‘দাওয়াহ’ ও ‘তাবলিগ’ দুটোই আরবি শব্দ। ভাবার্থের দিক দিয়ে প্রায় কাছাকাছি। উভয় শব্দের ব্যবহারই পবিত্র কুরআন ও হাদিসে পাওয়া যায়। ‘দাওয়াহ’ অর্থ ডাকা, আহ্বান, আমন্ত্রণ, নিমন্ত্রণ, প্রচার, প্ররোচিত করা, অনুপ্রাণিত করা, উৎসাহিত করা ইত্যাদি। এর সমার্থক শব্দ হলো- ওয়াজ, নসিহাত, তাবলিগ, ইরশাদ, জিকর, বাশারাত, ইনযার, হিস্সু, ইবাদাত ও দোয়া। বিশিষ্ট দাওয়াহ বিজ্ঞানী ড. আব্দুর রহমান আনওয়ারী বলেন : ‘যে আহ্বানে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি কর্তৃক গৃহীত বিজ্ঞানসম্মত ও শিল্পসঞ্জাত উপায়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা, মেনে নেয়া এবং তাদের বাস্তব জীবনে চর্চার ব্যবস্থা করে দেয়ার পদ্ধতিগত সব প্রচেষ্টা ও কার্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকে, তাই দাওয়াহ।’ এ সম্পর্কে আরেক দাওয়াহ বিজ্ঞানী ড. এ কে এম নুরুল আলম বলেন, ‘দাওয়াহ হলো- সুনির্দিষ্ট পয়গাম বা লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পূর্বপরিকল্পনা মাফিক বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সমষ্টিকে আকৃষ্ট করার নিমিত্তে আহ্বান করা বা আবেদন পেশ করা।’ তবে দাওয়াহ গবেষকরা অনেকেই ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ’ করাকে দাওয়াহ নামে অভিহিত করেছেন।
‘দাওয়াহ’ ব্যাপক অর্থবোধক একটি শব্দ। যেকোনো পথ বা মত কিংবা যেকোনো বিষয়ের প্রতি দাওয়াত হতে পারে। কিংবা যেকোনো বিষয় গ্রহণ করার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করার অর্থে হতে পারে। আবার সে বিষয়টি ভালোও হতে পারে, মন্দও হতে পারে; কিংবা কল্যাণকরও হতে পারে বা ক্ষতিকরও হতে পারে। যেমন আল কুরআনে এসেছে : ‘হে আমার সম্প্রদায়! কী হলো যে, আমি তোমাদেরকে আহ্বান করি মুক্তির দিকে, অথচ তোমরা আমাকে আহ্বান করছ জাহান্নামের দিকে।’ (সূরা আল মুমিন- ৪১) এমনিভাবে হজরত ইউসুফ আ: যে দোয়া করেন তা আল কুরআনে উল্লেখ হয়েছে-‘হে আমার প্রভু! তারা আমাকে যে উদ্দেশ্যে ডাকছে (প্ররোচিত করছে), তার চেয়ে জেলখানা আমার কাছে অধিক প্রিয়।’ (সূরা ইউসুফ- ৩৩)।
ইসলামিক স্কলারদের মতে, ইসলামের চিরকল্যাণকর ও সুমহান আদর্শের দিকে আহ্বানই দাওয়াহ। যেমন- ড. রউফ শালাবী বলেন, ‘দাওয়াহ হলো সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন, যার দ্বারা মানবসমাজকে কুফরি অবস্থা থেকে ঈমানী অবস্থায়, অন্ধকার থেকে আলোতে এবং জীবনে সঙ্কীর্ণতা থেকে পার্থিব ও পারলৌকিক জীবনের প্রশস্ত অবস্থায় রূপান্তরিত করা হয়।’ আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আহমদ গালূশ বলেন, ‘মানুষকে ইসলামের দিকে নিয়ে আসার জন্য কার্যগত বা বাচনিক সব প্রচেষ্টার অপর নাম ইসলামী দাওয়াহ।’ এখানে বাচনিক বলতে আলাপ আলোচনা, ওয়াজ, নসিহত, কথোপকথন, বক্তৃতা-বিবৃতি, পাঠদান, দারস ইত্যাদি উদ্দেশ্য, আর কার্যগত বলতে দাঈ কর্তৃক চারিত্রিক তথা আচরণগত নমুনা পেশ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য চর্চা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সমাজসেবা, জিহাদ, লেখালেখি ইত্যাদি উদ্দেশ্য।
অন্য দিকে, তাবলিগ অর্থ প্রচার করা, পৌঁছানো। তাবলিগ হলো কোনো বাণী, আকিদাহ-বিশ্বাস, শিক্ষা-সংস্কৃতি বা আদর্শকে অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া। যার কাছে পৌঁছানো হবে, ইতোপূর্বে তার কাছে ওই বাণী বা ওই আদর্শের কথা পৌঁছে থাকতে পারে-আবার নাও পৌঁছাতে পারে। আবার সত্য হিসেবে সে ওই বাণী বা আদর্শ গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানও করতে পারে। এতে তাবলিগের কোনো ক্ষতির কারণ নেই। কারণ তাবলিগের অর্থ ও কাজই হলো পৌঁছে দেয়া। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে রাসূল! পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হতে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি তা না করেন, তবে আপনি তাঁর রিসালাত পৌঁছালেন না।’ (সূরা আল মায়িদাহ-৬৭) অন্য সূরায় মহান আল্লাহ বলেন, ‘সুস্পষ্টভাবে পয়গাম পৌঁছে দেয়া ছাড়া আমাদের ওপর আর কোনো দায়িত্ব নেই।’ (সূরা ইয়াসিন-১৭) বিদায় হজের ভাষণে রাসূল সা: বলেছেন, ‘বাল্লিগু আন্নি ওয়া লাও আয়াত।’ অর্থ : একটি আয়াত হলেও, তা আমার পক্ষ থেকে (অন্যের কাছে) পৌঁছে দাও। (তিরমিজি)।
‘দাওয়াহ’ ও ‘তাবলিগ’ শব্দ দুটি কখনো কখনো একটি বিশেষ অর্থে একটি অপরটির সম্পূরক হয়ে দাঁড়ায়। আবার কখনো কখনো উভয়টিই একটি পর্যায়ে এসে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের নিরিখে একাকার ও সংমিশ্রিত হয়ে যেতে পারে। তাই বলে বিনা বিচারে দুটি বিষয়কে সমার্থক মনে করাও সমীচীন নয়। কেননা- উভয়টির মধ্যকার শব্দগত ও তাৎপর্যগত পার্থক্য অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাবলিগ শুধু পৌঁছানোর নাম। কিন্তু দাওয়াহর কার্যক্রম শুধু পৌঁছানোর নাম নয়। এর রয়েছে বিভিন্ন কলা-কৌশল, পরিকল্পনা ও বিধিবদ্ধ পদ্ধতি। দাওয়াতের ক্ষেত্রে তাবলিগ বা পৌঁছানোর পর যারা সমর্থক হয়, তাদেরই প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করতে হয়। এ কারণে দাওয়াহ বিষয়ে অধিকাংশ লেখকের মতে ইসলামী দাওয়াতের তিনটি পর্যায় রয়েছে। যথা : ক. তাবলিগ বা পৌঁছানো, খ. তারবিয়াত বা প্রশিক্ষণ, গ. সমাজে বাস্তবায়ন ও বিরোধীদের মোকাবেলা।
এ কারণে দ্বীনের প্রচার-প্রচারণা তথা তাবলিগের কাজ একসময় নিঃশেষ হয়ে গেলেও দাওয়াহ ইলাল্লাহর কাজ কখনো নিঃশেষ হয় না। দাওয়াহর আবেদন চিরস্থায়ী। দ্বীনের প্রচার কাজ পৃথিবীর আনাচে-কানাচে এমনকি ঘরে ঘরে পৌঁছে গেলেও দাওয়াহর কাজ নিঃশেষ হবে না। মোটকথা, দাওয়াহ হলো আল্লাহর পথে আহ্বানের অতিশয় হিকমতপূর্ণ উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন নিরন্তর চলমান এক কর্ম প্রচেষ্টার নাম। এর বহুবিধ উপায়-উপকরণ, প্রক্রিয়া-পদ্ধতি ও কলা-কৌশল রয়েছে। আর তাবলিগের প্রচলিত ধারণাটি হচ্ছে সেই অসংখ্য পদ্ধতির মধ্য থেকে একটি পদ্ধতির নাম। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, তাবলিগ ব্যতীত দাওয়াহ যেমন স্থবির হয়ে গতি হারিয়ে ফেলে, তেমনি দাওয়াহবিহীন তাবলিগ অন্তঃসারশূন্য।
দাওয়াহ ও তাবলিগের গুরুত্ব
ইসলামী দাওয়াহ ও তাবলিগের গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন-
ফরজ ইবাদত : অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারের মতে দাওয়াহ ও তাবলিগের কাজ ফরজ। কেউ বলেছেন, প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর ক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুসারে ‘ফরজে আইন’ তথা সবার প্রতি ফরজ। আর মুসলিম উম্মাহর ওপর ‘ফরজে কেফায়া’ অর্থাৎ উম্মাহর কিছু লোক এ কাজে সম্পৃক্ত থাকলে অন্যরা দায়মুক্ত হয়ে যাবে। তবে সর্বসম্মত কথা হলো- দাওয়াহ ও তাবলিগের কাজ সাধারণভাবে ফরজে কেফায়া। পরিবেশ ও পরিস্থিতির আলোকে তা ফরজে কেফায়া হতে ফরজে আইন হতে পারে। যেমন দেশ বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে দাওয়াহ সবার জন্য ফরজে আইন হয়ে যায়। এ ছাড়া, দাওয়াতের জন্য বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি যেমন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, দায়িত্বপ্রাপ্ত ইমাম, খতিব, শিক্ষক, প্রশিক্ষকদের জন্যও দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ ফরজে আইন হিসেবে গণ্য হবে।
নবিওয়ালা কাজ : দাওয়াহ ও তাবলিগের কাজ মূলত নবী-রাসূলগণেরই কাজ। প্রত্যেক নবী-রাসূলই স্বীয় সম্প্রদায়ের কাছে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তারা (নবীগণ) আল্লাহর বাণী প্রচার করতেন এবং তাকে (আল্লাহকে) ভয় করতেন। তারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতেন না। হিসাব গ্রহণের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সূরা আহযাব-৩৯) কিন্তু নবী-রাসূলগণ যেহেতু চিরঞ্জীবী নন, তাই স্বভাবতই তাদের উম্মতের ওপর এ কাজের দায়িত্ব অর্পিত হয়ে থাকে। যেমন বলা হয়েছে- ‘আলিমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী।’ (আগামী কাল সমাপ্য)
লেখক : সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বগুড়া।