শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১২ অপরাহ্ন

রাত শেষেই নতুন সূর্যের দিন

জাকির আবু জাফর
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২২
  • ১২৭ বার

জাতীয় জীবনে কখনো কখনো নেমে আসে অন্ধকার। কখনো অন্ধকার প্রকট হয়ে ওঠে। ছেয়ে ফেলে জীবনের চতুর্দিক। আলোর চিক থাকে না কোথাও। শুধুই অন্ধকারের ভয়াবহতা। যেহেতু অন্ধকার গাঢ় হলে ভোরের আগমনই নিকট হয়ে ওঠে। ভয় কি তবে অন্ধকারে! শুধু পথ চলার আলো জ্বালাতে হয়। কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হয় প্রদীপ হাতে। জীবন জাগিয়ে রাখার হিম্মত দৃঢ় করতে হয়। হতাশার বালিয়াড়ি ভেঙেচুরে ছুটতে হয় লক্ষ্যের দিকে। অসম্ভবের চূড়ায় ওড়াতে হয় সম্ভাবনার নিশান। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মোকাবেলা করতে হয় সব অসুন্দরের। দেখো, জীবন আছে তো সমস্যাও আছে। সমস্যা আছে বলেই সমাধান খোঁজে মানুষ। সমস্যার সমাধান হলেই শুরু হয় নতুন জীবন। শুরু হয় নতুন পথে যাত্রা। এভাবে চলতে চলতে গন্তব্য নিকট হয়ে ওঠে। ঘনিয়ে আসে বিজয়ের মুহূর্ত।

প্রতিটি সমস্যা ছাড়িয়ে ওঠার মানেই হলো একেকটি বিজয়। সেটি হোক ব্যক্তির। হোক সামাজিক। হোক জাতীয় ও রাষ্ট্রীয়। জীবনের সব কোণে আলো ফেলার আয়োজন বিজয়কে এগিয়ে আনে। এসো এবার ফলাই আলোর ফসল। এবার উড়াই আলোর পতাকা।

এবার তুলতে হবে আলোর ঢেউ। অনেক রকমের অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক অন্ধকার। সামাজিক অন্ধকার। অর্থনৈতিক অন্ধকার। সাংস্কৃতিক অন্ধকার। জাতীয় জীবনের অন্ধকার এবং জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কখনও কখনও এ সব অন্ধকার একসাথে বিস্তারিত হয়। চেপে বসে জাতির ঘাড়ে। কখন একসাথে নামে এসব অন্ধকার?

যখন ভয়াবহ হয় রাজনীতির অঙ্গন। যখন রাজনীতিতে কোনো নীতি কাজ করে না। যখন রাজনীতি হয়ে ওঠে নৈরাজ্যের নীতি। রাজনীতির এমন পরিস্থিতি কারো জন্য শুভেচ্ছা নিয়ে আসে না।

রাজনৈতিক অন্ধকার একটি জাতিকে দিশেহারা করে তোলে। একটি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। জাতিকে পরাধীন করে তোলে। রাজনৈতিক অন্ধকারে পতিত জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে না। ঐতিহ্য থাকে না। স্বকীয়তা থাকে না। থাকে না সামাজিক মূল্যবোধ। ধর্মীয় স্বাধীনতাও খর্ব হয়ে যায়। ধ্বংস হয়ে যায় শিক্ষাব্যবস্থা। ভেঙে যায় পারিবারিক মূল্যবোধ। বেড়ে ওঠে পারস্পরিক হিংসা, বিদ্বেষ, জিঘাংসা! সন্দেহের আবর্তে পাক খায় গোটা জাতি। তরুণ সমাজ ভোগে সংশয়ে। নেশায় জড়িয়ে পড়ে তারুণ্য। পারস্পরিক গিবত-সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ে মহামারীর মতো। বিতর্কের ঊর্ধ্বে একটি মুখও অবশিষ্ট থাকে না। আইকন থাকে না কেউ। অনুসরণ-অনুকরণের মুখ হারিয়ে যায়। সবার ঘাড় থাকে সমালোচনার ছোরার নিচে। মানুষের সব পরিচয় রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। কোনো আসলের কদর থাকে না। নকলের ছড়াছড়ি সর্বত্র। নকলই আসল হয়ে ওঠে।

কোনো সমাজে অনৈতিক রাজনীতি দীর্ঘ হলে সে সমাজের কোনো কিছুই আর নৈতিকতায় থাকে না। কিছুই থাকে না নিজের জায়গায়। অযোগ্য অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিতরা চালকের আসনে চেপে বসে। হোক তা বিচারালয়, হোক মানবাধিকার, হোক মৌলিক অধিকার। কোনো অধিকারই সুস্থ থাকে না। কোনো ইনস্টিটিউট অক্ষত থাকে না। তেমন সমাজে বিচারের নামে চলে অবিচার। আইনের উর্দিতে থাকে বেআইনি উত্তাপ। অধিকার রক্ষার কথা বলে লুট হবে অধিকার। স্বাধীনতার চেতনার কথা বলে লুট হবে স্বাধীনতা। উন্নয়ন ক্রমাগত হয়ে উঠবে লুটতন্ত্রের মাধ্যম।

সব কিছুর মূল্য রাজনীতির বাটখারায় মাপা হবে। রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়া আর কোনো বিবেচনা থাকবে না। রাজনৈতিক ছোরা জাতির ঐক্যের রশিটা কেটে ফালাফালা করে তুলবে। ভাগ হয়ে যাবে পুরো জাতি। তখন জাতির ভালো কোনো গুণাবলি উজ্জ্বল হবে না। যোগ্য লোকের মূল্য থাকবে না কোথাও। জ্ঞানীদের কোথাও জায়গা হবে না। সততার চিহ্ন মুছে যাবে। দুর্নীতি প্রকাশ্য হবে। অনিয়মই নিয়ম হয়ে দাঁড়াবে।

মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তীব্র হবে। অল্প কিছু লোক সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলবে। সৃষ্টি হবে সামাজিক বৈষম্য। এমন সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থাকে না। থাকতে পারে না।

সমাজে সৎ লোকেরা ক্রমাগত দুর্বল হবে। মূর্খ লোকের অধীন হবে ক্ষমতার চেয়ার। অসৎ লোকেরা ঐক্যবদ্ধ হবে। সৎ লোকেরা নীরবে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। অসতের দাপটে হারিয়ে ফেলে প্রতিবাদের ভাষা।

এমন হলে রাজনীতির সেতু বেয়ে ক্ষমতায় চড়ে মানুষ! তখন দল তন্ত্র আর দখল তন্ত্রের উৎসব উড়তে থাকে। রাজনৈতিক শক্তিই প্রস্তুত করে ক্ষমতার মসনদ।

ব্যক্তিজীবনে ঘোরতর সমস্যায় জর্জরিত হলে নিজেকে এক ধরনের অনিশ্চিত অন্ধকারে আবিষ্কার করে মানুষ।
তখন ডানে বাঁয়ে সামনে পেছনে কেবলই সমস্যার পাহাড় দেখে। কেবলই দেখে হতাশার ঢেউ। তখন ভাবনা জাগে- বুঝি এখানেই ঠেকে যাবে জীবনের গাড়িটি।

আর যখন জাতীয় জীবনে সমস্যা আসে তখন গোটা জাতিই ডুবতে থাকে অন্ধকার পাথারে।

তখন অনিশ্চিত হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ। নেমে আসে আলোহীনতা! তখন মনে হয় চারিদিকে ভয়াল হিংস্রতা দাঁত কেলিয়ে আছে। এই বুঝি কামড় বসাবে শরীরে। এই বুঝি বিস্তার করবে কালো থাবা। প্রতিটি মুহূর্তে ভয় ডানা ঝাপটায়। হতাশা জেগে ওঠে মনে। ভাবে, এই বুঝি শেষ হয়ে গেল সব। নিভে গেল জীবনের সব কটি স্বপ্নের দীপ। চারিদিকে হতাশার রঙ। নিরাশার দহন। মনে হয় এ রাত আর শেষ হওয়ার নয়।

কিন্তু দৃঢ়তার সাথে মানুষকে দাঁড়াতে হয়। মুখোমুখি হতে হয় সমস্যার। সাহসের বারুদ জ্বালাতে হয়। জীবনের জন্য প্রয়োজনে কাছে টানতে হয় মৃত্যুকে। মৃত্যুকে ভয় না পেলেই দীর্ঘ হয়ে ওঠে জীবন। তখন সহসা কাটতে থাকে হতাশার মেঘ। ধীরে ধীরে খাটো হয় সমস্যার পাহাড়। দূরে দেখা দিতে থাকে আলোর চিক। মনে রাখতে হবেÑ আলো আছেই। আলো আসবেই।

দেখুন জীবনকে জাগিয়ে রাখার একটি আনন্দ আছে। জাগিয়ে রাখার সুখ আছে। স্বপ্ন আছে। সম্ভাবনা আছে। নতুন করে স্বপ্ন দেখার চাঞ্চল্য আছে।

সুতরাং আশা জাগিয়ে দাও জীবনের দিকে। ভবিষ্যতের গান তোলো কণ্ঠে কণ্ঠে। নতুন স্বপ্নের সুর বোনো বুকের ভেতর। বেঁধে রাখো নতুন আশার ঢেউ।

সত্যি তো এটিই- দীর্ঘ রাতের শেষেই আসে নতুন সকাল। রাত্রির অবসান হলেই আকাশ ফোটে প্রভাতের। রাত যত দীর্ঘ হয় তার অবসানের ক্ষণ ঘনাতেই থাকে। নিকট হতে থাকে প্রভাতের আয়োজন। এটিই ঘটে। ঘটতেই হবে। সূর্যের ওঠা রুখে দেয়ার হিম্মত কার আছে! কে রাখে সূর্যের মুখে লাগাম পরানোর ক্ষমতা! কে আছে সকালের আগমন ঠেকিয়ে রাখে! কে বদল করতে পারে সকালের মুখ!

মেঘ কেটে নামবেই রোদের উৎসব। মনে রাখতে হবে- খুব দীর্ঘ হয় না ঝড়ের আকাশ। ঝড় ওঠে একটি স্বচ্ছ আকাশ ফোটাতে। দুঃখের দিনও থাকে না চিরকাল।

সুখের সময় আসে। আসে স্বাভাবিক জীবনের সৌন্দর্য! আসে নিয়ম-নীতির বন্ধন। তখন আপন আনন্দে বিচরণ করে মানুষ। আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত হয় জীবনের চারিদিক।

লেখক : কবি, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, জনপ্রিয় গীতিকার ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com