এক দিকে জ্বালানি তেলের ‘আগুনে’ পুড়ছে সাধারণ মানুষ, অন্য দিকে হু হু করে বাড়ছে প্রতিটি পণ্যের দাম। বাজারে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, আটা, আদা, রসুন, এলাচ, শুকনা মরিচ, ভোজ্যতেলসহ প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমে সব ধরনের সবজির সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও দাম চড়া। এতে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস দিন দিন বাড়ছেই। তারা বলছেন, বাজারে খাদ্যপণ্যের কোনো সঙ্কট নেই। চাহিদার সবটুকু পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু দাম অনেক বেশি। অথচ তদারকি সংস্থাগুলোও প্রায় নিশ্চুপ। সংশ্লিষ্টরা দেখেও যেন টিনের চশমা পরে আছে।
কেন তারা দাম কমাতে পদক্ষেপ নিচ্ছে না? কেনই বা তারা দর্শকের ভ‚মিকা পালন করছে? প্রশ্নের উত্তর নেই। প্রতিদিন খাবার কিনতে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের। ব্যয় সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। তাই সরকারের এ বিষয়ে বিশেষ নজর দেয়া জরুরি বলছে সাধারণ মানুষ। আশ্চর্যের বিষয়, চালের দাম আর বাড়বে না- মন্ত্রীর এমন আশ্বাসের পরই দেশে বেড়ে যায় চালের দাম। তেল, ডাল, ডিমসহ প্রায় সব নিত্যপণ্য নিয়েও একই কাণ্ড। গত কয়েক বছরে মানুষও নমুনা বুঝে গেছে। মন্ত্রী বা সরকারি উচ্চপর্যায় থেকে কোনো কিছুর দাম কমার আশ্বাস বা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি মানেই যেন নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির আগাম বার্তা। সেই দৃষ্টে তাদের আশ্বাস বা হুঁশিয়ারি শোনামাত্র ক্রেতারা সাধ্যমতো যতদূর সম্ভব দ্রুত ওই পণ্য কিনে ফেলছেন।
এ দিকে বাজারের এ সিনড্রোম নির্বাচন পেরিয়ে ভর করেছে এখন শিক্ষাব্যবস্থা তথা পাবলিক পরীক্ষায়ও। কিছু দিন ধরে শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে বেশ গর্ব করছিলেন। বলছিলেন, এখন আর প্রশ্ন ফাঁস হয় না। তারপরও কেউ প্রশ্ন ফাঁস করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তার গর্ব ও হুঁশিয়ারির পর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। এক-দু’টি নয়, সম্প্রতি শেষ হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় ফাঁস হয়েছে ছয়টি বিষয়ের প্রশ্ন।
একজন কেন্দ্রসচিবকে ‘ধামা’ বানিয়ে চাপা দিয়ে ফেলা হয়েছে ঘটনাটি। চালিয়ে দেয়া হয়েছে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ নামে। একে মোটেই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে ফেলা যায় না। এসএসসি পরীক্ষা মোটেই কোনো বিচ্ছিন্ন পরীক্ষা নয়। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড পাড়া-মহল্লার যেনতেন বিচ্ছিন্ন কোনো বোর্ড বা সভা নয়। তাই দিনাজপুরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের শেষ হওয়া এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা খুব বাজে বার্তা দিয়েছে। ঘটনা ধরা পড়ার পর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, কৃষিশিক্ষা ও রসায়ন পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এক সাথে ছয়টি বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁস রেকর্ড গড়া ঘটনা। একজন কেন্দ্রসচিবের একার পক্ষে এমন ঘটনা ঘটানো কি সম্ভব?
গত বছর কয়েক ধরে অবিরাম প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। একদিকে বলা হচ্ছে- এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের কথা, কাউকে ছাড় না দেয়া, ধরা পড়লে কঠোর শাস্তির হুমকি। অন্য দিকে, পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি বিসিএস, মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। তা গড়িয়েছে ব্যাংকসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায়ও। নার্স নিয়োগের পরীক্ষাও বাদ যায়নি প্রশ্ন ফাঁসের কলঙ্ক থেকে। আয়োজনে এসব পরীক্ষা পাবলিক পরীক্ষার কাছাকাছি।
মাঝে মধ্যে প্রশ্ন ফাঁস চক্রের ‘হোতা’ ধরার খবর আসে। র্যাব, গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাঞ্চল্যকর অভিযানে প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের সম্পর্কে জানানো হয়। নানান ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রশ্ন ফাঁস কর্মটি দু’-চারজনের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে শুরু করে সরকারি প্রেসে ছাপা, কেন্দ্রে কেন্দ্রে বিতরণ পর্যন্ত পরতে পরতে লাগছে অনেক হাতের ছোঁয়া। ঘটনাচক্রে কখনো কোনো ঘটনা ধরা পড়ে; কিন্তু প্রায়ই পুরো সত্য প্রকাশ না করে আংশিক প্রকাশ বা কাউকে রেহাই দিতে গিয়ে সত্য আড়াল হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। যা প্রকারান্তরে প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের জন্য কেবল উৎসাহ নয়, প্রণোদনাও। যার পরিণতিতে ঘটছে প্রশ্ন ফাঁসের একটির পর আরেকটি ঘটনা।
স্থানীয়, জাতীয় যেকোনো পর্যায়ে প্রশ্ন ফাঁস রোধের প্রধানত দায়িত্ব সরকারের। সেই দায়িত্ব না নিয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান একেবারেই গৎবাঁধা কাজ। দায়িত্ব খেলাপও বলা যায়। তারওপর ‘এখন আর প্রশ্ন ফাঁস হয় না, কাউকে ক্ষমা করা হবে না, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে’ ধরনের হুমকি-ধমকি পর্যবসিত হচ্ছে বর্তমানে সুষ্ঠু নির্বাচনের ওয়াদা বা নিত্যপণ্যের দাম কমানোর মতো আশ্বাসে।
এমনিতেই মানুষের মধ্যে বিনাভোটে জয় ও বিনাপরীক্ষায় পাসকে সমার্থক করার একটি প্রবণতা প্রচলন হয়ে গেছে সমাজে। সেই সাথে সুষ্ঠু ভোটের ওয়াদা করে জালিয়াতি-কারচুপি, ন্যায্যমূল্যের আশ্বাসের পর দাম বাড়ানোর মতো দশা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়েও। ‘প্রশ্ন আর ফাঁস হবে না’ গ্যারান্টির মধ্যে ফাঁসের বার্তা মিলছে অহরহ। ফলে, প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে মামলা, কিছু ধরপাকড় আর গরম কথা মোটেই সমাধান নয়। দিনাজপুরের ঘটনায়ও ভুরুঙ্গামারী থানায় মামলা হয়েছে। কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারীকে ধরে জেলে পাঠানো হয়েছে। ভুল করে অন্য বিষয়ের প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণের ঘটনাও ঘটেছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে। এটি মোটেই সমাধান নয়।
সম্প্রতি শেষ হওয়া মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস প্রমাণের বহু খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। বিভিন্ন বোর্ডের অধীন কিছু কেন্দ্রে দেখাদেখির পরিবেশে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র শিক্ষকের লিখে দেয়ার লজ্জাজনক খবরও পাওয়া গেছে। এমন একটি ঘটনায় পটুয়াখালীতে মামলাও হয়েছে।
মাঝে কিছু দিন প্রশ্ন ফাঁস কিছুটা কমেছিল। এখন আবার কেন তা বাড়বাড়ন্ত, সেটি ভাবার মূল দায়িত্ব সরকারের। দায়িত্বের দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন অভিভাবকরা। দুঃখজনকভাবে কোথাও কোথাও এ অনৈতিকতায় অভিভাবকদেরও জড়িয়ে পড়ার কুচর্চার খবর মিলছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেতে মা-বাবাও দৌড়ান। সন্তানও মা-বাবাকে দ্বিধাহীনভাবে বলছে, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন জোগাড় করে দিতে। যে মা-বাবার সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দেবেন, তারাই সন্তানকে অনৈতিক সুবিধা দিতে কাজ করলে সমাজ নৈতিকতা শিখবে কিভাবে, কোত্থেকে? চিত্রটি জাতির জন্য চরম বিপজ্জনক।
প্রশ্ন ফাঁস অপরাধ বিচারে মারাত্মক ‘দুর্নীতি’। কেবল সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় নয়, বিষয়টি সবার জন্য ভাবনার। প্রশ্ন ফাঁসের কারণে একদিকে দুর্বল মেধার শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাচ্ছে, প্রকৃত মেধাবীরা যাচ্ছে পিছিয়ে। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার সাথে আমাদের নৈতিক বিষয়টি জড়িত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরীক্ষার আগের রাতে মোটা অঙ্কের টাকায় কেনাবেচা হয় এসব প্রশ্ন। একটি অসাধু মহল ওইসব পরীক্ষা আয়োজনকারী কিংবা দায়িত্বপালনকারীদের সাথে যোগসাজশে আগেই প্রশ্ন পেয়ে যায়। পরে সতর্কতার সাথে চাকরিপ্রার্থী কিংবা পরীক্ষার্থীদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। কোনো কোনো সময় একটি নির্দিষ্ট স্থানে পরীক্ষার্থীদের রেখে প্রশ্ন ও উত্তর দিয়ে দেয়া হয়। চাকরিপ্রার্থীরা ওই স্থানে রাত যাপন করে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও সমাধান থেকে প্রস্তুতি নিয়ে পরদিন পরীক্ষায় অংশ নেন।
কখনো কখনো টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন সরাসরি নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে যায়। তাদের মধ্যে অনেকে সেই প্রশ্নের স্ক্যানড কপি মুঠোফোনে থাকা ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন। গোটা বিষয়টি সমাজে অনৈতিকতার ভয়াবহতা ইঙ্গিত করে।
এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা; বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএস, ব্যাংকসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় মামলা হলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ২০০৯ সাল থেকে এই ১৪ বছরে ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় হয়েছে দুই শতাধিক মামলা। তবে এগুলোর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে শুধু ৪৫টির। মাত্র একটি মামলায় এক আসামির অর্থদণ্ড হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা।
সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় বেশি জড়িত শিক্ষক ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সে জন্যই শিক্ষা সচিবের অসহায় উচ্চারণ- ‘কাকে বিশ্বাস করব?’ কিন্তু কথা হলো- বিশ্বাস করার মতো মানুষকে তারা যথাস্থানে বসাচ্ছেন কি না? বর্তমানে আমরা যে চর্চা দেখছি, তাতে অনেক সময় যোগ্য বিকল্প থাকা সত্ত্বেও অযোগ্যরা চেয়ারে বসছে। যখন যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের দায়িত্বশীল পদে বসানো হয় তখন আক্ষেপ না করে সে মেকানিজমে পরিবর্তন আনা দরকার।
শিক্ষাকে রাজনৈতিক আর পরীক্ষাকে নির্বাচনের মতো বিষয়াদিতে মিলিয়ে ফেললে এর ভয়াবহতা দিন দিন আরো তীব্র না হয়ে পারে না। তাই প্রশ্ন ফাঁসের মতো এমন ঘৃণ্য অপরাধের সাথে যারা জড়িত তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া উচিত নয়। রাজনৈতিক বা অন্য কোনো প্রভাবশালী কেউ জড়িত থাকলেও যেন ছাড় না পায়। পুরো চক্রটিকে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত, যাতে দ্বিতীয়বার কেউ প্রশ্ন ফাঁস করতে সাহস না পায়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট