১. ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারিতে ১১ মিনিটের সংসদ অধিবেশনে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তখনকার প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলমন্ত্র ছিল ব্যালটের মর্যাদা, গণতন্ত্রের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লড়াই। সংবিধানে মূল চার স্তম্ভের মধ্যে ছিল অন্যতম গণতন্ত্র। মূল স্তম্ভ গণতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটাতে সংসদের হাতে কোনো ক্ষমতা ছিল না। দেশের মৌলিক চার স্তম্ভের একটি বিলুপ্ত করতে গেলে গণভোটের আবশ্যকতা ছিল। একদলীয় শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে সংসদীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটে যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা। ঘটে ক্ষমতার পালাবদল, তাৎক্ষণিক বাকশালের বিলুপ্তি, রক্ষী বাহিনীর বিলুপ্তিসহ আরো কিছু পরিবর্তন। প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা গ্রহণের ৯ দিন পর্যন্ত সেনাপ্রধান ছিলেন পূর্বেকার সেনাপ্রধান এসএম সফি উল্লাহ। প্রেসিডেন্টের ডিফেন্স অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়োগ পান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সেনাপ্রধান কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী; বাকশাল সরকারের ২১ জনের মন্ত্রিসভা এবং সংসদ বহাল থাকে। মোশতাক সরকার ৯ দিন পর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন।
২. খন্দকার মোশতাকের শাসনামলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ (বীর উত্তম) সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের অভিযোগে তার অনুসারীদের নিয়ে ২ নভেম্বর রাতে পাল্টা সেনা অভ্যুত্থানের প্রারম্ভিক পর্যায়েই সেনাপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে ফেলেন। দৃশ্যত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সেনা অভ্যুত্থান সফল হলেও তখনো বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের অবস্থানের অবসান ঘটাতে পারেননি। বঙ্গভবনে কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদের ট্যাংক আর্টিলারি বাহিনীর সুদৃঢ় অবস্থান ছিল। বঙ্গভবন দখল করে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করলে সঙ্ঘাতের সম্ভাবনা দেখা দেয়, যার দরুন রক্তপাত ঘটা অনিবার্য হয়ে ওঠে। ক্যান্টনমেন্টে ক্ষমতা দখলকারী খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে অবস্থানরত কর্নেল রশিদের মাধ্যমে সঙ্ঘাত এড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার রদবদলের দীর্ঘ আলোচনার পর চার দফা চুক্তিভিত্তিক, বঙ্গভবনে ১৫ আগস্টের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার পথ সুগম করে দেন। চার দফার মধ্যে ছিল খন্দকার মোশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল থাকার সম্মতি। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করার অভিযোগে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তিনি নিজেই পদোন্নতি নিলেন; সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে ফেলেন।
৩. প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক অবস্থার হেন সঙ্কটসঙ্কুল পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মো: সায়েমকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুরোধ করলে ৫ নভেম্বর তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। উল্লেখ্য, খালেদ মোশাররফ প্রধান বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেননি, বরং খালেদ মোশাররফ চেয়েছিলেন খন্দকার মোশতাকই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করুন।
৪. সেনাপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের গৃহবন্দী এবং খালেদ মোশাররফ সেনাপতি হিসাবে ঘোষণা আসার পর জিয়াউর রহমানের সেনাপতির পদের অবসান ঘটে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সেনাবাহিনীতে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তার গৃহবন্দীর দুর্দশা থেকে উদ্ধারে ঢাকা সেনানিবাস থেকে তার পক্ষে কোনো প্রকার সহায়তা আসেনি কর্নেল আবু তাহের ৬ নভেম্বর রাত ১২.১ মিনিট অর্থাৎ ৭ নভেম্বরের ঊষালগ্নে ঢাকা সেনা ছাউনিতে সিপাহি গণবাহিনীর অভ্যুত্থান না ঘটানো পর্যন্ত।
৫. কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম সেনাবাহিনীতে থাকাবস্থায় তিনি জাসদ রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন এবং বাংলাদেশে গোপনে সেনা ছাউনিতে গণবাহিনী গঠন করেন। পরে তিনি গণবাহিনীকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে প্রয়াসী হন।
৬. ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দৃশ্যত ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত সেনা অফিসারদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে খালেদ মোশাররফ প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিলেও যেকোনো সময় তিনি দেশের সর্বময় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে যেতে পারবেনÑ এই ধরনের কৌশল তার ছিল। ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের সরকার পতন আওয়ামী লীগের জন্য একটা বিরাট সুযোগ এনে দেয়। আওয়ামী লীগকে নিয়ে সরকার গঠন করলেও প্রধান সেনাপতি খালেদ মোশাররফ থাকবেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, রাজনীতির হেন প্রেক্ষাপটে মৃত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই জাতির সামনে আরো একজন মহান ব্যক্তি হিসাবে আসতেন এবং খালেদ মোশাররফ সেই পথেই হাঁটতেন। খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখলের পরপর তার মা, ভাইসহ আওয়ামী লীগপন্থীদের ঢাকা রাজধানীতে বিরাট মিছিলের স্বরূপ তারই সাক্ষ্য বহন করে।
৭. নতুন সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী সেনা কর্মকর্তা এবং সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে তাদের হটানো অভ্যুত্থানের সফলতা হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের অবস্থান, ৩ নভেম্বর গভীর রাতে জেলখানায় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি কারণে দেশে দৃশ্যমান কোনো সরকার নেই, তা স্পষ্টত পরিলক্ষিত হয়। তারই প্রেক্ষাপটে সেনাপতি খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে ৬ নভেম্বর রাত ১২.১ মিনিটে ঢাকা সেনা ছাউনিতে কর্নেল তাহেরের লিফলেট বিতরণ এবং সিপাহিদের সমন্বয়ে গণবাহিনীর পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।
৮. তাদের স্লোগান ছিল ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই, জেসিওদের ওপর অফিসার নাই।’ কর্নেল তাহের ও জাসদের পরিকল্পনা ছিল সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশে চীন রাশিয়ার মত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। ৭ নভেম্বর রাতভর কর্নেল আবু তাহের, ঢাকা রাজধানীর দায়িত্বে জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু, কর্নেল আবু তাহেরের ভাই ডা: আনোয়ার হোসেন প্রমুখ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। সেদিন রাতেই প্রায় ২৩ জন সেনাকর্তা অনেকের পরিবারসহ সিপাহি গণবাহিনী বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। সেনাপতি জিয়াউর রহমান ২ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে গৃহবন্দী দশা, পরাজিত স্বঘোষিত সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফের পলায়ন, অফিসাররা নিজ নিজ প্রাণ বাঁচানোর অবস্থানে থাকায় ঢাকা সেনা ছাউনিতে কর্নেল তাহেরের সিপাহি গণবাহিনীর বিপ্লবী স্লোগান এবং তাদের লিফলেট সেনা ছাউনির সর্বত্র বিদ্যমান ছিল, বিরোধী পাল্টা সেনা কর্মকাণ্ডের কোনো অবস্থান ছিল না। ৭ নভেম্বর রাত ভোর হওয়া সময়ে কর্নেল তাহেরের জাসদ সমর্থিত বিপ্লব দৃশ্যমান সফলতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত।
খালেদ মোশাররফ তার অনুসারী কর্নেল হায়দার এবং মেজর হুদাকে নিয়ে ৭ নভেম্বরে কর্নেল তাহেরের অভ্যুথানের দাপটে প্রাণ রক্ষার জন্য ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেসে আশ্রয় নিয়ে ৭ নভেম্বর রাতটা অন্তত পক্ষে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। কর্নেল তাহেরের পরিকল্পিত সিপাহি গণবাহিনীর অভ্যুত্থান ছিল তখনকার পর্যায়ের পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা গ্রহণকারী সেনাপতি খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে। কর্নেল আবু তাহেরের সিপাহি গণবাহিনী স্বাভাবিকভাবেই খালেদ মোশাররফদের অনুসারীদের বাধার সম্মুখীন হওয়ার কথা। কিন্তু খালেদ মোশাররফ অনুসারী কর্নেল জাফর ইমামসহ সবাই নিজ নিজ জীবন রক্ষার্থে পালিয়ে যান। তখনকার পর্যায়ে কর্নেল তাহেরের অনুসারীদের স্বাভাবিক দায়িত্ব ছিল সেনাপতি খালেদ মোশাররফকে সেনা ছাউনির যেখানেই থাকুক, তাকে পরাভূত করা।
তারই ধারাবাহিকতায় সকালে তিনি সিপাহি গণবাহিনীর হাতে তার সহচর কর্নেল হায়দার ও মেজর হুদাসহ নিহত হন। খালেদ মোশাররফ গং নিহত হওয়ার পর্যায় পর্যন্ত কর্নেল তাহেরের বিপ্লব সফল। ঢাকা সেনা ছাউনিতে সিপাহি গণবাহিনীকে প্রতিপক্ষের দ্বারা ৭ নভেম্বর ভোরবেলা পর্যন্ত কোনো প্রকার বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি।
৯. কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সিপাহি গণবাহিনী ৭ নভেম্বর অতি প্রত্যুষে কর্নেল তাহেরের নির্দেশে জিয়াউর রহমানের বাসভবনে যাওয়ার পর দেখতে পায়, বন্দী সেনাপতি ইতোমধ্যে অষ্টম বেঙ্গলের ব্রিগেডিয়ার আমিন জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করে তার অফিসে নিয়ে এলেন। এখানেই ঘটে যায় কর্নেল তাহেরের বিপ্লবের বিপর্যয়। উল্লেখ্য, কর্নেল তাহেরের সিপাহি গণবাহিনীর বিপ্লবের সফলতার পর্যায়ে গভীর রাতেই গৃহবন্দী সেনাপতি জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের সফলতা আঁচ করতে পেরে তিনি কর্নেল তাহেরকে ফোনে বলেন মাইডিয়ার কর্নেল তাহের ইউ সেইভ মাই লাইফ’। সেনাপতি জিয়াউর রহমান অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, কট্টর বামপন্থী কর্নেল তাহের তাকে জীবিত রাখবেন না। কর্নেল তাহেরের সিপাহি গণবাহিনী জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী দশা হতে মুক্ত করার নামে তাকে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসেন এ খবর কর্নেল তাহের জানতে পেরে কাল বিলম্ব না করে ব্রিগেডিয়ার আমিনের অফিসে গিয়ে সেখান থেকে রেডিওতে ভাষণ দেয়ার নাম করে জিয়াকে নিয়ে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। জিয়ার দূরদর্শিতার দরুন কর্নেল তাহেরের হাতে নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পেয়ে যান। সেনাপতি জিয়া ব্রিগেডিয়ার আমিনের মাধ্যমে মুক্ত হওয়ার পর জিয়ার অনুযায়ী অফিসার এবং সিপাহিদের এক অংশ জিয়াকে রাজপথে বিজয়ী বেশে নিয়ে আসেন। তার অনুসারীরা স্বঘোষিত সেনাপতি খালেদ মোশাররফের অবস্থানের কোনো সন্ধানই রাখেননি। তখনকার পর্যায়ে খালেদ মোশাররফ কোনো ফ্যাক্টর ছিলেন না জিয়া অনুসারীদের সামনে। খালেদ মোশাররফ চেয়েছিলেন ১৫ আগস্টের সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট এক সেনা অভ্যুত্থান। দেশের জনগণ ছিল কমিউনিজম এবং ভারতবিরোধী। দুই যুগল মিশ্রণে মুক্ত সেনাপতি জিয়াউর রহমানকে পেয়ে কর্নেল ফারুকের ট্যাংক বাহিনী এবং কর্নেল রশিদের আর্টিলারি বাহিনী যারা বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের প্রহরারত ছিলেন তারা ঢাকার রাজপথে নেমে আসেন। ধর্মপ্রিয় বীর বাঙালি ছিল জয় উল্লাসে। ট্যাংক বহরে ছিল জিয়াউর রহমানের ছবি। রাজধানীর রাজপথে লক্ষ জনতার মিছিল; নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর গগনবিদারী স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত নেতৃত্বের পুরো ভাগে সেনাপতি জিয়াউর রহমান।
১০. ৭ নভেম্বর বিপ্লবের ফসল কর্নেল তাহের ঘরে তুলে নিতে পারেননি। কিন্তু তিনি আরেক নতুন চাল সংযোজনের মাধ্যমে ব্যর্থতাকে জয় করার ইস্পাত দৃঢ় মনোবলে এগিয়ে যান জাতীয় সরকার গঠন করে সরকারপ্রধান জিয়াউর রহমানের নামে পরের দিন ৮ নভেম্বর শহীদ মিনারে বিরাট জনসভার প্রচারে নামে। সেদিন সাদা জিপ থেকে কর্নেল তাহেরের ঘনিষ্ঠ আ ফ ম মাহবুবুল হককে গুলি করলে সভা পণ্ড হয়ে কর্নেল তাহেরের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। মার্কসবাদী বিপ্লবের যবনিকাপাত ঘটে।
১১. সিপাহি জনতার বিপ্লবের পর খন্দকার মোশতাক পুনরায় প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ফিরে পাবার পথ সুগম হয়ে যায়। কর্নেল আবু তাহের দৃশ্যমান পরাজয়ের মাধ্যমে ও খন্দকার মোশতাক যাতে করে পুনঃপ্রেসিডেন্ট দায়িত্ব পেতে না পারে সে জন্য প্রচণ্ড বাধা সৃষ্টি করেন। খন্দকার মোশতাককে মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, বিমানবাহিনী প্রধান, নৌবাহিনী, পুলিশ বাহিনীসহ তার মন্ত্রীবর্গের অনেকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণের জোরালো পদক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও রাজনীতির এই কণ্টকাকীর্ণ অবস্থায় তিনি প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণে রাজি হননি। তার বক্তব্য ছিল, আমি নিজ হাতে ৫ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মো: সায়েমকে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিয়েছি। আমি সেই পদ পুনরায় গ্রহণ করব না। আমি জাতির উদ্দেশে বিদায় ভাষণ দিয়ে চলে যাবো।’ বিদায় ভাষণেও ছিল কর্নেল তাহেরের প্রচণ্ড বাধা। কিন্তু মোশতাক তো দমবার পাত্র নন, তিনি গর্জন করতে থাকলেন, তিনি বিদায় ভাষণ না দিয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করবেন না। কর্নেল তাহের অবস্থার হেন প্রেক্ষাপটে রণভঙ্গ দিতে বাধ্য হন। প্রেসিডেন্ট মোশতাক ৭ নভেম্বরের জাতির উদ্দেশে বিদায় ভাষণে পুনঃ ব্যক্ত করেন ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় সংসদের নির্বাচনের দিনক্ষণ অক্ষুণ্ন থাকবে।’ পরদিন ৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মো: সায়েম এক ভাষণের মাধ্যমে খন্দকার মোশতাকের দেয়া উল্লিখিত তারিখেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন তারিখ পুনরায় ব্যক্ত করেন।
১২. ২৪ আগস্ট ’৭৫ ডেপুটি চিফ অব স্টাফের পদ থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমান খন্দকার মোশতাক কর্তৃক সেনাপ্রধান নিয়োগ পান। ১৫ আগস্টের ঘটনায় ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান কোনোভাবে জড়িত থাকলে সেদিনই ১৫ আগস্ট মুহূর্তেকাল বিলম্ব না করে সেনাপতির দায়িত্ব নিয়ে নিতেন। ৯ দিন পর সেনাপ্রধান নিয়োগ পাওয়া বলিষ্ঠভাবে প্রমাণ করে, ১৫ আগস্ট ঘটনার ব্যাপারে জিয়ার কোনো প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ভূমিকাই ছিল না। এটি ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের নীরব সাক্ষী।
প্রধান বিচারপতি সায়েম সাহেব বিদায়ী প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদের দেয়া ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের দিনক্ষণ পুনঃব্যক্ত করায় এবং পরে জনাব সায়েম ওই সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণের ব্যাপারে আপসহীন প্রধান সেনাপতি জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট সায়েম থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে প্রেসিডেন্ট জিয়ার পক্ষে রাজনীতির দৃশ্যপটে আসা সম্ভব হতো না। সেনাপতি জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট সায়েমকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখলের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল খন্দকার মোশতাকের ঘোষিত সংসদ নির্বাচনের তারিখ বানচালের পদক্ষেপ, যার দরুন জিয়াউর রহমান ডিএল প্রধান খন্দকার মোশতাককে গ্রেফতার এবং তার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতির মামলা দিয়ে প্রায় চার বছর জেলহাজতে রেখে দেন। খন্দকার মোশতাককে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিয়ে জিয়াউর রহমান প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছেন।
লেখক : কলামিস্ট এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারের
সিনিয়র আইনজীবী