অসংখ্য মুসল্লিকে নিয়ে চলছে দাওয়াত ও তাবলীগের আয়োজনে বিশ্ব ইজতেমা। এবারের ইজতেমায় মুসল্লিদের উপস্থিতি অন্যবারের থেকে অনেক বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। নানা ধরনের কষ্ট-ভোগান্তি সহ্য করেই টঙ্গীর তুরাগ পাড়ের ইজতেমায় হেদায়াতপ্রত্যাশী মুসল্লিরা বয়ান শুনছে।
ইজতেমার প্রথম দিন বৃহস্পতিবার মাগরিবের পরে ইজতেমার মেম্বারে উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশে বয়ান করেছেন তাবলীগের শীর্ষ মুরব্বি ভারতের মাওলানা আহমদ লাট। পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে উর্দু ভাষায় করা ওই বয়ানের একাংশ অনুবাদ করেছেন আলেম সাংবাদিক মুহাম্মদুল্লাহ বিন ওয়াহিদ।
প্রিয় ভাইয়েরা, কেউ কোনো কিছু তৈরি করলে তার প্রতি মোহাব্বত ও ভালোবাসা থাকে। ঠিক তেমনি আল্লাহতায়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং এই মানুষের প্রতি তার সীমাহীন মোহাব্বত ও ভালোবাসা রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টি করে তাকে ছেড়ে দেননি। ইচ্ছে হলো জীবিত থাকল, ইচ্ছে হলো মরে গেল- এভাবে লাগামহীন মানুষকে ছেড়ে দেয়া হয়নি।
বরং সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই আল্লাহতায়ালা মানুষকে জান দিয়েছেন, সম্পদ দিয়েছেন, বিভিন্ন যোগ্যতা দিয়েছেন এবং খুব খেয়াল রেখেছেন, মানুষের ধনসম্পদ এবং বিভিন্ন যোগ্যতা ও সক্ষমতা যেন তার জন্য বিপদের কারণ না হয়। একারণেই মানুষ সৃষ্টির সূচনা থেকেই সঠিক পথের দিশা দেয়ার জন্য নবী-রাসুলদের ধারাবাহিকতা শুরু করেছেন। সাথে সাথে তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল,সহিফা এবং সর্বশেষ পবিত্র কোরআন কারিমের মতো বিভিন্ন আসমানি কিতাব দিয়েছেন।
জ্ঞান শেখার জন্য আসমানি কিতাব এবং কার্যত নমুনার জন্য নবী-রাসুলদের পাঠিয়েছেন। এ কারণেই কুরআনের শুরুতেই ঈমান, আমল এবং আখেরাতের কথা রয়েছে। মানুষ যেন দুনিয়ার পাশাপাশি আখেরাতেও সুখসাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে এটাই এর মূল উদ্দেশ্য।
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সুরার শুরুতে হুরুফে মুকাত্যআত বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরগুচ্ছ রয়েছে। যেমন, ‘আলিফ লাম মীম, হা মীম, ত্ব সীন, আলিফ লাম র,’ কুরআনের বেশিরভাগ ব্যাখ্যাকারদের মতে এই অক্ষরগুলোর অর্থ অবশ্যই রয়েছে। তবে এগুলোর অর্থ ও উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন। তবে, মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ রহ. বলতেন, কুরআনে যতগুলো হুরুফে মুকাত্বআত রয়েছে, চাই সেটা দুই হরফ বিশিষ্ট হোক, বা তিন-চার হরফ বিশিষ্ট যাইহোক- এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা বুঝিয়েছেন যে পৃথিবীতে যত শব্দ আছে, যত বাক্য আছে যার মাধ্যমে মানুষ কথা বলে, এগুলোর কোনো ধরনের ক্ষমতা নেই। ভাষাবিদদেরও কোনো ধরনের ক্ষমতা নেই। সবকিছুর ক্ষমতা রাখেন একমাত্র আল্লাহতায়ালা।
ذلك الكتاب لاريب فيه هدي للمتقين
এর মধ্যে তিনটি জিনিসের আলোচনা রয়েছে। ঈমান, নেক আমল ও আখেরাত।
ঈমান কী? ঈমান হলো– লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। এই কথা অন্তরে বসানো। আমলকে যথাযথ করা। আখেরাতকে বানানো। তাহলে দুনিয়া এবং আখেরাতের জীবন সুন্দর হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, এই কাজগুলো করলে তুমি পথপ্রাপ্রপ্ত হবে এবং সফলতা লাভ করবে। কারণ, যারা সঠিক পথপ্রাপ্ত হয়, তারা দুনিয়ার জীবনে সুখশান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে। তারা আখেরাতেও সফল হবে। দুনিয়ার জীবন যেন অশান্তির না হয় এবং আখেরাতের জীবন যেন ধ্বংসের না হয়, এই জন্য পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এই তিন জিনিসের প্রতি ডেকেছেন।
কোনো কিছুর ভয় অন্তরে থাকলে সেটা হবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ভয়। কারো কাছে আশা-আকাঙ্ক্ষা করতে হলে তা হবে আল্লাহ তায়ালার কাছে। ইসলামের বুনিয়াদি বিষয়ের মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে ঈমান। সাহাবায়ে কেরাম আমাদের জন্য আদর্শ।
তাদের বিষয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ما انا عليه و اصحابه
তারাই সঠিক পথে থাকবে যারা আমার এবং আমার সাহাবিদের অনুসরণ করবে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন,
عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الرشدين المهدين
তোমরা আমার এবং সুপথপ্রাপ্ত আমার খলিফাদের সুন্নতের অনুসরণ করবে। অর্থাৎ, আমাদেরকে সাহাবিদের অনুসরণে জীবন যাপন করতে হবে। তাদের চিন্তাচেতনা অন্তরে লালন করতে হবে। তাদের কাজকে নিজেদের কাজ মনে করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা সাহাবিদেরকে আমাদের জন্য নমুনা বানিয়েছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার পরে কেয়ামত পর্যন্ত যারা এই দুনিয়ার বুকে আসবে, তাদের সবার জন্য আমার এবং আমার সাহাবীদের আদর্শ রেখে গেলাম। তোমরা যদি এই দুই আদর্শকে সামনে রেখে চলো তাহলে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। অন্যথায় তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য। একারণেই প্রিয় ভাইয়েরা, আমাদের আদর্শ হলেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমাদের আদর্শ হলেন সাহাবায়ে কেরাম। এর বাইরে আমাদের কোনো আদর্শ বা অনুসরণীয় কেউ নেই।
আল্লাহতায়ালা জানমাল সবাইকেই দিয়েছেন। তিনিই নির্ধারণ করে কাউকে কম দিয়েছেন, কাউকে বেশি দিয়েছেন। কাউকে দীর্ঘ, কাউকে মধ্যম আবার কাউকে সংক্ষিপ্ত জীবন দিয়েছেন। কাউকে অনেক ধনসম্পদ দিয়েছেন, কাউকে মধ্যম আবার কাউকে দরিদ্র বানিয়েছেন। এভাবে জীবন আর সম্পদ আল্লাহ তায়ালা সবাইকেই দিয়েছেন।
জীবন এবং ধনসম্পদ আমাদের নয়। আল্লাহ তায়ালা এগুলো আমাদের কাছে আমানত হিসাবে রেখেছেন। এই আমানতের সঠিক ব্যবহারে দুনিয়ায় এবং আখেরাতে জীবন সঠিক হবে। আর এই আমানতে খেয়ানত করলে জীবনের আসল উদ্দেশ্য ঠিক থাকবে না। তখন দুনিয়া এবং আখেরাতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ও লাঞ্চিত হবো।
আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়ায় পাঠানোর পূর্বে ছয়শো বছর পর্যন্ত কোনো নবী আসেননি। অথচ, নবী-রাসুলগণই মানুষকে ভালোমন্দ শেখাতেন। আল্লাহর পরিচয় এবং আখেরাত, জান্নাত-জাহান্নাম চেনাতেন। এই দীর্ঘ সময় নবী-রাসুল না আসার কারণে পৃথিবীর মানুষ অন্ধকারে জীবন যাপন করছিল। ওই সময় তাদের এতটুকু অনুভূতি ছিলো না যে, এক টুকরো পাথর আমার সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা রাখে না। বিপদাপদ থেকে রক্ষা করতে পারে না। ইতিহাসবিদরা ওই যুগ সম্পর্কে লিখেছেন, ওই যুগ এতই ভয়াবহ ও মূর্খতাপূর্ণ ছিল যে, তা বর্ণনা করার ভাষা আমাদের জানা নেই।
দীর্ঘ দিন এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পরে আল্লাহতায়ালা দয়া ও অনুগ্রহ করে সকল নবীদের সর্দার হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়াবাসীর জন্য রহমত হিসাবে পাঠিয়েছেন এবং নবীজির নিজের মুখে গোষণা করিয়েছেন– হে দুনিয়ার লোকেরা, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর রাসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছি। ধনি-গরিব, সাদা-কালো, আরবি-আজমি, পূর্বের বা পশ্চিমের সব গোত্রের সব শ্রেণির মানুষের জন্য আমি নবী হিসাবে প্রেরিত হয়েছি। কেয়ামত পর্যন্ত আগত সমস্ত মানুষের প্রতি পয়গাম দিয়ে আল্লাহ তায়ালা আমাকে পাঠিয়েছেন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পয়গাম নিয়ে সাফা পর্বতে আরবের কোরাইশের সব গোত্রের লোকদেরকে ডাকলেন। কারো থেকে কাজ নেয়ার আগে তার মনমানসিকতা তৈরি করে নিতে হয়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পর্বতপ্রান্তরে সমবেত লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন– আমার বিষয়ে তোমাদের অভিমত কী? তখন লোকেরা বলল, আপনি মিথ্যা কথা বলবেন এই বিষয়ে আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আপনি চূড়ান্ত পর্যায়ের সত্যবাদী। আপনি আমানতদার। আপনার কাছে আমানত রেখে আমরা নিশ্চিন্ত হই। আপনি বিশ্বস্ত ও সৎ মানুষ।
উপস্থিত লোকদের অভিমত শুনে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা যদি আমাকে এতই বিশ্বাস করো তাহলে আমি তোমাদেরকে সংবাদ দিচ্ছি এই পাহাড়ের পেছনে অনেক বড় একটি শত্রুদল রয়েছে। তোমরা ভোর হওয়ার আগেই যদি এই জায়গা থেকে চলে না যাও তাহলে তারা তোমাদের ওপরে আক্রমণ করবে। আমি এমন সংবাদ দিলে তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে? উপস্থিত সবাই একবাক্যে জবাব দিলো, অবশ্যই আমরা বিশ্বাস করব। কারণ আপনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন না।
তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে তোমরা সবাই পড়ো- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, তাহলে তোমরা সফল হয়ে যাবে। আমি তোমাদেরকে বলছি, আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র উপাস্য। তার কোনো শরিক নেই। তার মত বা তার সমতূল্য কেউ নেই। এই কথা স্বীকার করলে তোমরা সফল হয়ে যাবে। দীর্ঘ ছয় শ’ বছর পর্যন্ত তারা গোমরাহ ছিল। বিভিন্ন মূর্তি ও বস্তুর পূজা করতো। এগুলোকে বিশ্বাস করতো। তারা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এসব কথা শুনে বলতে লাগলো এরকম মিথ্যা কথা ইতোপূর্বে আর কখনো শুনিনি।
তবুও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাল ছাড়েননি। তাদের পেছনে মেহনত করেছে। বিভিন্ন গোত্র এবং বিভিন্ন শহরে গিয়ে ধনী-গরিব, সাদা-কালো, অশিক্ষিত-শিক্ষিত, যুবক-বৃদ্ধ যাকে পেয়েছেন তার কাছেই দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছেন। মানুষকে বুঝিয়েছেন, তোমরা এক আল্লাহকে উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করো। তাহলেই সফল হবে। দুনিয়া এবং আখেরাত সুখময় হবে। নয়তো ধ্বংস ও লাঞ্চনা তোমাদেরকে আঘাত করবে।
প্রিয় ভাইয়েরা, আমরা যখন কাউকে দাওয়াত দিব তখন নিজেকে প্রস্তুত করেই দাওয়াত দিব। যাকে দাওয়াত দিচ্ছি সে আমার কথা নাও মানতে পারে। এ কারণে নিরাশ হওয়া যাবে না। কুরাইশের কাফেররা যখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা মানল না, তখন কিন্তু তিনি নিরাশ হননি। তাদের পেছনে আরো মেহনত করেছেন। বারবার দাওয়াত দিয়েছেন।
আমরাও মানুষের পেছনে অব্যাহত মেহনত করে যাবো। আর, আল্লাহ তায়ালা আমাকে যেই জীবন এবং সম্পদ দিয়েছেন তা সঠিকভাবে ব্যবহার করবো। জীবনের সব ক্ষেত্রে দ্বীন মানব। চাই সেটা ঘরে, সমাজে, দেশে বা নিজের কর্মস্থলে যেখানেই হোক। সবখানে আল্লাহ তায়ালা যেভাবে চলতে বলেছেন সেভাবেই চলবো তাহলে জীবন সুখময় হয়ে যাবে।
লেখক : মুহাম্মদুল্লাহ বিন ওয়াহিদ
শিক্ষা পরিচালক, জামিয়া আরাবিয়া মদীনাতুল ঊলূম ওয়াহেদ নগর মাদরাসা, ডাকাতিয়া, ভালুকা, ময়মনসিংহ।