সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪৩ পূর্বাহ্ন

অমুসলিমদের সাথে মহানবীর সৌহার্দ্যতা

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০২২
  • ১১০ বার

নিখিল এই পৃথিবী যখন আধারের অমাবস্যায় তিল তিল করে ডুবে যাচ্ছিল, মানবতার ওপর যখন নেমে এসেছিল ধ্বংসের ভয়াল তাণ্ডব। মানুষ যখন হারতে-ভুলেছে তার মনুষ্যত্বকে। (বেদুইন যাযাবররা যখন) দিগ্ভ্রান্ত মাঝির মতো সমুদ্রের মাঝখানে যেমন নিজেকে অসহায় মনে করে আশ্রয় খুঁজছে; ঠিক তখনই ধরার বুকে সব অন্ধকারের ইতি ঘটিয়ে জন্ম নিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:। তাঁর আগমনে নিখিল ভুবন ফিরে পেল আলোর পথের ঠিকানা। মানবতা ফিরে পেল তাঁর নিজস্ব গুণাগুণ।

মানবতার কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে উপাধি পেলেন ‘মহানবী’। তিনি ছিলেন না একা কোনো গোত্রের, কোনো জাতির, কিংবা কোনো রাষ্ট্রের; বরং তিনি ছিলেন বিশ্ববাসীর জন্য রহমতের এক ফল্গুধারা। তিনি যদিও ইসলাম ধর্মের একজন প্রচারক ছিলেন; কিন্তু অবদান রেখেছেন মানবতার প্রতিটি সিঁড়িতে। তার ‘মহানুভবতা’ ছাড়া মানবতার সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া মোটেও সম্ভব নয়।

মহানবী সা: ছিলেন মানুষের প্রতি উদার হৃদয়ের অধিকারী। তার বক্ষদেশ ছিল আসমানসম প্রশস্ত। তিনি সবাইকে ভালোবাসতে, কাছে টেনে নিতে খুব সহজেই পারতেন। কারো প্রতি তো অবিচার করেননি বটে। আবার কাউকে অন্যের ওপর অবিচার করার প্রশ্রয়ও দেননি; বরং গোটা উম্মতকে নিষেধ করেছেন কারো প্রতি যেন তারা জুলুম না করে। সবার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক যেন বজায় রাখে। কাউকে যেন তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা না হয় সে ব্যাপারে তিনি তার পবিত্র জবান মোবারকে উচ্চারণ করেছেন কঠোর পরিভাষা, তিনি বলেছেন- কোনো মুসলিম যদি অমুসলিমের প্রতি জুলুম করে তবে কিয়ামতের বিচার দিনে তিনি অমুসলিমের পক্ষে অবস্থান নেবেন।

হাদিসে ফরমান, হজরত সুফিয়ান ইবনে সালিম রা: বর্ণনা করেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘জেনে রেখো! কোনো মুসলমান যদি কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর জুলুম-নির্যাতন করে, কোনো অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করে, তার কোনো জিনিস বা সহায়-সম্পদ জোরপূর্বক কেড়ে নেয়; তবে কিয়ামতের দিন আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় আমি তাদের বিপক্ষে অমুসলিমদের পক্ষে অবস্থান করব।’ (আবু দাউদ)

অমুসলিমদের প্রতি আচরণ : অমুসলিমদের প্রতি মহানবীর সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ, ‘ইতিহাস’ তার সোনালি অক্ষরে হস্তকৃত করে রেখেছে। মহানবী ছিলেন মহানুভবতার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জন্মের পর থেকে তিনি ছিলেন সত্যবাদী ও বিশ্বাসী। উপাধি পেলেন অমুসলিমদের মুখ থেকে আল-আমিন, আস-সাদিক। আরবের মানুষ জাতি-বর্ণ-ধর্ম-গোষ্ঠী সব কিছু ভুলে গিয়ে সবাই তার মহানুভবতায় আকৃষ্ট হয়ে টাকা-পয়সা, স্বর্ণ-গয়না, মণিমুক্তা আমানত রাখত। শত অভাব-অনটনে, দুঃখকষ্টে দিনাতিপাত করা সত্ত্বেও তিনি কখনো সে আমানতের খিয়ানত করেননি। নিজের জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে এসব সম্পদ সযতেœ রক্ষণাবেক্ষণ করছেন তিনি। বিনিময়ে চাইতেন না কোনো পারিশ্রমিক। কী অদ্ভুত মহানুভবতা!

নবুওয়াতের প্রাথমিক বছরগুলোতে আপন চাচা আবু লাহাব মহানবী সা:-এর দাওয়াতি মিশনের প্রথম ও প্রধান বাধাকারী ছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো দিন প্রিয় চাচার জন্য মন থেকে কোনো বদদোয়া করেননি। মহান আল্লাহর কাছে তাঁর হাবিবের অপমান সহ্য না হওয়ায়, তিনি পরবর্তীতে সূরা নাজিল করেছেন। কিন্তু তিনি (মহনবী) চাচার প্রতি কখনো ঘৃণার ভাষায় কোনো বুলি উচ্চারণ করেননি।

চরম বিরোধী ও প্রাণশত্রু আরেক চাচা ছিলেন আবু জাহেল। তিনি আগে আবুল হাকাম (জ্ঞানীর পিতা) ছিলেন। তার হেদায়েতের জন্য, সুপথের দিশা পাওয়ার জন্য প্রিয় নবীর অশ্রুভরা কত দোয়াই না ছিল। তিনি মনে করতেন, যদি চাচাজান ইসলাম কবুল করেন, তা হলে মুসলমানদের অনেক উপকার সাধিত হবে। কিন্তু আবু জাহেল জ্ঞানের পরিচয় দিতে না পেরে, ইসলামের পথে না ফিরে; বরং পিছিয়ে গেছে যোজন যোজন মাইল দূরে।

এক বুড়ি মহানবী (মুহাম্মদের) ভয়ে মক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য এক গন্তব্যের দিকে। পথিমধ্যে দেখা হলো (মুহাম্মদ) নবীজীর সাথে, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বুড়ি মা! আপনি কোথায় চলে যাচ্ছেন? জবাবে বুড়ি বললেন, মুহাম্মদ নামে এক যুবক নাকি মক্কায় নতুন এক ধর্মের প্রচার শুরু করছে, তার ভয়ে চলে যাচ্ছি। নবীজী কিছুই না বলে, কাঁধে বুড়ির সব বোঝা তুলে নিলেন। আর বুড়ির আত্মীয়স্বজনের কাছে পৌঁছে দিয়ে এলেন। ফিরিয়ে আসার সময় বুড়ি জিজ্ঞেস করলেন, যুবক! তুমি কে? কি তোমার পরিচয়? আমার ভারী বোঝাগুলো মরুভূমির এই কঠিন পথে বহন করে দিলে। নবীজী তখন একটু মুচকি হেসে বললেন, যে মুহাম্মদের ভয়ে আপনি দেশত্যাগ করেছেন, আমি সেই মুহাম্মদ। বুড়ি অবাক বিস্ময়ে অপলকে তাকিয়ে রইলেন মহানবীর দিকে। আর ধর্মান্তরিত হলেন মহানুভবতার ধর্ম ইসলামের দিকে। এই ছিল মহানবীর এক পরম মহানুভবতার নিদর্শন।

তায়েফবাসীর কাছে ইসলামের সুমহান আদর্শের নমুনা পেশ করার জন্য নবুওয়তের দশম বছরে তাদের দ্বারে তিনি হাজির হলেন। কিন্তু তারা তার সম্মান-মর্যাদা বুঝতে না পেরে, দাওয়াত কবুলের পরিবর্তে দুষ্ট ছেলেদের পিছু দিলো লেলিয়ে। পাথরের আঘাতে আঘাতে তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় বেহুঁশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। আল্লøাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতা এসে অনুমতি চাচ্ছেন। যদি তিনি অনুমতি দেন তা হলে দু’পাশের পাহাড়ের চাপে পিষ্ট করে তাদেরকে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় করে দেবে। কিন্তু! কিন্তু মহানবী যে এক আসমানসম হৃদয়ের অধিকারী, তা ফেরেশতা বুঝতে পারেনি। জবাবে তিনি বললেন, ‘তাদেরকে যদি শেষ করে দেয়া হয় তা হলে কার কাছে আমি তাওহিদের দাওয়াত পেশ করব?’ কী আজিব উত্তর! এই ছিল মহানবীর সৌহার্দ্যতা; যা কোনো পরিমাপ যন্ত্র দিয়ে পরিমাপ করা অসম্ভব।

হিজরতের সময় তিনি যখন দেশ ছেড়ে মদিনায় চলে যান তখন অমুসলিমদের টাকা-পয়সা, সোনা-দানা, হীরা-জহরত সব কিছু চাচাতো ভাই আলীকে বুঝিয়ে দিয়ে দায়িত্ব দেন তাদের মালামাল তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার। মক্কাবাসী তাঁকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করলেও তিনি তাদের ধনসম্পদ নিয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও তা বাস্তবে রূপ দেননি। তাঁর দয়ার্দ্রতার শেষ কোথায়?

মক্কা বিজয়ের পরের ইতিহাস পড়লে জানা যায়, দুনিয়ার রাজা-বাদশাহরা যখন কোনো দেশ জয় করেন তখন কী করুণ পরিণতি নেমে আসে বিজিত দেশটির ভাগ্যে। বয়ে যায় রক্তের বন্যা। শুরু হয় লুটপাট। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর ও আবালবৃদ্ধবনিতা সবার ওপরই নেমে আসে বিজয়ীদের অত্যাচারের খড়গ। বন্দীদের ভেতরেও করা হয় না কোন বাছবিচার। সম্মানিতদের করা হয় অপমানিত, আর যারা পদস্থ তাদের করা হয় অপদস্থ। কিন্তু মহানবী? তিনিই শুধু পৃথিবীর বুকে একজন, যিনি এসব পশুত্ব নীতিকে মিশিয়ে দিয়েছেন মাটির সাথে, প্রতিষ্ঠা করছেন মানবতাকে। তাই তাকে আরো বলা হয় ‘মানবতার শ্রেষ্ঠ বন্ধু’। তিনি এমন মহান মানবতাবাদী ছিলেন যে, সব প্রাণের শত্রুকে একেবারে হাতের নাগালে পেয়েও প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করে দিতে কোনোপ্রকার সন্দেহ-সংশয়, দ্বিধাদ্বন্দ্ব করেননি। এর চেয়ে চরম ও পরম মানবতা আর কি থাকতে পারে?

অমুসলিমদের প্রতি সৌহার্দ্যতা কেমন হবে তার বর্ণনা উঠে এসেছে হাদিসের একাধিক বর্ণনায়। হজরত আসমা রা: বর্ণনা করেন- আমার অমুসলিম মা আমার কাছে এসেছেন। আমি মহানবী সা:-এর কাছে জানতে চাইলাম, আমি কি আমার মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার করব? তিনি বললেন ‘হ্যাঁ’। (বুখারি)
মহানবী মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সম্মান করেছেন। হোক সে মুসলিম কিংবা অমুসলিম, কাফির, ইহুদি কিংবা খ্রিষ্টান। হাদিসে পাকে এসেছে- একবার মহানবীর সামনে দিয়ে এক ইহুদির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর তিনি ওই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন হজরত জাবের রা: বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এটি তো এক ইহুদির লাশ! তখন তিনি বললেন, ‘সে কি মানুষ না?’ (বুখারি) এ ক্ষেত্রে তিনি মানবতাকে ভুলে যাননি।

অমুসলিমদের জানমালের নিরাপত্তা দিয়ে তিনি বলেন, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করল, সে কোনো জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। অথচ তার সুগন্ধ ৪০ বছরের রাস্তার দূর থেকেও পাওয়া যায়। (বুখারি-২৯৯৫)

অমুসলিমদের ধর্মের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লøাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা তাদের মূর্তিকে গালি দিও না, তাহলে তারা তোমাদের রবকে গালি দেবে।’ সূরা কাফিরুনে আরো বলেন, ‘তোমাদের দ্বীন তোমাদের আমার দ্বীন আমার।’ দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। বনি ইসরাইলের লোকেরা ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করায় ধ্বংস হয়ে গেছে।

তাই বলা যায়, অমুসলিমদের প্রতি মহানবীর সৌহার্দ্যতা অতুলনীয় ছিল। উম্মত হিসেবে আমরাও তাদের প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করতে সর্বদা চেষ্টা করব, যাতে তারা ইসলামের আদর্শের কাছে পরাজিত হয়। দীক্ষিত হয় ইসলামের সুশীতল ছায়ায়।

লেখক : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com