে তৎপর হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীকে প্রশাসনে বসিয়ে সা¤প্রদায়িক গোষ্ঠীর পরিধি বাড়ানো দেশের জন্য কল্যাণকর ভাবা হচ্ছে। কিন্তু একটি শ্রেণী এমনও আছে, যারা দেশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও সহিংসতার ধ্বংসাত্মক পরিণতি অনুধাবন করে কখনো কখনো সেসব বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেন। রঘুরাম রাজন দেশের সেই কল্যাণকামীদেরই একজন, যিনি প্রায়ই নিজের বক্তৃতার মাধ্যমে এই বিপদ সম্পর্কে দেশ ও জাতিকে সতর্ক করেন। তিনি গত জুলাইয়ের শেষে রায়পুরে অল ইন্ডিয়া প্রফেশনাল কংগ্রেসের পঞ্চম বার্ষিক কনভেনশনে বক্তৃতা করতে গিয়ে সতর্ক করেন যে, ‘উদারপন্থী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তার প্রশাসনিক দফতরগুলো সুদৃঢ় করার মাঝেই আমাদের ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘উদারনীতি ধর্মবিরোধী নয়। প্রতিটি ধর্মের বৈশিষ্ট্য সবকিছুর মাঝে ভালো অনুসন্ধান করা।’ তিনি তার বক্তৃতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ কথাটিও বলেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ একনায়কতন্ত্রের মোকাবেলা করে আমাদের তাকে পরাজিত করতে হবে। একটি বড় সংখ্যালঘুকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানোর যেকোনো চেষ্টাই দেশকে বিভক্ত করে দেবে। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, যা আমাদের দুর্বল করে দেবে।’ তিনি বলেন, ‘আজ দেশের কিছু মহলে এই অনুভ‚তি স্থান করে নিয়েছে যে, গণতন্ত্র ভারতকে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতের জন্য এক সুদৃঢ় একনায়কতন্ত্রের প্রয়োজন যেখানে নিয়ন্ত্রণের ভারসাম্য থাকবে। মনে হচ্ছে, আমরাও সেই দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমি স্বীকার করি, এ যুক্তি একেবারে ত্রুটিযুক্ত।’

এ কথা সবাই জানেন যে, ২০১৪ সালে নতুন সরকার গঠনের পর বেশ দ্রুততার সাথে গণতন্ত্র, সেক্যুলার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের মতো শব্দগুলোকে ধারাক্রমে খুন করা হচ্ছে এবং যেসব নেতা সেক্যুলারিজম ও ঐক্যের পথে পদচারণা করে দেশকে এ পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে, তাদের কীর্তি খর্ব করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করা হচ্ছে না। তাদের অর্জনগুলোর নাম পরিবর্তনের অভিযান এখন বেশ চাঙ্গা। গণভাবে এ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা হচ্ছে যে, এ দেশে যা কিছু হয়েছে, সেটি মূলত ২০১৪ সালের পরেই হয়েছে। বলা যায়, এর আগে ভারতে উন্নতি ও সমৃদ্ধির ছিটেফোঁটাও ছিল না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীন ভারতের সেক্যুলার নির্মাতারা যে মজবুত স্তম্ভের ওপর এর ভিত্তি দাঁড় করিয়েছিলেন, তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় স্তম্ভ ছিল গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজম। আর এ ভিতকে অবলম্বন করেই এ দেশ এতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছে। অথচ সে যুগেও সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব ও দাঙ্গা-ফাসাদ অব্যাহত ছিল। কিন্তু দেশের ভিতগুলো দুর্বল হতে দেয়া হয়নি। আজ দেশে গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম ও ব্যক্তিস্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি বিপদের সম্মুখীন।

এখন আসুন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সা¤প্রতিক এক বক্তব্যের প্রতি একটু নজর দিই। তিনি অল ইন্ডিয়া সুফি সাজ্জাদানাশিন কাউন্সিল নামক সংগঠনের আয়োজনে নতুন দিল্লিতে সা¤প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য অনুষ্ঠিত আন্তঃধর্মীয় কনফারেন্সে ওই বক্তব্যটি দিয়েছিলেন। এ সংগঠনের নাম আমরা প্রথম শুনলাম। এ জন্য আমরা এটা বলতে অপারগ যে, এ সংগঠন কবে, কোথায় ও কিভাবে অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং এর পেছনে কারা আছেন? তবে এতটুকু অবশ্যই বলা যায় যে, ওই কনফারেন্সে সেই লোকেরাই বেশি অংশগ্রহণ করেছেন, শাসক দলের সাথে যাদের সখ্যতা কারো কাছে গোপন নেই। ওই কনফারেন্সে অজিত দোভাল বলেন, ‘কিছু মানুষ ধর্মের ভিত্তিতে সমাজে বিদ্বেষ বৃদ্ধি করতে চাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা নীরব দর্শক হতে পারি না। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোচ্চার হতে হবে এবং ভুলগুলো সংশোধন করতে হবে।’ তিনি এ কথাও বলেন যে, ‘যেভাবে কিছু মানুষ ধর্মের নামে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে যাচ্ছে, সেটি বেশ ভয়ঙ্কর। দেশে-বিদেশে এর প্রভাব পড়বে। আমাদের বিভ্রান্ত লোকদের শুধু বোঝালেই হবে না, বরং তাদের সংশোধনও করতে হবে।’

তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘দশের ঐক্য নিয়ে কেউ টানাহেঁচড়া করলে, সেটি ভুল হবে। দেশ সবার আগে।’ অজিত দোভাল ও রঘুরাম রাজনের চিন্তার মাঝে মৌলিক পার্থক্য এটাই যে, রঘুরাম স্পষ্টভাবে ওই সব গোষ্ঠী ও বিপদাপদ চিহ্নিত করেন, যাদের দ্বারা দেশের ঐক্য হুমকির মুখে রয়েছে। পক্ষান্তরে দোভাল জাতীয় ঐক্যের মূল শত্রুদের লক্ষ্য করে কথা বলার জন্য সুফিদের প্লাটফর্ম খুঁজছেন। যে কথাগুলো দোভালের প্রান্তিক উপাদানের মাঝে বলা উচিত, সে কথাগুলো সুফিদের মাহফিলে বলার কী উপকারিতা রয়েছে? মোট কথা রঘুরাম রাজন সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানোর যে শঙ্কা থেকে দেশ ও জাতিকে সতর্ক করেছেন, তার প্রতি যত দ্রুত ধ্যান দেয়া যাবে, দেশের ভবিষ্যতের জন্য ততটাই উত্তম হবে। কেননা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠকে এভাবে কোণঠাসা করে কখনোই এ দেশের কল্যাণ বয়ে আনা যাবে না।

মুম্বাই উর্দু নিউজ ০৭ আগস্ট, ২০২২ থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com