শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫১ অপরাহ্ন

ধীরে ধীরে আত্মহত্যার নাম ধূমপান

প্রফেসর কর্নেল (অব:) ডা: জেহাদ খান
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২২
  • ১১৯ বার

তামাকের উৎপত্তি আমেরিকা মহাদেশে। ইউরোপীয়রা কলোনি বিস্তারের পাশাপাশি এ বিষাক্ত দ্রব্যটি সিগারেট তৈরির আধুনিক মেশিন আবিষ্কার করে বাণিজ্যিকভাবে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়। এর জন্য আকর্ষণীয় ব্যায়বহুল বিজ্ঞাপন দেয়া আর বন্দনা করতে কবি-সাহিত্যিকেরও অভাব হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, স্বর্গে যদি সিগারেট খাওয়ার অনুমতি না থাকে তাহলে তিনি স্বর্গে যাবেন না। কয়েক শতাব্দী ধরে সিগারেট আধুনিকতা, অভিজাত্য ও স্মার্টনেসের প্রতীক হিসেবে থাকার পর একবিংশ শতাব্দীতে এটি চরম ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। তামাকে দুই থেকে চার হাজারটি বিভিন্ন পদার্থ রয়েছে। এর মধ্যে ৬০টির বেশি কারসিনোজেন (ক্যান্সার জীবাণু)। তামাকে রয়েছে নিকোটিন যা নেশা সৃষ্টিকারী এবং হৃদকম্পন ও রক্তচাপ বাড়ায়। এতে রয়েছে কার্বনমনোক্সাইড যা শরীরে অক্সিজেনের অভাব ঘটায়। ধূমপানে অভ্যস্ত লোকেরা সিগারেট খেলে তাদের মনোযোগ বৃদ্ধি পায়,কিছুটা ক্লান্তি দূর হয় ও মেজাজ ফুরফুরে হয়। বিনিময়ে তাদের অসংখ্য শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ফুসফুসের ক্যান্সার ছিল বিরল। বর্তমানে ১৮ লাখ লোক প্রতি বছর এ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করে থাকে যার ৯০ শতাংশ কারণ হচ্ছে ধূমপান। ধূমপানের কারণে শ্বাসনালী, খাদ্যনালী, অগ্নাশয়, কিডনি ও মূত্রথলিতে ক্যান্সার হয়ে থাকে। ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে সিওপিডি বা ব্রঙ্কাইটিসের কারণ হচ্ছে ধূমপান। ২৫ শতাংশ হৃদরোগের কারণ ধূমপান। তা ছাড়া ব্রেইনের স্ট্রোক, পায়ের রক্তনালী শুকিয়ে যাওয়া, গ্যাস্ট্রিক-আলসার, যৌন ক্ষমতা হ্রাস, রোগ প্রতিরোধ কমে যাওয়া ইত্যাদির সাথে ধূমপান জড়িত। প্যাসিভ স্মোকিং বা পরোক্ষ ধূমপানে মা ও শিশুদের অনেক ক্ষতি হয়। এমনকি মাতৃগর্ভের শিশুর বৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে। ধূমপায়ীদের ওজন অধূমপায়ীদের চেয়ে দুই-চার কেজি কম হয়ে থাকে এবং বৃদ্ধ বয়সে তাদের খাদ্যের রুচি ও স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে।

২০২০ সালে সিগারেটজনিত কারণে পৃথিবীতে মৃত্যুবরণ করেছেন ৮০ লাখ লোক। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ধূমপানের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন- জনসচেতনতা বৃদ্ধি, সিগারেটের ওপর বেশি কর আরোপ, সিগারেটের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা, জনসমাগম স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ করা, ধূমপান বন্ধে সহায়তা প্রদান ইত্যাদি। এসব ব্যবস্থা নেয়ার ফলে তারা সুফল পেতে শুরু করেছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ধূমপান ছিল ১৯৬৫ সালে প্রায় ৬৮ শতাংশ যা ২০২০ সালে ১২ দশমিক ৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাতে ধূমপানজনিত রোগ অনেক কমে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বোচ্চ তামাক ব্যবহারকারী দেশের অন্যতম। এখানে প্রায় পাঁচ-ছয় কোটি লোক ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক (জর্দা, গুল, সাদা পাতা ইত্যাদি) ব্যবহার করে, যা জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৮ সালে তামাক ব্যবহারের কারণে এক লাখ ২৬ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটেছে। একই বছর ১৫ লাখ লোক তামাক ব্যবহারজনিত রোগে ভুগছিলেন। প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের সংস্পর্শে আসায় আক্রান্ত হয়। তামাক ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ছিল আট হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যার ৭৬ শতাংশ পরিবার বহন করেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল প্রায় ৩০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, যা তামাকজনিত আয়ের চেয়ে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। কাজেই এটি আমাদের জন্য মোটেই কোনো অর্থকরী ফসল নয়। তামাক উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। উৎপাদিত তামাকের ১-৩ ভাগ বিদেশে রফতানি করা হয়।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আমাদের দেশে সীমিত আকারে তামাক চাষ শুরু হয়। ২০০৮ সালের পর তা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন প্রায় এক লাখ ১৩ হাজার ২৯৭ একর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। তামাক চাষ একটি কোম্পানিনির্ভর ফসল। বহুজাতিক তামাক কোম্পানি উন্নত বিশ্বে বেশি সুবিধা করতে না পারলেও দরিদ্র দেশগুলোতে বর্তমানে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করছে। যেমন- বাংলাদেশে ২০১৮ সালে এক জাপানি কোম্পানি আকিজ গ্রুপের সিগারেট ফ্যাক্টরি খরিদ করে নতুনভাবে ব্যবসায় শুরু করেছে। তামাক চাষে কৃষককে প্রণোদনা দেয়া আর সরকারি প্রশাসনযন্ত্রে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে দেশে ধূমপানের বড় বাজার তৈরি হয়েছে। নেপাল ও মালদ্বীপের মতো দেশে সিগারেটের প্যাকেটের উপরের অংশে ৯০ শতাংশ জায়গাজুড়ে ধূমপানের বিরুদ্ধে বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। আমাদের দেশে সিগারেটের প্যাকেটের নিচের অংশে ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে ওই বিজ্ঞপ্তি থাকে।

আমাদের জাতীয় বাজেটে সিগারেটের মতো পণ্যে কর আরোপের ব্যাপারেও নমনীয়তা পরিলক্ষিত হয়। অথচ এ ব্যাপারে বেশি কর আরোপ হচ্ছে ধূমপান নিবারণের অন্যতম প্রমাণিত একটি উপায়। গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেটের দাম ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করলে ৫ শতাংশ ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দেয়।

তামাক রবি ফসলের সময় উৎপাদিত হয়। ওই সময় নানারকম সবজি, ডাল, তৈলবীজ, ধান এসব ফসল না করে জমিতে ক্ষতিকর একটি ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। তামাক চাষে জমির উর্বরতাশক্তি দ্রুত হ্রাস পায়। ফলে নতুন নতুন জমি তামাক চাষে ব্যবহার করতে হয় (রংপুর, পাবনার পর এখন বান্দরবানেও তামাক চাষ শুরু হয়েছে)। তামাক চাষে বেশি কীটনাশক, এমনকি নিষিদ্ধ কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। তাতে মাছ ও অন্যান্য জলজপ্রাণীর ক্ষতি হয়। তামাক পাতা সিদ্ধ করতে প্রচুর জ্বালানির প্রয়োজন হয়, যা পূরণ করতে গিয়ে আমাদের বনজসম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ধূমপানজনিত আর্থিক ক্ষতি পৃথিবীতে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। তামাক চাষে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। অনেক তামাকচাষি এ মৌসুমে সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে তামাক চাষে ব্যবহার করছে। এভাবে তামাক চাষ আমাদের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, পরিবেশ ও সীমিত ফসলের জমির জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দয়েছে।

কোনো কোনো মুসলমান আছেন যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন আবার ধূমপানও করেন। একসময় ধূমপানের এ ক্ষতিকর বিষয়গুলো মানুষের জানা ছিল না। ফলে অনেক আলেম ধূমপানকে মাকরুহ মনে করতেন। তামাকের এত ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে মক্কা-মদিনা, আল-আজহারসহ পৃথিবীর চার শতাধিক ফতোয়া হচ্ছে যে, ধূমপান হারাম। এ ব্যাপারে কুরআনের দিকনির্দেশনা হচ্ছে- ‘তোমরা নিজ হাতে নিজেদের ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।’ (আল-কুরআন-২ : ১৯৫)। ‘আর তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করো না।’ (আল-কুরআন-৪ : ২৯)।

প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ইউসুফ আল কারজাভি বলেছেন, বিখ্যাত আলেমদের মধ্যে এ ব্যাপারে মতভেদ নেই যে, ধূমপান হারাম, চার মাজহাবের ফতোয়া ও এই যে- ধূমপান নিষিদ্ধ।

ধূমপান শারীরিক, আর্থিক ও নৈতিক সব দিক থেকে অত্যন্ত ক্ষতিকর বস্তু। এ থেকে বাঁচতে সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধূমপানবিরোধী এফসিটিসিতে প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ এবং সরকারিভাবে ২০৪০ সালের মধ্যে এ দেশকে তামাকমুক্ত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। ২০০৫ এবং ২০১৩ সালে ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনগুলোর আওতায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ায় ধূমপান কমতে শুরু করেছে। এ ব্যাপারে আরো উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যেমন- তামাক চাষের জমি নিয়ন্ত্রণ আইন, তামাক বিক্রির জন্য লাইসেন্স প্রবর্তন, খুচরা সিগারেট-বিড়ি বিক্রয় বন্ধ করা (তাতে সতর্কবাণীর উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়) স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক অন্তর্ভুক্ত করা। সারা দেশের মসজিদের ইমামদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বাজার, সিনেমা হল, জনসমাগম স্থানে পোস্টারের মাধ্যমে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক প্রচার করা। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও, সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান অনুরূপ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। এভাবে আমরা যদি এ দেশকে সত্যিকারভাবে তামাকমুক্ত করতে পারি; তাহলে বছরে আর্থিক সাশ্রয় হবে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। তবে প্রতি বছর এক লাখ ২৬ হাজার মানুষের সিগারেটজনিত মৃত্যু যদি আমরা প্রতিরোধ করতে পারি আর বেশ কিছু কষ্টদায়ক রোগ থেকে যদি মানুষকে মুক্তি দিতে পারি- তাহলে তা হবে আমাদের জন্য অধিক পাওয়া।

লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com