বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪, ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১ ও ২০১১ সাল দেশে এ পর্যন্ত পাঁচটি আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের সর্বশেষ আদমশুমারি ছিল ২০১১ সালে। তখন দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি ৪০ লাখ নথিবদ্ধ করা হয়েছিল। দীর্ঘ দিনের ‘আদম শুমারি’ পরিবর্তন হয়েছে জনশুমারিতে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২’ প্রকাশ করেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- দেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা আট কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন, নারীর সংখ্যা আট কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ১২ হাজার ৬২৯ জন।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর দেশের মানুষের সংখ্যা তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন মহল। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও লোকসংখ্যা গণনার এই তথ্য নিয়ে বিস্তর বিতর্ক শুরু হয়েছে। তারা এই গণনার প্রতিবেদনটি মানতে নারাজ। গণনা ‘সঠিক হয়নি’। বলছে, দেশের জনসংখ্যার সঠিক তথ্য না থাকলে যথাযথভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না, জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নসহ যেকোনো নীতিকৌশল নির্ধারণে জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য থাকা অত্যন্ত জরুরি। এর ভিত্তিতেই দেশের মোট খাদ্যসহ সব পণ্যের চাহিদা নিরূপণ, সরবরাহ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা নেয়া হয়।
ফলে জনসংখ্যার সঠিক তথ্যের অভাবে এ ধরনের যেকোনো পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। তারা আরো বলছে, বর্ষা মৌসুমে শুমারি করা ঠিক হয়নি, জনসংখ্যার হেরফেরের কারণে মাথাপিছু আয় বেড়ে যায়। এ কারণে বিদেশী সহায়তা, ঋণ, অনুদান ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সুবিধার ক্ষেত্রে বেকায়দায় পড়তে হয় বলে মনে করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডিও। নেটিজেনরা বলছেন, বিশ্ববাসীকে সরকার মূলত মাথাপিছু আয় বেশি দেখানোর জন্যই কৌশল করে জনসংখ্যা কম দেখানো হচ্ছে। এ নিয়ে বিতর্ক থাকলে দেশ-বিদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এদিকে গণনা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণনায় ৫ শতাংশ বাদ পড়তেই পারে। যারা বাদ পড়েছেন তাদের নাম পরে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিন্তু ২০২১ সালের জুনে প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২০ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৯১ লাখ এক হাজার। এ হিসাবে গত দুই বছরে আরো ৪০ লাখ জনসংখ্যা জনমিতিতে যুক্ত হওয়ার কথা। দুই হিসাব মিলে, দেশে জনসংখ্যা হওয়ার কথা ১৭ কোটি ৩১ লাখ এক হাজার জন। অথচ এবারের শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেশের জনসংখ্যা ঘোষণা করা হয়েছে ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। অর্থাৎ অনুমিত জনসংখ্যা থেকে প্রতিবেদনে প্রকাশিত জনসংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ কম। এ ছাড়া নতুন পরিসংখ্যানে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের তথ্য অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সরকারি হিসাবে, বিদেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন এক কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশী। শ্রমিকের বাইরেও পড়ালেখার জন্য ও অভিবাসী হিসেবে বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ বিদেশে রয়েছেন। ফলে কী কারণে জনসংখ্যা কমে গেল এ নিয়ে সর্বমহলে সংশয় দেখা দেয়াই স্বাভাবিক।
তবে জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারই প্রথম ডিজিটাল শুমারি হওয়ায় ভুলত্রুটি অনেক কম হয়েছে। এ ছাড়া বিগত শুমারির তথ্য পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু এবার আমরা মাত্র ২৯ দিনেই জনশুমারির ফলাফল প্রকাশ করতে পেরেছি। বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করেছে, এরই ছোঁয়া লেগেছে জনশুমারিতে; যে কারণে প্রথম এই ডিজিটাল জনশুমারিতে ডিজিটাল ডিভাইস ট্যাবলেট ব্যবহার করে কম্পিউটার অ্যাসিসটেড পারসনাল ইন্টারভিউইং (ক্যাপি) পদ্ধতিতে তথ্য-সংগ্রহ করা হয়েছে।
তাহলে আগের গণনাগুলো কি ভুল ছিল? তবে অবস্থাদৃষ্টে, এ গণনা বা শুমারিতে গোলমাল হয়েছে, কী হয়নি- এ নিয়ে বিতর্কের যথেষ্ট অবকাশ তো রয়েছেই, পাশাপাশি এবারসহ প্রতি শুমারিতেই ক্রমেই সংখ্যালঘু কমে আসার তথ্য কিন্তু আরেক বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।
দেশের মোট জনসংখ্যা গণনা, গণশুমারির প্রধান লক্ষ্য হলেও তা একমাত্র নয়। এর সাথে আনুষঙ্গিক কিছু বিষয় রয়েছে। এর আন্তর্জাতিক গুরুত্বও রয়েছে। জাতিসঙ্ঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময়ে জনশুমারি একটি জনগোষ্ঠীর বা দেশের জনসংখ্যা গণনার সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহ, তথ্য একত্রীকরণ এবং জনমিতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথ্যাদি প্রকাশ করা বোঝায়। এর আগের নাম ছিল ‘আদমশুমারি’। ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে পরিসংখ্যান আইন-২০১৩ পাসের পর আদমশুমারিকে ‘জনশুমারি’ নামে অভিহিত করা হয়। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক থাকায় এ বছর ১৫ জুন থেকে শুরু হয়েছিল ষষ্ঠ ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২’। সপ্তাহব্যাপী ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২’ চলে ২১ জুন পর্যন্ত। এরপর প্রকাশ করা হয় ২৭ জুলাই।
দেশে প্রায় সব কিছুই বাড়তি। দুর্নীতি, অনিয়ম, নিত্যপণ্যের দাম, পরিবেশ দূষণ, খুনখারাবি, ধর্ষণ, আয়-আয়ুসহ প্রায় সব কিছুতে বাড়াবাড়ি। এর মাঝে সংখ্যালঘুতে কেন কেবল কমাকমি? এ জিজ্ঞাসার জবাব নেই। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, হিন্দু সম্প্রদায়। বাদ বাকিদের মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ কয়েকটি ক্ষুদ্র স¤প্রদায়। পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের প্রথম ডিজিটাল ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে মোট জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম ৯১ দশমিক ০৪, হিন্দু ৭ দশমিক ৯৫, বৌদ্ধ শূন্য দশমিক ৬২, খ্রিষ্টান শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠী শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ। ২৭ জুলাই ২০২২ ঘোষিত এ শুমারির আগের অর্থাৎ ২০১১ সালের শুমারিতে তা ছিল যথাক্রমে ৯০.৩৯, (হিন্দু) ৮.৫৪, শূন্য দশমিক ৬২, ০.৩১ এবং ০.১৪ শতাংশ। অর্থাৎ মুসলিম বাদে সব সংখ্যালঘুই কমেছে। দেশে প্রথম আদমশুমারি হয় স্বাধীনতার তিন বছর পর ১৯৭৪ সালে।
তখন মোট জনসংখ্যার মধ্যে হিন্দু ছিল ১৩.৫ শতাংশ। এরপর ১৯৮১ সালের শুমারিতে হয়েছে ১২.১ শতাংশ, ১৯৯১ সালে ১০.৫, ২০০১ সালে ৯.৩ এবং ২০১১ সালে ৮.৫ শতাংশ। দৃশ্যত দেশে এই স¤প্রদায়ের সংখ্যা বেশি মনে হলেও হিসাবে কমতির এ ধারা কেন? তাহলে তাদের এক অংশকে কি গণনার বাইরে রাখা হয়েছে? তারা ‘বেড়াতে গেছেন’ কোথাও? নাকি কোনো না কোনো কারণে বাদ পড়ে গেছেন? নাকি প্রজনন ক্ষমতা কমে গেছে তাদের? একটি প্রশ্নেরও সুনির্দিষ্ট জবাব মেলে না। তবে, না বলা কথাও বলা হয়ে যায় কোনো না কোনোভাবে। জানাও হয়ে যায়।
সংখ্যালঘুর সংখ্যা কমতে থাকা নিয়ে প্রশ্নের জবাবও একবারে জানার বাইরে নয়। সমস্যা হচ্ছে জবাবটা নিয়ে। আক্রান্তরাও জবাব খোলাসা করেন না। তারা ক্ষোভ ঝাড়েন, ইনিয়ে-বিনিয়ে দোষারোপ করেন। কিন্তু, দোষীর নাম মুখে নেন না। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে নালিশ জানানো আলোচিত প্রিয়া সাহা বলে এসেছিলেন- তিন কোটি ৭০ লাখ ধর্মীয় সংখ্যালঘু ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেছে। কিন্তু, তথ্য বা ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। নিখোঁজ সংখ্যালঘুরা কোথায় গেছে? গণমাধ্যমের এ প্রশ্নেরও সুনির্দিষ্ট উত্তর দেননি প্রিয়া সাহা। অধ্যাপক ও গবেষক ড. আবুল বারাকাত তার ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে বলেছেন, ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ সাল সময়কালে দেশে আনুমানিক এক কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী কমেছে। আর ‘কমেছে’ বলতে তার ভাষায় ‘নিরুদ্দিষ্ট’ হয়েছেন। নিরুদ্দিষ্ট মানে নিরুদ্দেশই বুঝিয়েছেন তিনি। তারা ভারতে গেছেন।
অন্য কোনো দেশে নয় কেন? এর জবাবে বলেছেন, গরিব হিন্দুরা তো আর জার্মানি-যুক্তরাষ্ট্র যেতে পারে না। এই দেশান্তরের কারণ হিসেবে বলেছেন, মুসলমানদের ফারটিলিটি রেট বেশি, ৬৪ সালের দাঙ্গা, ৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, এনিমি প্রোপার্টি অ্যাক্ট, ভেস্টেড প্রোপার্টি অ্যাক্ট ও নিরাপত্তাহীনতা। কে তাদেরকে নিরাপত্তাহীন করে? এ নিয়ে মাঝে মধ্যে জবাব দেয় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ।
সরকারের পরিসংখ্যানে ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘু কমার পেছনে দু’টি অর্থ আছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। প্রথমত, সংখ্যালঘুদের হার কম করে দেখানো অতীতের রাষ্ট্রীয় প্রবণতা ও বাংলাদেশ যে ক্রমেই ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে বা ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেছে- এটি দেখানো। দ্বিতীয়ত, সংখ্যালঘুদের জন্য পাকিস্তান যা ছিল, বাংলাদেশও তাই আছে। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হলেও সংখ্যালঘুদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি বরং পরিস্থিতি তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করছে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. চন্দ্র নাথ পোদ্দার মনে করেন, গত ১০ বছর ধরে অব্যাহতভাবে ঘটে যাওয়া সহিংসতা, নির্যাতন, উচ্ছেদের কারণে হিন্দু জনগোষ্ঠী কমছে। পূজা উদযাপন পরিষদের সহসভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ প্রামাণিকসহ সংখ্যালঘু আরো কারো কারো মতও এমনই।
ঐক্য পরিষদ নেতারা বরাবরই বলে থাকেন, হিন্দুদের ওপর আক্রমণের মূল টার্গেট তাদের জমি ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান দখল। এ আক্রমণটা কারা করে? এ প্রশ্নের তাত্ত্বিক জবাবে তারা বলেন, এটি যাদের ক্ষমতা আছে তারাই করেন। এ ধরনের জবাব এক দিকে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। তারওপর প্রশ্নবিদ্ধ। ঢেকে রাখা, চেপে রাখা, ফাঁপিয়ে দেখানো কোনোটাই ভালো কাজ নয়। আবার এটিই বাস্তবতা। সংখ্যালঘু কমে যাওয়ার তথ্য লুকানোর সুযোগ নেই। ১৯৪৭ সালে যারা ছিল ৩৩ শতাংশ আজ তারা কমে ৮ শতাংশেরও কম। আদম বা গণশুমারির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৪৭ এর ভারত ভাগের পর থেকে এ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান আর এখনকার বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কখনোই দেড় কোটি ছাড়ায়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘটিত হামলা ও সহিংসতা নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেছিল। সেই কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে, তা এখনো ফাইলবন্দি। অনেক আগে বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটি কমিটি তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছিল। সেখানে বেশির ভাগ সংখ্যালঘুর সম্পত্তি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দখলে বলে তথ্য দেয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজনীতিসহ নানা কারণে রিপোর্টটি আমল পায়নি। আবার এর ভিত্তিও ছিল দুর্বল।
আবার এটিও ঠিক, বর্তমান সরকারের আমলে রামু, নাসিরনগর, শাল্লা, সাঁথিয়া ও গোবিন্দগঞ্জে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর এখনো বিচার হয়নি যার পরিণামে আজ এখানে, কাল সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, তাদের বাড়িঘর, দোকানপাট ও মন্দিরে হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। নানান ছুঁতায় কিলঘুষি, চড়থাপ্পড়, কানধরে ওঠবস, গলায় জুতার মালা দিয়ে ঘোরানো। এ ধরনের অনেক খবরাখবর গণমাধ্যমে আসে না।
মাত্রাগতভাবে ঘটনার ব্যাপকতা বেশি হয়ে গেলে গণমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ক’দিন মাতামাতি-মায়াকান্না, সাহায্য-সহায়তা নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের পাশে থাকার ওয়াদা, রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পাল্টিপাল্টি দোষারোপ। হামলার পর বরাবরের মতো একদিকে বিবৃতি, বক্তৃতা, দোষারোপ, সমবেদনা জানাতে ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া- আরেক দিকে সংখ্যালঘুদের ভাঙা ঘর, ভাঙা দোকান মেরামতের দৃশ্য। কিন্তু, নির্যাতনের শিকারদের মন-মনন কি মেরামত হচ্ছে বা হবে?
কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু প্রশ্নে সম্প্রীতি আর সম্পত্তি এক করে ফেলা হচ্ছে। শুনতেও তা কাছাকাছি। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল, হাজংসহ বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘুদের জমিজমা দখলের অনাচারও চলছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার নামে সহিংসতার বেশির ভাগই ঘটেছে একপক্ষীয়ভাবে। কোনো কোনোটির নেপথ্য রহস্য লুকানো সম্পত্তিতে। তা হাত করতে ঘটানো হয় পরিকল্পিত কাণ্ডকীর্তি। সংখ্যালঘুদের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, বসতবাড়িতে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ, উপাসনালয় আক্রমণের প্রায় প্রতিটিই পরিকল্পিত। ঘটনাকে ছক মতো টেনে নেয়া হয় সম্প্রদায়গত দিকে। এর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর যারপরনাই অমানবিক-দানবীয় ভ‚মিকা প্রায় ওপেন সিক্রেট।
পরিশেষে বলতে চাই, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই জনশুমারি ও গৃহগণনা অধিকতর ফলপ্রসূ ও সফল করার লক্ষ্যে সবার অংশগ্রহণ এতে নিশ্চিত করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ এ জনশুমারি বাস্তবায়নের জন্য সর্বস্তরে যোগাযোগ, সমন্বয়, তদারকি ও পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। ত্রুটিমুক্ত ও সফল শুমারি করতে সরকারের পাশাপাশি দলমত-শ্রেণিপেশার সব সচেতন মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাদের সবাইকে যার যার পরিসরে দেশের এ গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব কিছুতেই গোঁজামিল চলে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট