মালয়েশিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহীম ১৯৪৭ সালে মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় পেনাং রাজ্যের চিরোক তক্কুন গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ইব্রাহীম আব্দুল রহমান ছিলেন একটি হাসপাতালের কর্মচারী এবং পরবর্তীকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তার মা চে ইয়েন হুসেন একজন সাধারণ গৃহিণী ছিলেন।
আনোয়ার ইব্রাহীমের শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ গ্রামের স্কুলে। পরে মালয় কলেজ কুয়ালা কানজার থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। ইউনিভার্সিটি অব মালয় থেকে মালয় স্টাডিজে অনার্স এবং ১৯৭৪-৭৫ সালে জেলে থাকা অবস্থায় মাস্টার্স সমাপ্ত করেন। আনোয়ার ইব্রাহীম ছাত্রজীবনে ১৯৬৮-১৯৭১ সাল পর্যন্ত ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মালয়েশিয়ান মুসলিম স্টুডেন্টসের সভাপতি ছিলেন। একই সময়ে তিনি ইউনিভার্সিটি অব মালয়া মালয় ল্যাংগুয়েজ সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুসলিম ইয়থ মুভমেন্ট অব মালয়েশিয়া সংগঠিত হলে এর সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা ও প্রো-কমিটির সদস্য ছিলেন এবং একই বছর তিনি মালয়েশিয়ান ইয়থ কাউন্সিলের দ্বিতীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। আনোয়ার ইব্রাহীম একজন ইসলামপন্থী নেতা হওয়ার পরেও ১৯৮২ সালে প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের উদারপন্থী দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অরগানাইজেশনে যোগ দেন এবং সংস্কৃতিমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ১৯৮৩ সালে যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী, ১৯৮৪ সালে কৃষিমন্ত্রী এবং ১৯৮৬ সালে শিক্ষামন্ত্রী হন। শিক্ষামন্ত্রীর পদ তার জন্য মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ উপ-প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দ্বার খুলে দেয়।
শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর আনোয়ার ‘ন্যাশনাল স্কুল কারিকুলাম’ প্রণয়ন করেন। মালয়েশিয়ার জাতীয় ভাষার নাম ‘বাহাসা মালয়েশিয়া’ থেকে বাহাসা মেলায়ুতে পরিবর্তন করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান এবং ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সে দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
সংস্কার আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিয়ে ১৯৯৯ সালে আনোয়ার ন্যাশনাল জাস্টিস পার্টি গঠন করেন এবং ওই বছরের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য parti Islam se Malaysia, ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন পার্টি ও নবগঠিত ন্যাশনাল জাস্টিস পার্টি নিয়ে ‘বারিসন অল্টারনেটিভ’ নামে বিরোধী জোট গঠন করেন। ২০০৩ সালের আগস্টে আনোয়ারের পরামর্শে তার স্ত্রী ওয়ান আজিজাহ ন্যাশনাল জাস্টিস পার্টি ও মালয়েশিয়ান পিপলস্ পার্টি একীভূত করে পিপলস্ জাস্টিস পার্টি গঠন করে। ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে PKR, PA এবং DAP মিলে পাকাতান রাকাত নামে জোট গঠন করেন, যা ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং ৩১টি আসন জয়লাভ করে আনোয়ার ইব্রাহিম বিরোধী দলে পরিণত হন।
২০০৮ সালের আগস্টে আনোয়ারের রাজনৈতিক সহযোগী সাইফুল বুখারি আজলান তার বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ দায়ের করেন। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বিচার শুরু হয়। অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে আদালতে যে ডিএনএ নমুনা দাখিল করা হয়েছিল তা ‘দূষিত’ করা হয়েছে সন্দেহে বিচারক জাবেদিন মোহাম্মদ দিয়া আনোয়ার ইব্রাহিমকে নির্দোষ ঘোষণা করেন।
আদালত কক্ষের উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে বিচারক তার রায়ে এসব কথা বলেন, ‘যেহেতু এটি একটি যৌন হয়রানিমূলক মামলা, আদালত অশুদ্ধ প্রমাণের ভিত্তিতে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে না, তাই অভিযুক্তকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো।’ ২ কোটি ৮০ লাখ অধিবাসীর মুসলিম অধ্যুষিত দেশ মালয়েশিয়ায় সমকামিতা একটি ফৌজদারি অপরাধ। অপরাধ প্রমাণিত হলে দোষী ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ২০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আনোয়ার ইব্রাহিমের রাজনৈতিক জীবনের মৃত্যু হতো নিশ্চিতভাবেই। আত্মবিশ্বাসী আনোয়ার ইব্রাহিম কখনো ভেঙে পড়েননি এবং মানসিকভাবে দুর্বল হননি। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আনোয়ার মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির বিন মোহাম্মদের প্রধান রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন।
উপ-প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই ১৯৯৮ সালে আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে প্রথম সমকামিতার অভিযোগ দায়ের করা হয়। সমকামিতা ও আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে মাহাথিরের মন্ত্রিসভা থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়। ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে ১৯৯৯ সালে তার ৬ বছরের কারাদণ্ড হয়। ২০০০ সালে সমকামিতার অভিযোগে পৃথকভাবে আরো ৯ বছরের কারদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। ২০০৪ সালে উচ্চ আদালত তার দণ্ড মওকুফ করে তাকে খালাস দেয়। দ্রুতই তিনি বিরোধীদলীয় প্রধান নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২০০৮ সালের মার্চে পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয় না পেলেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য পান।
আনোয়ার ইব্রাহিম প্রথম থেকেই তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন। তিনি এ বিষয়ে মালয়েশিয়ার সরকারকে অভিযুক্ত করে বলেছেন, তার রাজনৈতিক জীবন ধ্বংস করার জন্যই সরকারি দল এই হীন চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। রায়ের পর মালয়েশিয়া সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘মালয়েশিয়ার বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন এবং এ মামলার রায়ই প্রমাণ করে সরকার বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে না।’
অবশেষে চলতি বছরের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে জোট সরকারের প্রধান হিসাবে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন। নিজের লক্ষ্য স্থির রেখে নিষ্ঠা ও দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেলে মানুষ যে কাক্সিক্ষত শীর্ষবিন্দু ছুঁতে পারে আনোয়ারের সংগ্রামমুখর রাজনৈতিক জীবন সেটাই নতুন করে প্রমাণ করলো।