কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে- এটা সবাই জানে। কিন্তু যে কথাটার কেউ জবাব দিতে পারছে না তা হলো এই যে, কৃষক বাঁচবে কী করে? দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি দেশের কৃষক, যাদের উৎপাদন শতভাগ মূল্য সংযুক্ত (এ কথাটা বলার একটা কারণ আছে)। অথচ সেই মূল চালিকাশক্তিই আজ এই দুর্মূল্যের বাজারে সবচেয়ে নিষ্ঠুর, অসহায় শিকার। সেই কৃষকের ওপরই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ‘ডিজেল-নির্যাতন’।
এর তুলনা চলে অষ্টাদশ শতাব্দীর নীলকরদের নীল চাষের নির্যাতনের সাথে। নগর পরিবহনে ডিজেলের উচ্চ মূল্যহার ‘তারা’ পুষিয়ে নিচ্ছেন বাড়তি ভাড়া আদায় করে। কৃষক কি পারবেন হাটে তাদের পণ্যের দাম বাড়িয়ে পাইকারদের মোকামে বা ট্রাকে কৃষিপণ্য তুলতে? এমনিতেই ভরা মৌসুমে অনেক হাটে কৃষক তার বেগুন, মুলা, কুমড়া ফেলে দিয়ে খালি বস্তা নিয়ে ঘরে ফেরার অজস্র দৃষ্টান্ত আছে। দাম বাড়লে কি কৃষিপণ্য কৃষক পর্যায়ে বাজারে টিকাতে পারবেন? করোনাকালে সব খাতে যখন উৎপাদক হাত গুটাতে বাধ্য হয়েছিলেন, কৃষক তার সাফল্যকে খরা-তাপ-বর্ষণ-অনাবৃষ্টি, পোকা-বালাই নিয়েই ধরে রেখেছেন। করোনা গেলে কৃষক ভেবেছিলেন, এবার তারা বাঁচতে পারবেন। কিন্তু নতুন করে যেভাবে তাদের ওপর ডিজেল-নির্যাতন, সার-নির্যাতন, বীজ-নির্যাতন চাপানো হলো তাতে কি তারা পারবেন টিকতে? চা-শ্রমিকরা সঙ্ঘবদ্ধ। তাই তারা তাদের দাবি কিছুটা হলেও আদায় করতে পেরেছেন। কৃষকরা তো সঙ্ঘবদ্ধ নন। তারা তাহলে কিভাবে দাবি তুলবেন?
কৃষককে ডিজেলের উচ্চমূল্য থেকে বাঁচানো এখন ‘ফরজ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির বৈরিতার কারণে এমনিতেই কৃষক বিপন্ন। এবার বোরো এবং আমন দু’টিতেই ধরা খেয়েছেন কৃষক। অনাবৃষ্টির কারণে পাট পচানো দুরূহ হয়ে পড়ে। পাটেও ধরা খাবেন কৃষক। সেচ দিতে হবে অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি আর সেচ মানেই তো ডিজেল। পাম্পগুলোর দুই-তৃতীয়াংশই ডিজেলনির্ভর। জমি চাষ দিতে এখন হাল-গরুর ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক কম। গরু পালার খরচ বেশি বলে ট্রাক্টর/পাওয়ার টিলার এখন চাষের প্রধান উপায়। গরু পালায় খরচ এবং মজুরি বেড়ে যাওয়ায় মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকেছেন বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে। একটি ট্রাক্টর ও একজন চালকই দিনে ১০ থেকে ১২ একর জমিন চাষ দিতে পারে।
গরু কম বলে গোবরও কম। ফলে রাসায়নিক সারের চাহিদাও বেশি। আর কীটনাশক তো পুরোপুরিই কেমিক্যাল। সবগুলোরই দাম বেড়েছে। বীজ পাওয়া যেত মোটামুটি ন্যায্য দামে। এখন বীজের দামও শিখরছোঁয়া। ডিজেলের দাম পোষাতে না পারলে কৃষক সেচও কম দেবেন। ফলনও কম হবে। অন্যান্য দেশে কী হয়? অন্যান্য দেশে সরকার এগিয়ে আসে। (উৎপাদন পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপারে গোটা বিশ্বে প্রথম নজির মোগল কৃষিব্যবস্থা। মোগলরা কেবল অগ্রিম অর্থ দিয়েই ফসল বা কৃষিপণ্য কিনে নিতেন, তাই নয়; মোগলদের ভূমির খাজনার ভিত্তি ছিল জমির উর্বরতা। সেই অর্থে রিকার্ডোর খাজনাতত্ত্ব মোগলদের থেকেই নেয়া।
ডিজেলে অন্তত কৃষকদের ভর্তুকি দিতেই হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যেন সত্যিকার অর্থে সেই ভর্তুকি কৃষক পর্যন্ত পৌঁছায়। এই একই কৃষি খাতে এমন অনেক উপখাত আছে যেখান থেকে অর্থ খরচ কমিয়ে ডিজেল বাবদ ভর্তুকির সংস্থান করতে হবে। পরিবহন খাতের খরচ বৃদ্ধি পৃথক বিবেচনা। কৃষক যদি লঘু ব্যয়ে সেচ, চাষ, মাড়াই ও ছাঁটাই করতে না পারেন তাহলে পরিবহনের ব্যয় আগাম ভেবে লাভ কী? সব সময় মনে রাখতে হবে, অভাবের সংসারে ‘অপরচুনিটি কস্ট’ অন্য যেকোনো অগ্রাধিকারের চেয়ে বেশি বিবেচনার হকদার। ঘরে যখন অভাব তখন চালের পয়সা আছে কি না সেটিই প্রধান বিবেচনা, তামাক-পান-সুপারির দাম তখন ‘সেকেন্ডারি প্রায়োরিটি।’ খাদ্য নিরাপত্তার বিশাল বিবেচনাতেই ডিজেল নিয়ে দ্বিতীয় চিন্তার সময় এখন। মূল ঠিক রাখলে শাখা-প্রশাখা নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে।
চাল উৎপাদনে বিগত কয়েক বছর আমরা মোটামুটি একটি স্বস্তিদায়ক অবস্থানে ছিলাম। তার পরও বালা-মুসিবতের প্রধান শিকার কৃষক এবং কৃষি, যেটা আমরা এবারের বোরো এবং পাটের মৌসুমে দেখলাম। আগস্ট মাস চলে গেল, পাট পচানোর পানি নেই বহু জেলায়। অথচ আগাম বন্যায় হাওর এলাকা ও উত্তরবঙ্গে বিপুল শস্যহানি ঘটেছে। খরায় আউশ পুড়েছে, বানভাসিতে আমন ডুবেছে।
ফলাফল সেই একই নিম্নচাপ অর্থাৎ চাল উৎপাদনে অকার্যকারিতা। সরকার মধ্যে ভাবছিলেন, আমদানি করে চালের বাজারে শান্তি আনবেন। তা কিভাবে সম্ভব? ১২০ টাকায় ডলার কিনে চাল আমদানি? গাড়ির আগে ঘোড়া? অস্বীকার করার উপায় নেই চালের মজুদ স্বস্তিদায়ক নয়। দাম উচ্চমুখী। তার আগেই ধানে পচন ধরবে। আম আর ছালা দুটোই যাবে। সমস্যার লক্ষণের চিকিৎসায় কাজ হবে না। সমস্যার মূলে বা রুটে যেতে হবে। দেশে কৃষকদের গোলায়, ঘরে, আঙিনায়, মিলারদের গুদামে, সাইলোতে কী পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদ আছে দেখে, শুনে, বুঝে, জরিপ করে তারপর আমদানির রূপরেখা কষতে হবে। কাজীর গরু কেতাবে নয়, গোয়ালে দেখে শুনে নিশ্চিত হতে না পারলে চাল আমদানিতে আবার এক ধাপ্পায় পড়তে হবে। এবার বহু দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে। রুশ সিস্টেমের খাদ্যভাণ্ডার ইউক্রেন নিজেই এখন যুদ্ধরত। রাশিয়াও নিষেধাজ্ঞা কারণে চাল, গম, ভোজ্যতেল, ভুট্টা পাঠাতে পারছে না।
‘ইউরোপের কিচেনে’ এই প্রথম অভাবের আর্তনাদ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এই প্রথম ইউরোপের দোকানে রুটির জন্য লাইন পড়েছে। গ্যাসের অভাবে আসন্ন শীতের কথা ভেবে তিন মাস আগে থেকেই তাদের কাঁপন উঠে গেছে। আর এক শস্যভাণ্ডার আছে অস্ট্রেলিয়া। তারা ইউরোপীয় স্বজাতিদের পাশেই আগে দাঁড়াবে, এটি বলাই বাহুল্য। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র যত বেশি সুদের হার বাড়াবে মার্কিন ডলারের বিপরীতে ততই দুর্বল হবে অস্ট্রেলিয়ান ডলার (যা এখন ০.৬৯ অস্ট্রেলিয়ান ডলার সমান এক মার্কিন ডলার)। তাছাড়া বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রতি তুলনামূলক উদাসীন অস্ট্রেলিয়ার ডলারের দাম আরো কমবে। ফলে অবিশ্বাস্য উচ্চদামে ডলার কিনে অস্ট্রেলিয়ার গম, চাল, ভুট্টা যাই কিনতে যাবেন, পোষাতে পারবেন না। ব্রাজিল থেকে আনবেন? আরো করুণ চিত্র সেখানে। ০.২০ মার্কিন ডলার সমান এক ব্রাজিলিয়ান রিয়েল। ‘ওয়ালেট ইনভেস্টর’ মুদ্রা বিনিময়হার সূচকমোতাবেক ব্রাজিলিয়ান রিয়েলের মূল্যে ২০২৩-২৪ সাল নাগাদ ৬.৭৮ থেকে ৭.০০ ব্রাজিলিয়ান রিয়েলে এক মার্কিন ডলার কিনতে হতে পারে। তাহলে অগ্নিমূল্যে ডলার কিনে পানির দরে রিয়েলে কনভার্ট করে ব্রাজিলের খাদ্যশস্যাদি পাঁচ থেকে ছয়গুণ বেশি জাহাজ ভাড়া/বীমা দাবি দিয়ে এনে পোষাতে পারবেন? অবশ্যই পারবেন না!
অর্থাৎ আমরা মরতে বসেছি খরা, অনাবৃষ্টি, বালাই, ভূমি-জনসংখ্যা অসম অনুপাত, আগাম বন্যা, বিশ্বজোড়া মূল্যবৃদ্ধি, বিশেষ করে জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি আগুনে। আমাদের ভরসা এখন উপরে আল্লাহ এবং জমিনে বাংলদেশের কৃষক। যাদের আমরা চিরকাল অবজ্ঞা করে এসেছি সেই হতদরিদ্র কৃষকই এবার এগিয়ে আসতে পারেন ত্রাণকর্তা হিসেবে। আমাদের নগরকেন্দ্রিক, উন্নাসিক ‘ভদ্রলোকদের’ এবার আরো একবার সশ্রদ্ধ সালাম করতে হবে গ্রামের কৃষকদের প্রতি। কারণ কোনো দরদি, আমলা-কামলা, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, কবিরাজ আসন্ন ‘বিশ্ববালাই’ থেকে আমাদের নাজাত দিতে পারবে না। আমাদের যে কৃষক বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিসের (১৭৯৩) ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ থেকে অদ্যাবধি রাষ্ট্রীয় নিবর্তনের সব স্টিমরোলারে পিষ্ট হয়েও টিকে আছেন এবং আমাদের টিকিয়ে রেখেছেন, তারাই ইনশাআল্লাহ তাদের হেকমত এবং মেহনতের যুগল বন্দনা দিয়ে আমাদের আবারও উদ্ধার করবেন। আমাদের কৃষক মরেছেন ধারে- এখন মরছেন সারে। আগে মরেছেন মরণ পণ্য নীলে- এখন মরছেন ডিজেলে। মরণকাব্যে অন্ত্যমিল আছে বটে! নেই শুধু কৃষকের বাঁচার উপায়। মুক্ত অর্থনীতির নামে বহুজাতিক শোষণে তারা এখন অসহায় বলি। অথচ তারাই বাংলাদেশ। আজকের এই বাংলাদেশ মডেলের তারাই সত্যিকারের রূপকার, স্থপতি।
তারাই স্থির অচঞ্চল সহিষ্ণু বাংলাদেশর বিশ্বস্ত প্রতিচ্ছবি। আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ ৬০ লাখ হেক্টর ১০ বছরের মধ্যেই যা কমে আসবে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ হেক্টরে। তাই আমাদের এক কোটি ৭০ লাখ ‘ভূমিযোদ্ধা’ কৃষককে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে কম জমিনে বেশি ফসল ফলিয়ে, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ এবং ফলে বৈচিত্র্য এনে ধান-চাল গমের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে এই ১৬-১৭ কোটি মানুষকে বাঁচানোর যুদ্ধে জয়ী হতে এবং গোটা পৃথিবী ইতোমধ্যেই জেনে গেছে, বাংলাদেশের কৃষক এ যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ক্ষমতা রাখেন।