শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩২ পূর্বাহ্ন

জ্ঞান-গবেষণায় বাংলা ভাষার বিকল্প নেই

ড. তাহমিনা বেগম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
  • ১১২ বার

মা কথাটি ছোট্ট অতি
কিন্তু জেন ভাই
ইহার চেয়ে নামটি মধুর
তিন ভুবনে নাই।
কবি যথার্থ বলেছেন। বলেছেন সারল্যতায়। গভীর ভালোবাসায়। মা কথাটি ঘিরেই জীবনে আনন্দের সূচনা। তেমনি মায়ের মুখের ভাষা। মায়ের বুকেই সমস্ত প্রশান্তি লুকিয়ে। ভাষার আনন্দও ঠিক তেমনি। ভাষা মানেই মায়ের বলা কথা। নিজেকে প্রকাশ করার উচ্ছ্বাস। মনের কথা বলতে পারার যে সুখ তা আর অন্য কিছুতেই মেলানো যায় না। যত কথা বলি সবই ভাষার আনন্দে। পৃথিবী জয় করার সাহস দেখাই তাও ভাষা আছে বলেই। যদি ভাষা না থাকত কেমন হতো! কেমন করে বলতাম মনের যত কথা। নিজেকে জানার জন্যও ভাষার উপস্থিতি জরুরি। পৃথিবীর বুকে যত দেশ আছে সব দেশেরই ভাষার আনন্দ আছে। আছে ভিন্নতা। মায়ের মুখের ভাষার আনন্দে জাগ্রত মানবজতি। গৌরবময় ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে ভাষার আনাবিল আনেন্দ। তেমনি আমার প্রাণের ভাষা। আমার প্রিয় বাংলা ভাষা। বাংলা আমার মায়ের ভাষা। লাখো কোটি মানুষের বুক জড়ানো মাতৃভাষা।

সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটির প্রথম অধিকার তার ভাষা। মায়ের মুখ নিঃসৃত প্রথম শব্দ। প্রথম বেঁচে থাকার এক অন্যরকম আনন্দ। প্রতিটি মানুষেরই মৌলিক অধিকার রয়েছে। রয়েছে স্বাতন্ত্র্যবোধ। আছে ভাষার অধিকার। এটি মানুষের ইচ্ছাকৃত কোনো চাওয়া নয়; স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দিয়েছেন ভাষার আনন্দ। শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে তিনি মানবজাতিকে পাঠিয়েছেন এ নশ্বর পৃথিবীতে। যত আয়োজন সৃষ্টির রহস্য ঘিরে আবর্তিত তন্মধ্যে ভাষা অন্যতম। বেঁচে থাকার এ এক অন্যরকম সুখ। একটি জীবনকে ঘিরে আছে নানারকমের উপকরণ। বাসস্থান থেকে শুরু হয়ে এর বিস্তৃতি ছড়িয়ে আছে বহুদূর। এর সবই জীবনের প্রয়োজনে মানুষই মানুষকে দিয়ে থাকে। সুস্থ-সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় গড়ে তোলে নগর-সভ্যতা। আমৃত্যু চাওয়া থাকে একটাই যেন এ চাওয়াগুলো পূরণে কোনো বিঘœ না ঘটে।

বছর ঘুরে বছর আসে। নতুন আলোয় পৃথিবী হাসে। নতুন স্বপ্ন বোনে মন। ভালোবাসায় সাজিয়ে তোলে আপন পৃথিবী। তেমনি মানুষ ভালোবাসে ভাষাকে। মায়ের ভাষায় জ্ঞানচর্চা করে সাক্ষর রাখতে চায়। কিন্তু এই ভাষার অধিকারও কখনো কখনো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মানুষই কেড়ে নিতে চায় মানুষের মৌলিক এ অধিকারটুকু। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন মানচিত্রের দেখা মেলে। মানুষেরই কাছে মানুষের অসহায়ত্ব বড় কষ্টের। কিন্তু পৃথিবীর বুকে টিকে থাকার লড়াই কেউ ছাড়ে না। এটি ছেড়ে দেয়ার মতো বিষয় নয়। প্রথম বলা শব্দটি মা। মায়ের মুখের এই ভাষাকে পেতে লড়াই করতে হয়। যেমনটি করেছি আমরা। প্রিয় বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। লাখো প্রাণের আত্মত্যাগে পেয়েছি মায়ের মুখের ভাষার স্বাধীনতা। স্বাধীন দেশের বাংলা ভাষা। প্রতি বছর ভাষা আন্দোলনের বেদনাবিধুর স্মৃতি ও সংগ্রামী চেতনার অমিয় সুধা পান করে একুশে ফেব্রæয়ারি। রক্তঝরা সংগ্রামের পথ ধরে বাঙালি জাতির জীবনে আসে মাতৃভাষার গৌরব।

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা জয় করার ইতিহাস খুব সহজ ছিল না। ১৯৪৭ সালে এ উপমহাদেশে ইংরেজদের বিদায়ের মধ্য দিয়েও শাসকদের শোষণ বন্ধ হয়নি। ওই সময় পাকিস্তান ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। পশ্চিম ও পূর্ব। পূর্ব পাকিস্তান মানেই আমাদের বাংলাদেশ। বেশির ভাগ মানুষই কথা বলত বাংলা ভাষায়। শাসক শ্রেণীর একটি পক্ষ উর্দু ভাষাকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। এ চাওয়া কতটা গ্রহণযোগ্য বা এর পরিণতি কী হবে তা ভাবেনি তারা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্তস্বরূপ ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। অকারণ এ অনাকাক্সিক্ষত ঘোষণা মেনে নিতে পারেনি বাংলার জনতা। কেন তারা গ্রহণ করবে- এমন অযৌক্তিক দাবি! বাংলার মানুষের হৃদয়ে আঘাত করার যে দৃষ্টতা তারা দেখিয়েছে সেটিই ছিল তাদের জন্য পরম আফসোসের। সে মুহূর্তেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ। ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। মিছিল-মিটিংয়ে রাজপথ উত্তাল রূপ ধারণ করে। গ্রাম থেকে শহর কেউই বাদ নেই এ ভাষার অধিকার পেতে। ভঙ্গ করে দেয় সরকারের দেয়া সব ঘোষণা। সে সময়ে আন্দোলনের অগ্রপথিক ছিল তমদ্দুন মজলিশ। বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনও তখন সোচ্চার। সবাই একত্র হতে থাকে। পাকিস্তানি শাসক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে। তবুও বাঙালিরা এতটুকু পিছিয়ে যায়নি; বরং আন্দোলন হতে হতে একসময় ভীষণ জোরালো আকার ধারণ করে। বাঙালিরা জেগে ওঠে ভাষার স্বাধীনতা রক্ষায়। ১৯৫২ সালের আন্দোলনের তীব্রতায় তারা ভেঙে ফেলে সরকারের দেয়া ১৪৪ ধারা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিতে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। এ দিনটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম দিন। পাকিস্তানি পুলিশের নির্মমতার শিকার হয়ে সেদিন রাজপথে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকেই। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় তারা সেদিন বিশ্বের দরবারে ইতিহাস রচনা করেন। বহু বাঙালির রক্তের বিনিময়ে তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দানে বাধ্য হয়। এ আনন্দ প্রতিটি বাঙালির আনন্দ। নিজের ভাষাকে নিজের বলতে পারার আনন্দ। এ আনন্দ আমাদের ভৌগোলিক সীমারেখার বাইরেও পৌঁছে গেছে পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় কোণায়। এ অর্জন আমাদেরকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা এনে দিয়েছে। ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার লাল সূর্য। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার আনন্দেই রচিত হয়েছে একুশের চেতনা।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি- আব্দুল গাফফার চৌধুরী কতটা আনন্দচিত্তে গর্বিত হৃদয়ে লাখো প্রাণের তরে লিখেছেন এই গান। আজো প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে গানের সুরে মুগ্ধ হই। গানের কথাগুলো মনে করিয়ে দেয় কেমন করে অত্যাচার শোষণের কালো হাত গুঁড়িয়ে ভাষার স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা হয়েছে। এটিই আমাদের চলার পথের প্রেরণা। যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস। একুশের এই উদ্দীপনা ছড়িয়ে আছে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের প্রতিটি ক্ষেত্রে। পরিবর্তনও এসেছে অনেক। সময়ের পরিবর্তনে আজ আমরাও পরিবর্তন হচ্ছি প্রতিদিন। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই। কতটা পরিবর্তন এসেছে আমাদের জীবনে। যে ভাষার জন্য আমরা জীবন দিতে এতটুকু দ্বিধা করিনি। সেই ভাষার মর্যাদা ঠিক কতটা দিতে পারছি? চলনে-বলনে, লেখাপড়ায় কতটা ধারণ করছি। আজ তা ভাবনার বিষয়! বাংলা ভাষার জন্য এ যুদ্ধ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সংঘটিত হয়নি। অথচ আজ আমরা আমাদের এই প্রিয় বাংলা ভাষায় কথা বলতে, নিজেকে প্রকাশ করতে দ্বিধা করি। কেন এত দ্বিধা, কেন এত সঙ্কোচ! বরং গর্ব বোধ করি বিদেশী ভাষার জ্ঞানে। অন্য ভাষার পাণ্ডিত্যই যেন আমাকে বিশেষ করে তোলে। এ লজ্জা আসলে কতটা বেদনার! কতটা কাক্সিক্ষত! কতটা পরিহাসের! আদৌ কি আমরা ভাবছি। ভাবছি না, কিছু করছিও না। এমন দিন দেখব বলেই কি এ ভাষার জন্য এত মানুষের আত্মত্যাগ! জাতি আজ ভীষণভাবে লজ্জিত। এ লজ্জা আমাদের সবার।

প্রতি বছর একুশের আয়োজন চলে বিপুল উৎসাহে। রাত ১২টা বাজার অপেক্ষায় প্রহর গুনে হাজার হাজার মানুষ। মধ্যরাতে অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে আসে চমকপ্রদ আয়োজন। শহীদ মিনারের আঙিনা ভরে ওঠে শতরকমের ফুল ও ফুলের ডালায়। ভোরের আলো অপেক্ষায় থাকে প্রভাত ফেরির। শতশত মানুষ খালি পায়ে ফুল হাতে হাজির হয় শহীদদের সম্মান জানাতে। স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কোনো কিছুই বাদ থাকে না। একুশের যে চেতনা জাতীয় জীবনের এক গৌরবময় ইতিহাস, তার কোনো রেশই থাকে না। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকেই যেন সব ভুলে যাই আমরা। আমাদের আবেগ, উচ্ছ্বাস, সম্মান সবই যেন পদদলিত। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আজো অফিস-আদালতে ইংরেজি ভাষা একক আধিপত্য বিস্তার করে আছে। শিক্ষাব্যবস্থায় চলছে অকারণ অস্থিরতা। অথচ পৃথিবীর বুকে যত জাতি-গোষ্ঠী রয়েছে তন্মধ্যে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এই গৌরব আমাদের সবার। তাই একে রক্ষার দায়িত্বও আমাদের। একটি জাতি তখনই সমৃদ্ধের শিখরে আরোহণ করে যখন সেই জাতির মানুষেরা তাদের প্রাপ্তিকে গভীরভাবে গ্রহণ করে। সঠিকভাবে জীবনে প্রয়োগ করে। দেশে-বিদেশে সর্বত্র নিজের ভাষাকে সম্মান করে।

বিশ্বের প্রতিটি দেশই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির আদলে পরিচালিত। জ্ঞান-গবেষণায় কখনোই তারা নিজেদের ভাষার বাইরে অবস্থান করে না। বিদেশী ভাষার ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিষয়ে দৃঢ়। আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিও তারা গ্রহণ করে না। এ থেকে সহজেই অনুমেয় তাদের কাছে ভাষার গুরুত্ব কতটা। চিন্তার বিষয় এখানেই, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী অপেক্ষমাণ! কেমন হবে তাদের ভাষার সাথে সম্পর্ক? এ ভাবনার রেখাটি গুরুত্বপূর্ণ। শৈশবেই বীজ বপন করতে হয়। সাহিত্যচর্চা, খেলাধুলা, ব্যবসায়-প্রযুক্তিতে ভাষার ব্যবহার সহজ করে নিতে জানতে হয়। জীবনে বেড়ে উঠায় বড় স্বপ্ন দেখা চাই। সে স্বপ্নই মানুষকে পৌঁছে দেয় সাফল্যের দুয়ারে। তাই তাদের মধ্যেই ছড়িয়ে দিতে হবে ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা। তারাই পারবে বাংলা ভাষায় নিজেদের তুলে ধরতে। অমর একুশের যোগ্য উত্তরসূরি হতে।

বইয়ের বুকে জেগে থাকে সভ্যতার ইতিহাস। অতীত থেকে বর্তমানের মানচিত্র। ইতিহাসের সাক্ষী হতে বইয়ের বিকল্প কিছু নেই। একটি সময় ছিল যখন বইপড়া ছিল মানুষের আনন্দের অন্যতম উপকরণ। বইপড়া হলো অনাবিল আনন্দের অফুরন্ত উৎস। জীবনের নানা আয়োজনে বইয়ের ভ‚মিকা ছিল অসামান্য। বই-ই জ্ঞানার্জনের প্রধান মাধ্যম। বইপ্রেমিকদের জন্য একুশের বই মেলা প্রতি বছরই এমন সুযোগ করে দেয়। বাংলা একাডেমি এর আয়োজক। মেলাকে ঘিরে থাকে হাজারো স্বপ্ন। মেলায় যেতে সবাই কমবেশি ভালোবাসে। প্রযুক্তিগতভাবে আমরা আজ অনেকটাই এগিয়ে। চাইলেই ইন্টারনেট আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছে পুরো বিশ্বকে। তবুও বইয়ের মেলায় নতুন বইয়ের গন্ধের যে আনন্দ তা আর মেলে না কোনোভবেই। একুশের বইমেলাকে ঘিরে থাকে বিপুল আয়োজন। নতুন নতুন লেখকের মুখ। নতুন নতুন বিষয় নিয়ে হাজির হয়। কত রকম গল্প, উপন্যাস-কবিতা। শিশুদের জন্য থাকে কিশোর উপন্যাস। কিশোর কবিতা। এসবই লেখা হয় প্রিয় বাংলা ভাষায়। এমনই আনন্দের তরে জেগে থাকে বইমেলা। জ্ঞানরাজ্যের তৃপ্তি মেটাতে বাংলা ভাষার বিকল্প কিছু নেই। মায়ের ভাষায় মনের ভাব প্রকাশের যে আনন্দ তা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই ভাষার বিষয়ে আমাদের সচেতনতা জরুরি। বেশি বেশি বইপড়া ও বই কেনায় উৎসাহিত করতে হবে সবাইকে। একটি উন্নত চিন্তাই পারে একটি উন্নত ও পরিশীলিত জীবন উপহার দিতে। ভাষার এই দিনে আমাদের চেষ্টা হবে যেন আমরা নিজ ভাষায় শুদ্ধ বলি ও লিখি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com