মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা। মানবশিশু দুনিয়াতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছ থেকে যে ভাষা শোনে এবং তাদের সাথে যে ভাষায় কথা বলে, তাই তার মাতৃভাষা। মায়ের ভাষায় কথা বলা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মাতৃভাষা মানুষের পবিত্র এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। এ ভাষা দিয়ে মানুষ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে। এ ভাষায় তাদের অস্তিত্ব স্বাক্ষরিত হয়। মাতৃভাষা মহান আল্লাহর অপার দান। তাই ইসলাম মায়ের প্রতি যেমন অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দিয়েছে, তেমনি মাতৃভাষার প্রতিও অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তাঁর প্রেরিত প্রত্যেক নবী-রাসূলকে স্বজাতির ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন এবং ওই ভাষাতেই তাদের প্রতি কিতাব নাজিল করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে (দ্বীনকে) পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা ইবরাহিম-৪)
হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা কোনো নবী-রাসূলকে তার স্বজাতির ভাষা ব্যতীত পাঠাননি।’ (মুসনাদে আহমদ-২০৪৪)
তাই তো দেখা যায়, হজরত মুসা আ:-এর সম্প্রদায় ইবরানি বা হিব্রু ভাষায় কথা বলত, যার কারণে তাওরাত নাজিল হয়েছিল হিব্রু ভাষায়। ঈসা আ:-এর সম্প্রদায় কথা বলত সুরিয়ানি ভাষায়, যার কারণে ইঞ্জিল কিতাব নাজিল হয়েছিল সুরিয়ানি ভাষায়। আর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব আল-কুরআনের ধারক ও বাহক হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন আরবিভাষী। তাই তাঁর ওপর নাজিলকৃত কিতাব আল-কুরআনের ভাষা আরবি। এই মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আমি কুরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি এর দ্বারা পরহেজগারদের সুসংবাদ দেন এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করেন।’ (সূরা মারইয়াম, আয়াত-৯৭)
মানুষ জন্মলগ্ন থেকে যে ভাষায় কথা বলে বড় হয়ে ওঠে, সে ভাষায় কথা বলার অধিকার তার জন্মগত অধিকার ও সহজাত প্রবৃত্তি। ফলে এটি তার অস্থিমজ্জা, রক্ত-মাংসের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। মায়ের প্রতি সন্তানের আকর্ষণ যেমন স্বাভাবিক, মাতৃভাষার প্রতি আকর্ষণও তেমনি স্বাভাবিক। যেকোনো মৌলিক অধিকার জরুরি অবস্থায় রাষ্ট্র কর্তৃক স্থগিত ঘোষিত হতে পারে; কিন্তু ভাষা এমন মৌলিক অধিকার, যা কখনো হস্তক্ষেপযোগ্য নয়। আর এটি করলে মানব সৃষ্টির কাঠামোতেই হস্তক্ষেপ করা হয়, তার অস্তিত্ব ও সত্তাকে অস্বীকার করা হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘দয়াময় আল্লাহ। তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন। তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করা।’ (সূরা আর রাহমান : ১-৪)
আলোচ্য আয়াতের মাধ্যমে জানা যায়, মানুষ সৃষ্টির সাথে ভাষার এক অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে। তাই মাতৃভাষা মানুষের একটি সৃষ্টিগত অধিকার। পৃথিবীতে অসংখ্য মাতৃভাষা প্রচলিত আছে। জগতের সব মানুষই কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে। সবার ভাষা কিন্তু এক নয়। জাতি-গোষ্ঠী ও ভৌগোলিক সীমানাভেদে একেকজন একেক ভাষায় কথা বলে। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় সাত হাজারের অধিক ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। বিচিত্র এসব ভাষায় বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও অঞ্চলের মানুষ কথা বলে। এ ভাষাগুলোই প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের মাতৃভাষা। আর এর মধ্যে রয়েছে প্রজ্ঞাময় স্রষ্টার বিশেষ রহস্য। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ইরশাদ করেন- ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই জ্ঞানীদের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন।’ (সূরা রুম-২২)
মাতৃভাষা চর্চা বা বিশুদ্ধভাবে কথা বলা রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুপম সুন্নাত। মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সা: ছিলেন আদর্শের মূর্তপ্রতীক। আরবের কুরাইশ গোত্রের সম্ভ্রান্ত লোকদের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী শৈশবে হজরত মুহাম্মদ সা: বিবি হালিমার তত্ত্বাবধানে বিশুদ্ধ ভাষাভাষী বনু সাদ গোত্রে প্রতিপালিত হওয়ার সুবাদে বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শিখেছিলেন। কোনো ভাষাকে হেয়জ্ঞান করার অবকাশ নেই, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই ও অবহেলা করার অধিকার নেই। কেননা, ভাষার স্রষ্টা মহান আল্লাহ। তাঁর সৃষ্টির অবমূল্যায়ন করা তাঁর প্রতি অসম্মান প্রদর্শনেরই নামান্তর। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাঁদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ (সূরা ইবরাহিম-৪)
যতœসহ ভাষা লালন তথা শুদ্ধভাবে জানা এবং চর্চা করা মাতৃভাষার গুরুত্বের অপরিহার্য দাবি। শুদ্ধভাবে মাতৃভাষা বলতে ও লিখতে পারা যেকোনো দায়িত্বসচেতন নাগরিকের কর্তব্য। আর মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বানকারী মুবাল্লিগ ও দ্বীন প্রচারক আলিমদের জন্য এর গুরুত্ব অন্য সবার চেয়ে বেশি। তাই মুসা আ: আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক ফেরাউনের কাছে অমোঘ সত্যের বাণী পৌঁছানোর দায়িত্ব পেয়ে আপন ভাই হারুন আ:-কে চাইলেন সহযোগী হিসেবে। নিজের ভাষায় কিছুটা জড়তা আর ভাইয়ের ভাষা উন্নততর হওয়ায় তিনি এ আবেদন জানান। কুরআন মাজিদে এভাবেই বিবৃত হয়েছে- ‘আর আমার ভাই হারুন, সে আমার চেয়ে স্পষ্টভাষী, তাই তাকে আমার সাথে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন, সে আমাকে সমর্থন করবে।’ (সূরা কাসাস-৩৪)
বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের ভাষা বোঝা ও তাদের কাছে নিজস্ব ভাষায় ইসলামের দাওয়াত প্রদানে মহানবী সা: অপরাপর জাতির মাতৃভাষা শেখার জন্য সাহাবায়ে কেরামদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। সাহাবিদের মধ্যে অনেকেই আরবি ভাষা ছাড়াও অন্যান্য ভাষা যেমন- পারস্য, মিসরীয়, রোমান ও আফ্রিকান ভাষা জানতেন এবং সে ভাষায় উত্তম বক্তৃতা পরিবেশনে পারদর্শী ছিলেন। যেমন- রাসূলুল্লাহ সা: জায়েদ ইবনে সাবিত রা:-কে সুরিয়ানি ভাষা তথা ইহুদিদের কিতাবের ভাষা (হিব্রু) শিক্ষা করার নির্দেশ দেন আর তিনি অল্প কিছুদিনের মধ্যে এ ভাষা আয়ত্ত করেন।’ (তিরমিজি-২৭১৫, মিশকাত-৪৬৫৯)
রাসূলুল্লাহ সা:-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। তিনি সারা জীবনে নিজ মাতৃভাষায় একটি অশুদ্ধ বাক্যও উচ্চারণ করেননি; বরং অন্যদের মাতৃভাষা বিশুদ্ধভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এবং মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানের পথ উন্মুক্ত করেছেন। আবার কখনো কখনো তিনি যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সন্তান-সন্ততিদের জন্য নিছক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ভাষার জ্ঞান শিক্ষা দিয়ে বন্দীদের মুক্তি দিয়েছেন। নিয়ম করেছিলেন, ‘একজন বন্দী ১০ জন শিশুকে লেখাপড়া ও হস্তলিপি শেখালে তাকে মুক্তি দেয়া হবে’। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ই.ফা.বা তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৬৯)
অথচ আমাদের দেশে এখন কোনো পরিবারে মাতৃভাষা না জানা কৃতিত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেরা অশুদ্ধ ইংরেজি বলার বদভ্যাসের সাথে নিজেদের সন্তানদেরও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে দিয়ে মাতৃভাষা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আরো দুঃখের বিষয় হলো- এমন অনেক শিক্ষিত আছেন, যারা মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা তো দূরের কথা, শুদ্ধ উচ্চারণে মাতৃভাষায় কথা বলতেও পারেন না। বাংলাভাষার প্রতি এ রকম উদাসীনতা মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা ও ভাষাশহীদের আত্মত্যাগকে অবমূল্যায়ন করার শামিল নয় কি?
এদিকে এফএম রেডিও আর কিছু ক্ষ্যাপাটে অর্বাচীন তরুণ-তরুণী টিভি উপস্থাপনায় বাংলিশ তথা বাংলা-ইংরেজির জগাখিচুড়ি রসায়নে বাংলার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। এদের উৎপাত-অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া নতুন বছরের পাঠ্যপুস্তকে এমন সব ভুল বানান পরিলক্ষিত হচ্ছে যা বিজ্ঞমহলে রীতিমতো সমালোচনা ঝড় উঠছে।
ভাষা বিকৃতি করা ইসলাম সমর্থন করে না। কারণ, আহলে কিতাবিগণ বিকৃত উচ্চারণ ও মুখ বাঁকিয়ে গ্রন্থপাঠ করে ভাষাগত জটিলতা সৃষ্টি করত এবং তাদের অনুসারীদের ধোঁকা দিত। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ ভাষাগত বিকৃতি পছন্দ করেননি। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন- ‘আর তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যেন তোমরা মনে করো, তারা কিতাব থেকেই পাঠ করছে অথচ তারা যা পাঠ করছে, তা আদৌ কিতাব নয় এবং তারা বলেন, এসব কথা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত অথচ এসব আয়াত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ নয়। তারা বলেন, এটি আল্লাহর কথা অথচ আল্লাহর কথা নয়; আর তারা জেনেশুনে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে।’ (সূরা আলে-ইমরান-৭৮)
অতএব, উচ্চারণ বিকৃতি তথা ভাষা বিকৃতি ইসলামে নিষিদ্ধ। এ জন্য দেখা যায়, মুসা আ: স্বীয় ভাষায় উচ্চারণ বিকৃতি থেকে রক্ষা পাওয়ার নিমিত্তে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘হে আমার রব! আমার বুক প্রশস্ত করে দাও এবং আমার কাজ আমার জন্য সহজ করে দাও আর আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও, যাতে লোকেরা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (সূরা ত্বহা: ২৫-২৮)
কাজেই ভাষার বিকৃতি পরিত্যাজ্য। তাই আসুন! ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত এ মাসে শপথ নিই, মায়ের ভাষাকে ভিনদেশী আগ্রাসনমুক্ত করার। পরিহার করি ভিনদেশী ভাষাকে ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা। রুখে দাঁড়াই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে। মাতৃভাষার বিশুদ্ধ চর্চা ও প্রয়োগে সচেষ্ট হই এবং বিশাল এ নিয়ামতের জন্য মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি। সেই সাথে যারা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে শাহাদৎ বরণ করেছেন, তাদের রূহের মাগফিরাতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক