একটা জিনিস লক্ষ করেছেন? ধান-পাট-শাক-সবজি-ফলমূল ইত্যাদির মতো চা একটি কৃষিজাত দ্রব্য হলেও চা যেখানে উৎপন্ন হয় সেই ভূমিকে চা-ক্ষেত বলা হয় না। আমরা ধানক্ষেত, পাটক্ষেত, আলুক্ষেত, মুলাক্ষেত বলি ঠিকই; কিন্তু চা-ক্ষেত বলি না, বলি চা-বাগান। যেমন—গোলাপ ক্ষেত বলি না, বলি গোলাপ বাগান। কেন ধান-পাট চাষের মতো চায়েরও চাষ হওয়া সত্ত্বেও যে ভূমিতে চা উৎপন্ন হয় তাকে ক্ষেত না বলে বাগান বলে কৌলীন্য প্রদান বা তার স্ট্যাটাস বাড়ানো হয় তা আপনারা যাঁরা চা-বাগান দেখেছেন তাঁরা ঠিকই জানেন।
তা যা বলছিলাম। একটি চা-বাগানের চোখজুড়ানো সৌন্দর্য ও কোটি কোটি টাকা আয়ের পেছনে যাঁদের অবদান সবচেয়ে বেশি তাঁদের আপনি আপনার গাড়িতে বসেই দেখতে পাবেন। তাঁরা নীরবে-নিঃশব্দে নিবিষ্ট মনে একটি চা-গাছের সঙ্গে প্রায় মিশে গিয়ে কাজ করে থাকেন। কী কাজ? চা-পাতা আহরণের ‘সিজনে’ পাতা তোলার কাজ। অন্যান্য সময় হয় গাছগুলোর যত্ন-আত্তি, পরিচর্যা, আর না হয় কারখানা ঘরে ‘বস’দের নির্দেশে নানা কাজ। তবে হ্যাঁ, গাছ থেকে পাতা তোলার কাজটি শুধু নারী শ্রমিকরাই করেন। গাছের কোনো ক্ষতি অথবা একটি পাতাও নষ্ট না করে খুবই দ্রুততার সঙ্গে গাছ থেকে একবারে দু-আঙুল দিয়ে ‘দুটি পাতা ও একটি কুঁড়ি’ উপড়ে নেওয়ার দক্ষতাটা এই চা-বাগান শ্রমিকদের ট্রেডমার্ক বলা যেতে পারে। পাতা তোলার সময় একটি গাছে একজন নারী শ্রমিক কাজ করেন। ওই সময় পাহাড়ের ঢালে ছায়াদার বৃক্ষগুলোর নিচে একসঙ্গে অনেক নারীকে প্রায় নিঃশব্দে কাজ করতে দেখে মনে হতে পারে ওঁরা মানুষ নন, রোবট।
২. এবার আসুন, চা শ্রমিকদের ঘরদুয়ারে একটু ঢু মেরে আসি। বাগানের ভেতরই কোথাও একটু সমতলে, কোথাও টিলা কেটে বানানো হয়েছে চা শ্রমিকদের মাটির বেড়া ও ছনের ছাউনির নাতিবৃহৎ দোচালা ঘর। ওই ঘরেই ছানাপোনা নিয়ে বাস করেন চা শ্রমিকরা। ওখানেই থাকা, ওখানেই রান্নাবান্না, হাঁস-মুরগি পালন। তবে হ্যাঁ, এটা বলছি আজ থেকে ৩০-৩৫ বছর আগের কথা। বাংলাদেশ সরকার একটা প্রকল্প হাতে নিয়ে শ্রমিকদের জন্য পাকা ঘর বানানো শুরু করে, যত দূর মনে পড়ে নব্বইয়ের দশকে। অতটা উন্নত মানের না হলেও আজকের আশ্রয়ণ প্রকল্পের মতো। আর খাওয়াদাওয়ার মান অবশ্যই যথা পূর্বং তথা পরং। কোনো মতে জীবনধারণের জন্য একটা আটার রুটি কিংবা মোটা চালের দুমুঠো ভাত, সঙ্গে কচি চা-পাতার এক ধরনের বিশেষ ভর্তা, শুঁটকি পোড়া, হয়তো কখনো একটুখানি শাক। তবে সপ্তাহান্তে যেদিন মজুরি মেলে সেদিন পুরুষদের তাড়ি গেলা হয় রীতিমতো হৈ-হল্লা করে। আর পুরো সপ্তাহের উপার্জন ওই এক রাতেই প্রায় সবটা উড়ে যায়।
চা-বাগানের স্বাস্থ্যসেবা ও শিশুদের বিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা খুব একটা খারাপ নয়। মোটামুটি মানসম্পন্ন বাগানগুলোতে ডাক্তার-কম্পাউন্ডার আছেন, ফার্মেসিও আছে কাজ চালানোর মতো। আর সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় প্রাইমারি স্কুল আছে প্রায় সব বাগানে। তবে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বা তদূর্ধ্ব পর্যায়ে লেখাপড়ার জন্য স্কুল-কলেজ খুব কম বাগানেই আছে। উনিশ শ পঞ্চাশের দশকে আমি যখন স্কুল-কলেজের ছাত্র তখন আমাদের কুলাউড়া থানার অন্তর্গত দুটি চা-বাগানে প্রতিবছর একবার ছুটি কাটাতে যেতাম। এর একটি শিলুয়া (বর্তমানে জুড়ী উপজেলার অন্তর্ভুক্ত) এবং অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোট, রাঙ্গিছড়া। শিলুয়ায় আমার এক ভগ্নিপতি বেশ বড় পদে চাকরি করতেন। আর রাঙ্গিছড়া বাগানের ডাক্তার ছিলেন আমার খালু। হাতে গোনা মাত্র পাঁচ-ছয়জন কর্মকর্তা বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকতেন : কেউ হেড ক্লার্ক, কেউ গুদাম বাবু, কেউ টিলা বাবু, কেউ ফ্যাক্টরি বাবু ইত্যাদি। সবাই বাবু, কেউ সাহেব নন। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এসব পদবি চলে আসছে। অবশ্য আজকাল এঁদের কী নামে ডাকা হয় জানি না। আর ব্রিটিশ আমলে বা তার পরেও সনাতনধর্মী কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই মোটামুটি এসব পদ অলংকৃত করতেন। আর বড় সাহেব অর্থাৎ ম্যানেজার সাহেব ব্রিটিশ আমলে ছিলেন ইংরেজ, পরে প্রায় সব বাগানেই পশ্চিম পাকিস্তানি। এখন সব পদেই বাঙালিরা।
চা-বাগানগুলোতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল দেখার মতো। বাগানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিবার-পরিজন ছিলেন জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে একজন আরেকজনের দাদা-দিদি, মাসিমা-পিসিমা, কাকা-কাকিমা ইত্যাদি। মুসলমানরা একে অন্যকে ভাই-ভাবি, চাচা-চাচি, খালা-খালু ইত্যাদি সম্বোধন করতেন। আর সাংস্কৃতিক চর্চা, পূজা-পার্বণে গান-বাজনা, যাত্রা-থিয়েটার ইত্যাদি ছিল চা-বাগান জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বড় বড় বাগানে যাত্রা-থিয়েটারের জন্য ছিল স্থায়ী মণ্ডপ। দুর্গাপূজা, যাত্রা-থিয়েটার ইত্যাদি ছিল চা শ্রমিকদের বড় আনন্দোৎসব। উৎসবে-পরবে তাড়ি খাওয়া, চোলাই খাওয়া, ঢোল-করতাল বাজিয়ে গান-বাজনা করা—এই ছিল চা শ্রমিকদের জীবন।
শুরু থেকেই আপনারা লক্ষ করছেন, আমি চা-বাগানের শ্রমিকদের চা শ্রমিক বলে অভিহিত করে আসছি। কিন্তু নির্মম সত্যটি হচ্ছে, এই শ্রমিকরা ‘কুলি’ নামেই পরিচিত। এঁদের গাত্রবর্ণ, মুখের ভাষা, আচার-আচরণ এঁদেরকে ‘বস্তিবাসী’ বাঙালি হিন্দু-মুসলমান থেকে ভিন্নতা দিয়ে রেখেছে। আসলে এঁদের পূর্বপুরুষকে ব্রিটিশরা ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাহাড়ি টিলা-টক্করে চা চাষের জন্য দক্ষিণ ভারত থেকে এ দেশে এনেছিল। আর যেহেতু এতদঞ্চলে একমাত্র সিলেট-মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জ অঞ্চলই ওই সময়ে চা চাষের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হয়েছিল, এঁরা তাই আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ পাননি। এই কৃষিপ্রধান দেশে শুধু চা উৎপাদনেই বংশপরম্পরায় এঁরা নিয়োজিত থেকেছেন। শিক্ষার আলো থেকে যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত এই ‘কুলি’ বলে পরিচিত সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েরা পূর্বপুরুষের পেশা অর্থাৎ চা চাষেই থেকে গেছে। তবে এদের মধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো কোনো মেধাবী তরুণ যখন রবার্ট ব্রুস হয়ে আত্মপ্রকাশ করে, যখন শত বাধাবিপত্তির বিন্ধ্যাচল পার হয়ে সে জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়, তখন সেই অবিশ্বাস্য সাফল্যে দেশজুড়ে ‘সাধু সাধু’ রব উত্থিত হয়। তখন আমাদের বোধোদয় হয় : কুলি হয়ে জন্মানো, দিনের পর দিন অভুক্ত থেকে অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্যের জন্য দ্বারে দ্বারে হাত পাতা একজন মহীয়সী মা কমলিরানি রবিদাস জাতির গৌরব, এ দেশের লক্ষকোটি জননীর আদর্শ। ‘কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে!’ (‘কুলি-মজুর’ : কাজী নজরুল ইসলাম। ) না, কুলি বলে আর ঠেলে ফেলে দিতে পারবেন না বাবু সাবরা। জনমদুখী মা কমলিরানি রবিদাস দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অভুক্ত শরীর নিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তাঁর কলিজার টুকরা সন্তান সন্তোষ রবিদাসকে ‘কুলি থেকে মানুষ’ করেছেন। সন্তোষ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমি প্রার্থনা করি, দুদিন পর সে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এটা তো হতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ এক শ বছর আগে (২০ আষাঢ় ১৩১৭) কী বলে গেছেন? ‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,/পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। ’ (‘অপমানিত’ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। )
৩. এত কথার পর আসুন না একবার অন্তত ভাবি চা-বাগানের শ্রমিক যিনি সারা দিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে মজুরি পান ১২০ টাকা, তিনি শুধু বাবু সাবের কুলি নন, রোবটও নন, তিনিও মানুষ। যিনি দিন শেষে ‘নিট’ আয় করেন ১২০ টাকা নয়, ১২০ হাজার টাকা, তাঁর যেমন খিদে পেলে প্রয়োজন হয় খাবারের, ওই মানুষরূপী রোবটদেরও তেমনি খিদেয় খাবার, অসুখে ওষুধ, সন্তানের লেখাপড়ার জন্য শিক্ষার উপকরণ, স্কুল-কলেজের বেতন ইত্যাদির প্রয়োজন হয়।
আমরা রোবটিয়ো নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কবে চা শ্রমিক, কামধেনু গার্মেন্ট শ্রমিক, নিরন্ন-নিবস্ত্র খেতমজুরদের সমস্যা দেখতে পারব? কবে ভাবব, ওঁরাও মানুষ? এবং মানুষ বলেই এই মাগিগ-গণ্ডার দিনে দিনমজুরি ১২০ টাকা নেহাত তামাশা বলে মনে হয়।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি