হৃদরোগ ও স্ট্রোক ইত্যাদি জীবননাশী রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছরই ২৯ আগস্ট ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।
এ বছর ‘হৃদয় দিয়ে হৃদয়কে ভালোবাসুন, প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা করুন’ এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সপ্তাহব্যাপী নানা আয়োজনে বিশ্ব হার্ট দিবস উদযাপন করেছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ।
পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?
আমরা যত রোগ দ্বারা আক্রান্ত হই তা প্রধানত দুই রকম। একটি হলো অসংক্রামক রোগ এবং অপরটি হলো সংক্রামক রোগ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের মৃত্যুর জন্য প্রতিরোধযোগ্য কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজেস (উচ্চ রক্তচাপ, করনারি আর্টারি ডিজিজ যার কারণে হয় হার্ট অ্যাটাক, সেরেব্রোভাস্কুলার ডিজিজ বা স্ট্রোক), ক্যান্সার, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (এম্ফাইসেমা, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস) ও ডায়াবেটিস মেলিটাস- মূলত এসব মরণঘাতী রোগ দায়ী।
সংস্থাটি বলছে, প্রতি বছর পৃথিবীব্যাপী মোট চার কোটি ১০ লাখ লোক মারা যায় নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের (এনসিডি) কারণে, যা মোট মৃত্যুর ৭১ শতাংশ।
প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৩০-৬৯ বছর বয়সীদের অকাল মৃত্যু হয় এক কোটি ৫০ লাখ। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশের উপরে অকাল মৃত্যু হয় নিম্ন ও মধ্য আয়ের হতভাগা গরিব দেশগুলোতে। সেরিব্রোভাস্কুলার ডিজিজ, ক্যান্সার, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ ও ডায়াবেটিস- এই চারটি রোগের কারণে পৃথিবীব্যাপী মারা যায় যথাক্রমে এক কোটি ৭৯ লাখ, ৯৩ লাখ, ৪১ লাখ ও ১৫ লাখ। এই চারটি রোগের কারণেই প্রতি বছর পৃথিবীতে অকালমৃত্যু হয় ৮০ শতাংশ লোকের।
কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ বলতে কী বুঝায়?
কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ বলতে বুঝায় হার্ট নিজের, হার্টে সাপ্লাই দেয়া করোনারি আর্টারির এবং সারা শরীরে রক্তবহনকারী আর্টারি ও শিরার রোগ।
করোনারি আর্টারি ব্লক হয়ে যেসব রোগ হয় : হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিউর, এরিদ্মিয়া এবং এরিদ্মিয়া থেকে হঠাৎ মৃত্যু ইত্যাদি।
মস্তিষ্কের ধমনীতে রক্ত চলাচল রুদ্ধ হয়ে সাধারণ একটি রোগ অহরহ হচ্ছে। সেটি হলো স্ট্রোক। এ ছাড়াও আছে ডিপ ভেইন থ্রম্বসিস এবং পালমোনারি এম্বলিসম নামক আরেকটি হঠাৎ মৃত্যুর রোগ যা পালমোনারি রক্তনালী জমাট রক্ত দিয়ে হঠাৎ বন্ধ হয়ে ঘটে। এছাড়াও আছে নানা ধরণের হৃদরোগ।
আমাদের দেশে হৃদরোগ এখনো এক নম্বর ঘাতক ব্যাধি। ২০২০ সালে বাংলাদেশে মৃত মানুষের মধ্যে এক-পঞ্চমাংশের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে হার্ট অ্যাটাকে।
নীরব ঘাতক ‘এনসিডি’র রোগগুলোকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
সংক্রামক রোগের ঝুঁকির দিকগুলো তিনটি বড় ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়।
প্রথমত, অভ্যাসগত ঝুঁকি যা মানুষ চাইলে সহজেই পাল্টাতে পারে। এর মধ্যে আছে ধূমপান, মদ্যপান, পুষ্টিহীন খাবার (কম ভিটামিন, কম শাকসবজি ও কম প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার, অধিক ক্যালরি-লবণ, বেশি সেচুরেটেড ফ্যাট-কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ খাবার) এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি বা শরীরচর্চাহীনতা।
দ্বিতীয়ত, শারীরবৃত্তীয় ঝুঁকি যা পাল্টানো অসম্ভব নয় তবে খানিকটা কষ্টকর। যেমন হাইপারটেনশন, অতিরিক্ত ওজন, হাইপারগ্লাইসেমিয়া ও হাইপারলিপিডেমিয়া।
তৃতীয়ত, অপরিবর্তনীয় ঝুঁকি, যেমন, বয়স, লিঙ্গ, জেনেটিক ও পারিবারিক, জাতিগত বিভিন্নতা ইত্যাদি।
এবার আসুন দেখি, সহজেই যা পরিত্যাগ করে সুস্থ থাকতে পারি, তা না করার কারণে কী তার পরিণতি। বিশ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর অতিরিক্ত তামাক সেবন, পাতে অতিরিক্ত লবণ, মদ্যপান এবং কম ফিজিক্যাল এক্টিভিটির কারণে মারা যায় যথাক্রমে ৭২ লাখ, ৪১ লাখ, ৩৩ লাখ এবং ১৬ লাখ লোক।
সহজেই পাল্টানো যায় এমন ঝুঁকির উপাদান : ধূমপান, মদ্যপান, পুষ্টিহীন খাবার ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমান বিশ্বে ১৩০ কোটি ধূমপায়ী আছে এবং এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়াবে ১৬০ কোটিতে। প্রতি ৫ সেকেন্ডে একজন করে ধূমপায়ী সম্পর্কিত মানুষ মারা যাচ্ছে। তামাক তার অর্ধেক ব্যবহারকারীকে হত্যা করে। তামাক সেবনে প্রতি বছর ৮০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। আর প্রায় ১২ লাখ লোকের মৃত্যু হয় ধূমপায়ীদর ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসার ফলে।
গড়ে পৃথিবীর ধূমপায়ীদের মধ্যে ৪৩.৫ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং মাত্র ১৪.৩ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার ওপরে।
একটি সিগারেটে ৪,৮০০ এরও বেশি রাসায়নিক থাকে, যার মধ্যে ৬৯টি ক্যান্সারের কারণ হিসেবে পরিচিত।
সুস্থ খাবারের পুষ্টিগুণ সস্তা, সহজলভ্য ও ন্যাচারাল উৎসেই বিদ্যমান
ধনীদের মজা করে কিনে খাওয়া খাবারেই সবচেয়ে বেশি রোগবালাই আর গরিবদের ন্যাচারাল সস্তা খাবার যা সর্বত্রই বিরাজমান তার মধ্যে নেই কোনো রোগবালাই। ভিটামিন, মিনারেল, পানি ও ডায়েটারি ফাইবার যা শরীরের জন্য অত্যাবশকীয়, লাগে কম কিন্তু সর্বত্রই সহজ লভ্য সহজ পাচ্য, অথচ তারই ‘অভাবে’ জগৎ জোড়া মানুষ রোগে ভোগে অজ্ঞতার কারণে। যেমন জগতে পানির তেমন কোনো অভাব নেই, আর ভিটামিন, মিনারেল আর ফাইবারসমৃদ্ধ শাকসবজি ফল-মূল সর্বত্রই সস্তায় পাওয়া যায়। অথচ এত বড় ভুবনে এসবেরই অভাবজনিত কারণে রোগ হচ্ছে অহরহ। অন্য দিকে তুলনামূলকভাবে দামি কিন্তু পুষ্টিহীন খাবার অতি ভোজনের কারণে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। এ সবের আধিক্য আর অসম বণ্টনের কারণেই তো হচ্ছে মরণঘাতী আর নীরব ঘাতক ‘এনসিডি’র রোগসমূহ।
লাইফস্টাইলের পরিবর্তন ছাড়া হৃদরোগমুক্ত থাকা যাবে না
বর্তমান বিশ্বের জীবন ধারায় লাইফস্টাইলের পরিবর্তন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব মহামারী আকারে দেখা দেয়ার অন্যতম কারণ।
ফ্যাট জাতীয় খাবার কার্বোহাইড্রেটের চেয়ে দামি এবং কম প্রয়োজন। অথচ এগুলোর ন্যাচারাল ফর্মের অপেক্ষাকৃত সস্তা সহজলভ্য খাবারকে প্রোটিনের চেয়েও দামি আর মুখরোচক বানিয়ে ব্যবসা করছি সাথে রোগ তৈরির সব উপাদান ঢুকিয়ে দিচ্ছি।
শরীরের চাহিদা পূরণে কম খেলে কিংবা না খেলেও চাহিদা পূরণ হয় আর বেশি খেলে ক্ষতিকর তা বাজার থেকে মানুষ বেশি দাম দিয়ে কিনে বেশি খেয়েই অসুস্থ হচ্ছে। অন্য দিকে যা খুব দরকার ও সস্তা এবং প্রকৃতিতে সহজলভ্য যেমন লো কার্ব, আনসেচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্সফ্যাটমুক্ত খাবার, ন্যাচারাল প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিড, এসেনসিয়াল এমাইনো এসিড, ডায়েটারি ফাইবার ইত্যাদি সমৃদ্ধ খাবার, ন্যাচারাল ফল-মূল, শাকসবজি চাহিদামতো না খাওয়ার কারণে অসুস্থ হচ্ছে। সব মিলিয়ে ধনীরা অসুস্থ হচ্ছে বেশি খেয়ে আর গরিবরা অসুস্থ হচ্ছে না জানার কারণে উপযুক্ত খাবার না খেয়ে।
যে চার ধরনের খাবার না খেলে হৃদরোগ মুক্ত থাকা যায়
আমাদের খাবারগুলোর মধ্যে চারটি এমন খাবার আছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে একবারে না খেলেই বরং জীবন হৃদরোগমুক্ত থাকবে বেশি। খাবারগুলো দামিও বটে। অথচ এই চারটি খাবারই আরো বেশি দামে কিনে বেশি বেশি করে খাই।
ডব্লিউএইচও মতে চারটি খাবার হলো চিনি, সেচুরেটেড ফ্যাট, কোলেস্টেরল ও ট্রান্স ফ্যাট ইত্যাদি।
আমরা কী খাই
আমরা খাবার হিসেবে যা খাই তা হয় প্রাণী নতুবা উদ্ভিদজাত। আমরা যে খাবার খাই তা মূলত সাত ধরনের : কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, পানি ও ডায়েটারি ফাইবার।
প্রোটিন, ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেটকে একত্রে ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট বলে। ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টগুলোর মধ্যে আবার সবচেয়ে সস্তা, ন্যাচারাল, পর্যাপ্ত আর সহজ লভ্য হলো কার্বোহাইড্রেট।
আমরা যে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার খাই তা প্রধানত ফ্রি সুগার, শর্ট চেইন কার্বোহাইড্রেট, স্টার্চ (উৎস-চাল,গম,আলু, যব, ডাল জাতীয় খাবার) এবং নন-স্টার্চ পলিসেকারাইড বা ডায়েটারি ফাইবার (উৎস-সেলুলোজ, হেমিসেলুলোজ, ফল, শাকসবজি) এবং সুগার এলকোহল (শক্ত ফল, ভুট্টা) ফর্মে খাই।
তবে এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোনো একটা নির্দিষ্ট কার্বোহাইড্রেটই শরীরের জন্য অত্যাবশকীয় নয়। প্রকৃতিতে ফ্রি সুগার এর দু’টি উৎস আছে। একটি টাটকা ফল, শাকসবজিতে এবং দুধে পাওয়া যায় এবং যার খাবার ব্যাপারে এমনকি ডায়াবেটিস রোগীদেরও তেমন কোনো বাধা নেই। আরেকটি হলো আখ ও খেজুরের রস এবং তাদের বাই প্রডাক্ট চিনি ও গুর। এগুলো সীমিত আকারে খাওয়া যায়।
প্রাকৃতিকভাবে হৃৎপিণ্ড নিজেই নিজের যত্ন নেয়
কোষের বিভাজন ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে আমাদের শরীর মূলত তিন ধরনের কোষ দিয়ে তৈরি। ক্রমাগত বিভাজন ক্ষমতাসম্পন্ন কোষ, সুপ্ত কোষ বা কুইসেন্ট কোষ এবং অবিভাজিত কোষ। ক্যান্সার নামক মরণব্যাধি সর্বদাই ক্রমাগত বিভাজিত কোষে হয়। যেমন, ত্বক, ফুসফুস এবং খাদ্যনালীর ক্যান্সার ইত্যাদি। সুপ্ত বা স্টেবল কোষ যেমন লিভার, কিডনির পেরেনকাইমাল কোষ, রক্তনালী ও হার্টের ভিতরের লাইনের এন্ডোথেলিয়াল কোষ ও স্মুথ মাসল। এসব কোষ স্টিমুলেশন ছাড়া সাধারণত বিভাজন হয় না ফলে এগুলোতে ক্যান্সারও কম হয়। কিন্তু শরীরে এমন তিনটি টিস্যু আছে যা অবিভাজিত কোষ দিয়ে তৈরি। সেগুলো হলো, ঐচ্ছিক মাংশপেশি, হৃদপেশি এবং ব্রেইন কোষ নিউরন। এ জন্য প্রাকৃতিকভাবেই হৃদপেশিতে ক্যান্সার হয় না। এসব কোষে তো ক্যান্সার হয়ই না, তদুপরি কোনো কারণে কোষসমূহ মারা গেলে তা আর ওই কোষ দিয়ে পূরণ হয় না, তা ফাইব্রাস টিস্যু দিয়ে পূরণ হয় যা কোনো কাজে লাগে না বরং কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
আমাদের হৃদযন্ত্র কিন্তু নিজেকে সব সময় সচল রাখার জন্য যথেষ্ট আন্তরিক। আমাদের অনেকের ফুসফুসের ক্যান্সার হয়, রক্তের ক্যান্সার, অন্ত্রের ক্যান্সার হয়, কিন্তু সাধারণত হার্টের ক্যান্সার হয় না। এর একটি কারণ হলো হৃৎপিণ্ডে কোষ বিভাজন সাধারণত হয় না। আর অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনই তো ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। সেটাই হৃৎপিণ্ড হতে দেয় না। অন্য দিকে, রক্তবাহিত ক্যান্সারের উপাদান কার্সিনোজেন সাধারণত হৃৎপিণ্ডে শোষিত হয় না।
লেখক : স্বাস্থ্যবিষয়ক নিবন্ধকার ও কলামিস্ট