গীতাতেও আছে, সাংখ্য দর্শনেও বলা আছে সুস্পষ্ট করে- আমাদের দেহ ও জগৎ-সংসার হলো প্রকৃতিজাত। জীবের আত্মা আর তার পরমাত্মা হলো পুরুষজাত। এই পুরুষ ও প্রকৃতি অনাদি এবং অনন্ত উৎসের আধার। তবে এই দুয়ের মধ্যকার ভেদ বা পার্থক্য বিদ্যমান। আর সেটিও অনাদি। বলা হয়, দার্শনিক ব্যাখ্যায় প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যে আছে অসততা, জড়ত্ব ও দুঃখ এবং পুরুষের বৈশিষ্ট্যে আছে সততা, চিৎপ্রকাশ ও আনন্দ। প্রকৃতি হলো বিনাশশীল, কখনো বিকারী। আর পুরুষ হলো অবিনাশী এবং সদাই নির্বিকার। প্রকৃতি যেন নিত্যপ্রবৃত্তির অধীন আর পুরুষ নিত্যপ্রাপ্তির সংযোগ। পরমস্রষ্টা হলেন মহাশক্তিমান আর প্রকৃতি তারই শক্তি। অধীত জ্ঞানের দৃষ্টিতে শক্তি ও শক্তিমান- উভয়েই পৃথক। এর বড় কারণ হলো, শক্তিতে পরিবর্তন আছে। কিন্তু মহাশক্তিমানে সে পরিবর্তন নেই। কিন্তু ভক্তির দৃষ্টিতে দেখলে শক্তি ও মহাশক্তিমান দুই-ই অভিন্ন। কেননা শক্তিকে মহাশক্তিমান থেকে পৃথক করা যায় না। বরং বলা চলে, মহাশক্তিমান থেকেই শক্তির সৃষ্টি। এই মহাশক্তিমান ছাড়া শক্তির পৃথক কোনো অস্তিত্ব নেই।
সেদিক থেকে পুরুষ আর প্রকৃতি হলো অভেদ। এক আধারে এর অবস্থান। তাই পুরুষ প্রকৃতি ভিন্ন থাকতে পারে না আবার প্রকৃতিরও পুরুষ না হলে চলে না। এ যেন একের সংলগ্ন অন্য। একটির কথা বললেই আরেকটি তার সঙ্গে এসে যায়। যেমন- বরফ আর হিমশক্তি। হিমশক্তি বা হিমশীতলতা ছাড়া বরফকে যেমন ভাবা যায় না, তেমনি অগ্নি আর দাহিকাশক্তি নিয়েও একই কথা বলা চলে- একটি ছাড়া অন্যটিকে কল্পনা করা যায় না। তাই হিন্দু ধর্ম-দর্শনে নারী-পুরুষ বা দেবী ও দেবের পৃথক অস্তিত্ব কল্পনা করতে দেখা যায়। এখানে দেবী মাত্রই প্রকৃতির প্রতিনিধি। অনন্ত অনাদি মহাশক্তির অন্যতম আধার।
এ মহাবিশ্ব সৃষ্টি মূলত পুরুষ আর প্রকৃতি- দুয়ের সম্মেলনেই সংঘটিত হয়। প্রকৃতি হলো এমন এক আধার- যেখানে ধারণ করা হয় সৃষ্টিকে। তাই ধর্ম-দর্শনে প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সংযোগটি গভীরভাবেই দেখানো হয়েছে। এককভাবে পুরুষ সৃষ্টিতে অক্ষম। প্রকৃতি হলো তার সহযোগী। অন্যভাবে বললে, প্রকৃতিও এককভাবে সৃষ্টি করতে পারে না। সেখানে পুরুষের সহযোগিতা চাই। পুরুষ আর প্রকৃতি মিলেই এ সৃষ্টি চরাচর। কিন্তু সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য এককভাবে পুরুষ অথবা প্রকৃতিকে এগিয়ে আসতে হতে পারে। দুর্গাপূজা সে কথাই বলে- যেখানে মূলত নারীশক্তি সৃষ্টিকে রক্ষার কাজে এগিয়ে এসেছে। পৌরাণিক কথকতায় দুর্গাপূজার নানা ব্যাখ্যা ও উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে নারীশক্তির উত্থান। প্রচলিত ব্যাখ্যা ও উল্লেখগুলো ভিন্ন হলেও নারীশক্তির উত্থানের মর্মকথা হিসেবে এর সবটিকেই মান্য করা চলে। এ জন্য দুর্গাপূজাকে বলা চলে নারীশক্তির সাধনা। পৌরাণিক থেকে আধুনিক- আমাদের এই জীবনযাত্রায় নারীশক্তির প্রয়োজনীয়তা বারবার দেখা গেছে এবং তারা বিজয়ী হয়েছে। এ শক্তিকে খর্ব করে দেখার কিছু নেই।
কোনো কোনো দর্শন বা মতবাদে নারীশক্তিকে অবজ্ঞা করার একটি ব্যাপার রয়েছে। নারীদের গৃহবন্দি রেখে, গৃহকর্মে তাদের সীমাবদ্ধ করে, পোশাক-পরিচ্ছদে অবগুণ্ঠিত ও বিধিনিষেধের নিগড়ে আটকে রেখে শুধু পুরুষশক্তি দিয়ে জগৎ জয়ের কল্পনা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। এই জগজ্জয় আপাতদৃষ্টিতে আমাদের চোখেও পড়ে। বিশেষ করে পেশিশক্তিতে বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারটি কখনো মনে ভয়ও জাগায়। যুক্তি সেখানে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত, আবেগ সম্পূর্ণভাবে জাগ্রত। কিন্তু বিশ্বের ইতিহাসে পেশিশক্তির বিজয় আপাতভাবে দেখা গেলেও মেধাশক্তির বিজয়ীরাই শেষ পর্যন্ত টিকে আছে। এ ক্ষেত্রে নারীশক্তিকে অবজ্ঞা করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যে জাতি নারীশক্তিকে অবজ্ঞা করেছে অথবা তাদের মধ্যে সম্ভাবনাকে জাতীয় উন্নতির সঙ্গে যুক্ত করেনি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অগ্রগতির ধারায় সে জাতির কোনো নাম-নিশানা নেই। এই জগতে নারীশক্তিকে পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি সংগ্রাম করতে হয়েছে। তার কারণ হলো, সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই নারীদের ওপর চলেছে পুরুষশক্তির দলন। তবে অল্পদিনের মধ্যেই অনেকে বুঝতে পেরে সমাজে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করেছে। আর এতেই জাতীয় উন্নতির ক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও তাদের অবদান রাখতে সক্ষম হয়। উন্নত দেশ বলে যে দেশগুলোকে আজ আমরা চিনি, সেগুলোর প্রতিটিই নারীশক্তিকে তাদের জাতীয় উন্নতির ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতায় তিনি উল্লেখ করেছেন- কোনোকালে বা কোথাও পুরুষের শক্তি এককভাবে জয়ী হয়নি; সেখানে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে নারীরা। এ কথাটি সত্য বটে। কিন্তু এখানেও সম্পূর্ণভাবে সত্য প্রকাশ হয়নি। নারীরা শুধুই সাহস ও প্রেরণার উৎস- এ ধারণাটিও নারীশক্তিকে খানিকটা খর্ব করে। এখনো আমাদের মতো দেশগুলোয় শক্তি বলতে শুধুই শারীরিক শক্তিকে বোঝানো হয়ে থাকে। বৌদ্ধিক, মানসিক ও প্রশান্তিগত শক্তিও যে শক্তি এবং তা অনেকটাই প্রয়োজন সার্বিকভাবে সুস্থ জীবনযাপনে- এ কথা এখনো অনেকে ঠিক বুঝতেই পারেন না। শারীরিক শক্তিতে নারীদের চেয়ে প্রকৃতিগতভাবে পুরুষরা খানিকটা এগিয়ে- এটা হয়তো ঠিক। তবে ব্যাপারটি বৈশ্বিক দিক থেকে সত্য নাও হতে পারে। একজন আফ্রিকান নারী আর একজন বাঙালি পুরুষের শক্তির তারতম্য করা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে বাঙালি পুরুষের চেয়ে আফ্রিকান নারীর শারীরিক শক্তি বেশি হতে পারে। শারীরিক শক্তির দিক থেকে পুরুষদের মধ্যেই কি সমানভাব বা সমতা বিদ্যমান? তা প্রমাণিত হয়নি। পুরুষদের মধ্যেও শারীরিক শক্তিগত তারতম্য রয়েছে। সারা পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করলে এর একটি প্রমাণ আমরা অতিসম্প্রতি পেয়েছি বলে মনে হয়। ফুটবল দল হিসেবে পুরুষদের চর্চা ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এযাবৎকালে আমাদের খুব একটা আশার ফল নিয়ে আসেনি। অথচ অল্প কিছুদিন আগে মাত্র নারীরা ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ করেছে এবং এ বছর সাফ নারী ফুটবলে তারা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ফুটবল খেলা খানিকটা শারীরিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত। অবশ্যই এতে কৌশল রয়েছে, দক্ষতাও রয়েছে। সাফ ফুটবল প্রতিযোগিতায় তারা যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, এতে বোঝা যায় নারীশক্তির দিক থেকে আমাদের নারী ফুটবল দল এই সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অবশ্যই একটি গৌরবজনক স্থানের দাবিদার। পুরুষ ফুটবল দল তেমনটি গর্বের কোনো সংবাদ আমাদের দিতে পারেনি। অথচ নারীরা যখন ফুটবল খেলা শুরু করে, তখন তাদের নানা রকমের সামাজিক ভ্রকুটির মুখোমুখি হতে হয়েছে। যে দেশে খোলা মাঠ পেলেই ছেলেরা ছোট থেকে ফুটবল খেলে, সে দেশে ছেলেদের ফুটবলে কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। আর নানা বিধিনিষেধে থেকে অল্প কয়েকটি স্থানে নারীরা ফুটবলচর্চা করে আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। তা হলে বোঝাই যায়, নারীদের যদি সমাজ স্বীকার করে এবং তাদের কর্মক্ষেত্রকে পুরুষের মতো অবমুক্ত করে দেওয়া হয়- তা হলে তারা সমাজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে পারে এগিয়ে আসতে। ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নানা মাত্রায় দেখা গেছে। সুলতানা রাজিয়া, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, লীলা নাগ প্রমুখ ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। তাদের সারিতে আরও বহু নারীর নাম যুক্ত করা যায়। ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণ বিষয়ে খুব বড় রকমের এবং ব্যাপকভাবে গবেষণা কিংবা গ্রন্থ রচনা হয়েছে বলে মনে হয় না। হলেও সেগুলো ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়নি। এই চর্চা বা প্রচার না পাওয়ার পেছনেও পুরুষশক্তির ক্রুরতা হয়তো কাজ করে। যে সমাজ ও দর্শন নারীশক্তিকে পুরুষশক্তির প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে এবং নারীকে শুধুই সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে মনে করে একাধিক নারীসঙ্গ গ্রহণকে নানাভাবে বৈধতা দেয়, সেখানে নারীশক্তি ও পুরুষ সত্যিই যুগপৎভাবে কাজ করতে পারে না। এখানেই ব্যর্থ হয় পুরুষ ও প্রকৃতির যে চিরায়ত বিধান, এই বিধানের ধারণাটি। নারীশক্তি বা প্রকৃতিকে নানাভাবে অবজ্ঞা করে রাখার প্রতিফল সমাজ অল্পদিনের মধ্যেই বুঝতে পারে। শিক্ষা, দীক্ষা, চিন্তা, সংস্কৃতি, অগ্রগতি- সবকিছুতে তখন সমাজ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে এবং পুরুষশক্তি হয়ে ওঠে দানবিক। দানবিক পুরুষশক্তি তখন গৃহের নারীকেও মনে করে প্রতিপক্ষ। স্বীয় জায়া-কন্যা-জননীর ওপরও তখন পুরুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এখনো আমাদের চারপাশের বহু দেশে কন্যাসন্তানকে বিক্রির খবর আমরা পাচ্ছি। শুধু অভাবের তাড়নায় কন্যাসন্তানকে বিক্রির জন্য তারা বাজারে তোলে- এমনটি নয়। অভাব এখানে মুখ্য হলে ছেলেশিশু ও মেয়েশিশুতে প্রভেদ হতো না। কিন্তু মেয়েশিশু যেখানে শুধু বিক্রি হয়, সেখানে বোঝাই যায় নারীশক্তির ওপর তাদের আস্থা কতটা তলানিতে। তবে এভাবে সভ্যতা প্রগতিমুখো হয় না। প্রাচীন পারস্য নামধারী দেশটিতে অতিসম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং তার রেশ যেভাবে জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে বোঝা যায়- অগ্রগতিবিরুদ্ধ স্রােতে নারীশক্তি হয়ে ওঠে আলোর দিশারি। অসুরের বিরুদ্ধে দুর্গাদেবীর প্রতিরোধ, সেটিই পৌরাণিক নিশ্চয়ই। কিন্তু আধুনিক, বলা চলে সাম্প্রতিক মাশা আমিনিকেন্দ্রিক প্রতিরোধকে কি এর থেকে বিচ্ছিন্ন করা চলে? চলে না। তাই বলা চলে, বিরুদ্ধতার বিরুদ্ধে নারীশক্তির প্রতিরোধ পৌরাণিককাল থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত প্রবহমান এবং এটাই স্বাভাবিক।
সৌমিত্র শেখর : উপাচার্য, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
এ জাতীয় আরো খবর..