ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বহুল প্রতীক্ষিত ভোট আজ। এ ভোটের দিকে তাকিয়ে আছে নগরবাসী, তাকিয়ে আছে পুরো দেশ। স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন নিয়ে জমেছে অনেক প্রশ্ন-ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণের পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনার মধ্যেই এবার প্রথমবারের মতো শতভাগ ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হচ্ছে। ইভিএম পদ্ধতি কতটা গ্রহণযোগ্য? এ প্রশ্নের উত্তর মিলবে আজকের ভোটে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের আয়োজন, সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং সবার সমান সুযোগ সৃষ্টিসহ নির্বাচনের যথাযথ পরিবেশ রক্ষার চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে মাঠে নেমেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কঠিন সেই চ্যালেঞ্জ উতরে যেতে পারবে কি প্রতিষ্ঠানটি?
সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের যে সুযোগ রয়েছে নির্বাচন কমিশনের সামনে, সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে কি? উৎসবমুখরতা সত্ত্বেও সংশয়বাদী ভোটারদের মনে প্রশ্ন, ভোট সুষ্ঠু হবে তো? যাকে খুশি তাকে ভোট দেওয়া যাবে তো? ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবমুক্ত অবাধ ভোটানুষ্ঠান হবে তো? প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়রপ্রার্থীদের প্রত্যেকেই ভোটারদের বিস্তর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কার ওপর আস্থা রাখবে ঢাকার নাগরিকরা? কে হবেন উত্তরের নগরপিতা? দক্ষিণেরই বা কে? ভোট সুষ্ঠু হবে তো? ঠিকঠাক ভোট দেওয়া যাবে তো?Ñ এমন অনেক প্রশ্ন এতদিন ধরে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে আজ।
আজকের দিনটি ঢাকা মহানগরীর নাগরিকদের। তারা আজ বিচারক। তাদের রায়ে মিলবে প্রশ্নের উত্তর। তারাই রায় দেবেন, কোন দুজনের হাতে তুলে দেবেন দক্ষিণ ও উত্তর নগরীর চাবি? কার হাতেইবা তুলে দেবেন এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব? চাবি যার হাতেই উঠুক, জনরায়ের প্রতি আস্থা রেখে তার নেতৃত্বই যেন প্রতিপক্ষসহ দলমত নির্বিশেষে প্রত্যেকে মেনে নেন-এমনই প্রত্যাশা দেশবাসীর।
নিকট অতীতে আর কোনো নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের মনে এতটা আগ্রহ দেখা যায়নি। জাতীয় রাজনীতির শীর্ষনেতৃত্ব ইতোমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছেন। আগামীর রাজনীতির গতি-প্রকৃতিতেও প্রভাব ফেলবে এ নির্বাচন। প্রতীকসহ প্রচার শুরুর পর বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে মোটামুটি সন্তুষ্ট সবাই। অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগে নির্বাচনের মাঠ উত্তপ্ত থাকলেও বড় কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেনি। উৎসবমুখর পরিবেশেই শেষ হয়েছে প্রচার। ভোটগ্রহণেও এ আমেজ অব্যাহত থাকবে-এ প্রত্যাশার সঙ্গে নগরবাসীকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান উপহার দিতে চায় ইসি।
গতকাল বিকালে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ভোটপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা বলেন, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি শেষ। কেন্দ্রে কেন্দ্রে নির্বাচনের সামগ্রী পৌঁছে গেছে। প্রিসাইডিং অফিসারসহ সবাই যার যার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কাজ করছে। আমরা নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ পর্যালোচনা করেছি। বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি। টেলিফোনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। কোথাও কোনো সমস্যা নেই। নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কার কিছু নেই। ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন-এটা প্রতিষ্ঠা করতে সবার সহযোগিতা চাই।
সিইসি বলেন, ভোটাররা অবাধ ও নির্বিঘ্নে ভোটে অংশ নেবেন। ভোট দিতে চলে আসবেন। তাদের কোনো অসুবিধা নেই। সব দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। নির্বাচন প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হলে পরিবেশ উন্নত হয়। এ নির্বাচনে সেই পরিবেশ বিরাজমান।
রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মতে, ২০১৪ ও ২০১৯ সালে জাতীয় নির্বাচনসহ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সঙ্গে এ নির্বাচনের পার্থক্য লক্ষ করার মতো। আগের নির্বাচনগুলোতে মাঠে দাঁড়াতেই পারেননি বিএনপির নেতাকর্মীরা হামলা-মামলা ও গ্রেপ্তারের কারণে। এ নির্বাচনে এ পর্যন্ত সে রকম দেখা যায়নি। রাজনৈতিক হয়রানি কম ছিল। অবাধে প্রচার চালাতে পেরেছেন সবাই।
ইভিএমে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ হতে পারে, যা ভোটের ফল বদলে দেবে বলে শঙ্কা বিএনপির। তাই প্রথম থেকে ছাপা ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণের দাবি করে আসছিল দলটি। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে কয়েক দফা অভিযোগ করা হয়েছে।
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আলোচনায়ও স্থান পাচ্ছে এক প্রশ্ন-আজকের ভোটের পর রাজনীতির মাঠ কেমন হবে? বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের গতি-প্রকৃতিও নির্ভর করবে এ নির্বাচনের ওপর।
গতকাল সকাল থেকে পুলিশি নিরাপত্তা দিয়ে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ইভিএম পাঠানো শুরু হয়। কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে দুই সিটি করপোরেশনের ২,৪৬৮ ভোটকেন্দ্রের ১৪,৪৩৪টি ভোটকক্ষে সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে। ভোটের মধ্য দিয়ে দুই সিটির নগরপিতা ও কাউন্সিলর নির্বাচন করবেন নগরবাসী। সরকার ও নির্বাচন কমিশন বলছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে। আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতা ও প্রার্থীরা সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
বিএনপির একাধিক সূত্রের খবর-গত সিটি নির্বাচনে বিএনপি ভোটগ্রহণের কয়েক ঘণ্টা পর তা বর্জন করলেও এবার সে পথে হাঁটবে না। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকবে। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এমন পরিস্থিতিতেও মানুষ ভোট দিতে পারলে তাদের দুই মেয়রপ্রার্থীই জয়ী হবেন। তাই ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে সচেষ্ট দলটির নেতারা। অবশ্য আওয়ামী লীগও বলছে, তাদের বিজয় সুনিশ্চিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তার করা জরিপের ওপর ভিত্তি করে গত বৃহস্পতিবার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন, যেখানে তিনি জানান-ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুটিতেই মেয়র পদে জয়ী হবেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
এর আগে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল দুই সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর কারণে ৯ মাস আগে উপনির্বাচন হয়। এতে বিজয়ী হন আতিকুল ইসলাম। এবারও তিনি আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী। দক্ষিণে নানা সমালোচনার কারণে মেয়র সাঈদ খোকনের বদলে শেখ মনির ছেলে শেখ ফজলে নূর তাপসকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি উত্তরে গতবারের প্রার্থী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়ালের ওপরই এবারও ভরসা রেখেছে। দক্ষিণে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির প্রয়াত নেতা অবিভক্ত ঢাকা সিটির মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন।
২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকাকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগের পর এটাই দ্বিতীয় নির্বাচন। এর আগে একক সিটি করপোরেশন হিসেবে ঢাকা সিটিতে নির্বাচন হয়েছিল ২০০২ সালে।
আজ ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে যাবেন কি? স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, আসলে কত সংখ্যক লোক ভোট দিতে যাবেন বা যেতে পারবেন, সেটা একটা বিষয়। মানুষের মধ্যে ভোট দেওয়ার আগ্রহ কতটুকু তার ওপর নির্ভর করছে নির্বাচনের ফল।
আজকের ভোট নিয়ে দেশের বড় দুই দলের মধ্যে শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত চলেছে পরস্পরের প্রতি বাক্যবাণ। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, বিএনপি যতই ষড়যন্ত্র করুক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে আছে। আগামীকালের (আজ) নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর হবে। নির্ভয়ে জনগণ ভোট দিতে পারবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমার বিশ্বাস ঢাকা শহরের মানুষ যদি ভোট দেওয়ার ন্যূনতম সুযোগ পান তা হলে তারা অবশ্যই তাবিথ ও ইশরাককে জয়ী করবেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনে ওয়ার্ড সংখ্যা ছিল ৩৬টি। ভোটার সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ৪৫ হাজার ৩৭৪। এবার নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডসহ মোট ৫৪ ওয়ার্ডে ভোটার সংখ্যা ৩০ লাখ ১০ হাজার ২৭৩।
ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৭৫৩। ওয়ার্ড ছিল ৫৭ টি। নতুন যুক্ত ওয়ার্ডসহ মোট ৭৫ ওয়ার্ড এখন দক্ষিণে। ভোটার সংখ্যা ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ৯৮।
আজকের নির্বাচনে দুই সিটিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৪৭ হাজার ৯৮৬ সদস্য মোতায়েন থাকবে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ৫১ হাজার ৫০ জন। ১৭২ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ৬৪ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-কর্মকর্তা নির্বাচনী মাঠে থাকবেন। বিদেশি ৭৪ জনসহ মোট দেড় হাজার পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন।
নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ইভিএম ‘সঠিকভাবে কাজ’ করলে কারচুপি কম হওয়ার কথা। সিটি নির্বাচন উপলক্ষে রাজধানীজুড়ে নেওয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। ভোটের আগের রাতে কোথাও যেন কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা না ঘটে, সে জন্য পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নজরদারি করেন।