অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চাই। আন্দোলনের জন্য সংগঠন দরকার। প্রস্তুতিও চাই। লড়াইটা পুরোমাত্রায় রাজনৈতিক। কিন্তু তাতে জেতার জন্য সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি অপরিহার্য। মিয়ানমারের মানুষ যে এতকাল ধরে সেনাশাসনকে মেনে নিয়ে চুপ করে ছিল, রোহিঙ্গাদের উৎখাতে তারা যে ধরে নিয়েছিলÑ তাদের উপকার হচ্ছে, তাদের সেই সংকীর্ণ বর্ণবাদী মনোভাবের পেছনে অবশ্যই কার্যকর ছিল সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা। তাদের সাংস্কৃতিক চেতনাটাকে দাবিয়ে রাখা হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যে যে আরব বসন্তের প্রবল হাওয়া দোলা দিয়েছিল, সেটি তো ছিল একটা জনঅভ্যুত্থান। তাতে তো মনে হচ্ছিল একটা সামাজিক বিপ্লব না ঘটিয়ে ওই অভ্যুত্থানের সমাপ্তি ঘটবে না। সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি। মিসরের কথাটাই ধরা যাক। সেখানে উত্তাল আন্দোলনটা ছিল খুবই দুরন্ত। স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক নিশ্চিন্তই ছিলেন যে, তার শাসনই চলবে। আন্দোলনের তোড়ে তিনি ভেসে গেলেন। তার পর কারা এলো? এলো মুসলিম ব্রাদারহুড যারা ধর্মরাজ্য কায়েমে বিশ্বাসী। পরিবর্তন ঘটেছে ভেবে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের অসন্তোষটা কমেছিল। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডের সাধ্য কী মানুষের মুক্তি দেয়? ব্রাদারহুড ব্যর্থ হলো। আর ব্যর্থতার সেই সুযোগে ক্ষমতা দখল করে নিল সেনাবাহিনী- যাদের সাহায্যে হোসনি মোবারক এক সময় মানুষকে পীড়ন করতেন। ‘আরব বসন্ত’ ব্যর্থ হওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির অভাব। আন্দোলন ছিল মূলত তরুণদের। তারা বিদ্রোহ করেছে। তাদের কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক দল ছিল না। লক্ষ্য ছিল না সামাজিক বিপ্লব পর্যন্ত এগোনোর। আমেরিকায় কট্টরপন্থি রিপাবলিকানরাও সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। সে দেশে এখন শতভাগ সাক্ষরতা বিদ্যমান। তবে গড়পড়তা আমেরিকান তাদের দেশের বাইরে কোথায় কোন দেশ আছে, সে বিষয়ে অতিঅকিঞ্চিৎকর পরিমাণ জ্ঞান রাখে। এক জরিপ বলছে, ২৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান একটিও বই পড়েনি। রাষ্ট্রব্যবস্থাই আমেরিকানদের সাংস্কৃতিক চেতনাকে দমিয়ে রেখেছে। অত্যন্ত বিজ্ঞ ব্যক্তি জগৎবিখ্যাত বিল গেটস। কথা বলেন, চিন্তা করেন; যা-ই বলেন, সেটি প্রচার পায় ও প্রভাব ফেলে। কয়দিন আগে তিনি জানিয়েছেন, করোনা মোকাবিলার তুলনায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা অনেক কঠিন কাজ। তিনি বলেননি যে, দুটোই একটি অভিন্ন রোগের দুটি ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। আর বলেননি যে, রোগটির নাম হলো পুঁজিবাদ। সেটি বললে বিশ্ববাসীর সাংস্কৃতিক উন্নতিতে সাহায্য করা হতো। সাংস্কৃতিক উন্নতিটা আজ বিশ্বব্যাপী জরুরি। ওই উন্নতি দাতব্যে ঘটে না, জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে।
বোঝাই যাচ্ছে, সংশোধনে কুলাবে না। প্রয়োজন হবে রাষ্ট্র ও সমাজকে বদলে ফেলার জন্য সামাজিক বিপ্লবের। গত শতাব্দীতে কয়েকটি দেশে সামাজিক বিপ্লব ঘটেছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত নতুন সমাজ টিকে থাকতে পারেনি। এর বড় কারণ পেছনকার সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিটা পরিপূর্ণ ছিল না। পরিবর্তিত বিশ্বে সামাজিক বিপ্লব কোনো এক দেশে ঘটবে না, ঘটবে সারাবিশ্বে। প্রতিটি দেশেই মীমাংসা ঘটা চাই ওপর ও নিচের ভেতরকার শ্রেণি সম্পর্কের। সেটি ঘটাতে হবে প্রতিটি দেশকে তার নিজের মতো করেই। তবে আবার বিশ্বজনীনভাবে ও পদ্ধতিতে। বিশ্বজনীন না হলে পরিবর্তন স্থায়ী হবে না।
বস্তুগত অবস্থাটা মানবিকতার পরিপোষক হবে তখনই- যখন সম্পত্তিতে ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা ঘটবে। আর এ জন্যই কেবল অভ্যুত্থান নয়, সামাজিক বিপ্লবই চাই। মুক্তি আসলে ততটাই দূরে সমাজবিপ্লব যতটা দূরবর্তী।
মুক্তির আন্দোলনে ছাত্ররা একটা বড় ভরসা। কিন্তু বাংলাদেশে তরুণ শিক্ষার্থীরা নানা রকমের সংকটে রয়েছে। তার পরও কথা থাকে। যেমন পরীক্ষা। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষার দ্বারা আক্রান্ত। এখানে শিক্ষাদানের তুলনায় পরীক্ষা গ্রহণের তৎপরতাই অধিক। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর মিলিয়ে দুটি অনাবশ্যক ও রীতিমতো ক্ষতিকর পরীক্ষা বসানো হয়েছিল। কেন সেটি, ঠিক বোঝা যায়নি। তবে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দুটির প্রত্যাহার করার কথা শোনা গেছে। ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার ভয়ে কাতর থাকে। পরীক্ষা পেছানোর জন্য আন্দোলনও বিরল ঘটনা নয়। কিন্তু পরীক্ষা দিতে চাই, পরীক্ষা নাও এ রকম আন্দোলনের খবর আগে শোনা যায়নি। এবার শোনা গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা নেমেছিল প্রথমে। পরে নেমেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশজুড়ে। বুঝতে পারছি, বিদ্যমান ব্যবস্থার সাধ্য নেই মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার।
আরেকটি সংকট সম্প্রীতির। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষ বেধেছে। এটি নতুন ব্যাপার নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে আশপাশ গ্রামবাসীর সংঘর্ষ বাধত। গ্রামবাসীর অভিযোগ ছিল, তাদের জায়গাজমি দখল করে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বসানো হয়েছে। অথচ তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়ালেখার সুযোগ পায় না। এ ক্ষোভটিকে কাজে লাগাত ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা। তারা গ্রামবাসীর ঘরে ভাড়া থাকত, কেউ কেউ বিয়েশাদিও করত এবং মানুষকে দলে টানত। সেই তৎপরতা এখন মনে হয় কমেছে। তবে খবর হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী গেরুয়া গ্রামের মানুষের সংঘর্ষের। উপলক্ষটা ছিল ক্রিকেট খেলা। রাজশাহীর তুলনায় এটা আধুনিক। পরে জানা গেছে আসল ঘটনা ক্রিকেট খেলা নয়, চাঁদাবাজি। সেটি আরও আধুনিক বৈকি। রীতিমতো পুঁজিবাদী। ওই গ্রামে বাজার আছে, দোকানপাট আছে, ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। সেখানে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের ছেলেরা নিয়মিত চাঁদা তুলে থাকে। না, দুই-দশ টাকার নয়; একশও নয়, হিসাব হাজারে ও লক্ষে। ক্রিকেট খেলা উপলক্ষ করে স্থানীয়দের চাপা ক্ষোভ মূর্ত হয়ে উঠেছে। সংঘর্ষে আহত হয়েছে ৩০-৩৫ ছাত্র। তারা অধিকাংশই নিরীহ। উন্নতি অতটুকুই, জামায়াত-শিবিরের জায়গায় ছাত্রলীগের আগমন। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ, ছাত্ররা; গ্রামবাসীও।
রয়টার্স খবর দিয়েছে যে, মহামারীকালে ধনী-দরিদ্রবৈষম্য বৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ বেড়েছে। খবরের ভিত্তি একটি বৈশ্বিক গবেষণা। বৈষম্য বৃদ্ধিটা অবশ্য তেমন কোনো খবর নয়। খবর হচ্ছে এ নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধির ঘটনা। বলা হচ্ছে, উদ্বেগটা তরুণদের ভেতরেই অধিক। এটাও ভালো খবর। অনেক কিছু তাদের ওপরই ভর করে আছে। ওই গবেষকরা সব দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ধনী-দরিদ্রের ভেদটি কমানোর জন্য। অসুবিধাটা রয়েছে এখানেই। সরকারগুলোর কাছে আহ্বান বৃথা। পদক্ষেপ নিতে হবে ভুক্তভোগীদেরই। গবেষকরা যখন ওই কথাটি বলবেন, তখন বোঝা যাবে মানুষের মুক্তির আন্দোলনে তারাও যুক্ত হয়েছেন। না হলে বাগাড়ম্বরই বাড়বে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়