সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের নিপীড়নের অভিযোগ উঠছে। এই ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। তবে এবারই অনেক বেশি ছাত্রীহলগুলোতে যে নিপীড়ন হয় সেটি স্পষ্ট ভাষায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তবে ছাত্রলীগও র্যাগিং এবং যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়ে সচেতন করা। তবে ছাত্রলীগের এই ধরনের কর্মসূচির মধ্যেও পত্রিকায় স্থান পাচ্ছে নিপীড়নের খবর।
গত বছর প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানালেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই নির্মাণাধীন একটি মসজিদের বারান্দায় থাকেন। কারণ হলের গেস্ট রুমের নিপীড়ন তাকে এতটাই মর্মাহত করেছে যে, তিনি সেটা আর নিতে পারছিলেন না। একদিন ক্লাসের সময়সূচি নিয়ে কথা বলতে গিয়েই জানলাম কেন হলে থাকা ছেলেরা দুপুরের দিকে ক্লাস চায়। ভয়ে কেউই বলতে চাইল না প্রথমে। তার পর দু-একজন মুখ খুলল। বলল, রাতে গেস্টরুমের হাজিরা দেওয়া শেষে তাদের পাঠানো হয় বিভিন্ন জায়গায়। বিভিন্ন জায়গা থেকে ছবি তুলে আনতে বলা হয়। সারারাত তারা বাইরে থাকে। তাই সকালে ফিরে ঘুমায়। কেউ কেউ সেটাও পারে না। কারণ দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়। হলে হলে চলা গভীর রাতের মিছিলে আবার যোগ দিতে হয়। একজন প্রথম বর্ষের ছাত্রের জন্য এগুলো কতটা চাপের তা সেই অবস্থায় না পড়লে কেউই বুঝতে পারবে না। এগুলোই চলছে বহুদিন ধরে। কখনো দু-একটি ঘটনা বিস্ফোরক হিসেবে বের হয়ে যায়, তখন একটু হইচই হয়, তার পর আবার কার্যকর হয়ে ওঠে পুরনো ব্যবস্থা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছেলে শিক্ষার্থীদের হলে নিপীড়নের ঘটনায় আমরা কমবেশি অভ্যস্ত। এ নিয়ে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া এবং আলোচনা হয়েছে। তবে সেগুলো নিয়ে যে কাজের কাজ কিছুই হয়নি তার প্রমাণ পাই যখন ফুলপরীরা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।
এখন আসি মূল প্রসঙ্গে, কেন এগুলো বন্ধ হয় না বা বন্ধ করা যায় না। এখানে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ক্ষমতা চর্চার সংস্কৃতির পাশাপাশি শিক্ষকদেরও ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষকদের সঙ্গে আসলে ছাত্র সংগঠনগুলোর কী সম্পর্ক। শিক্ষকরা তাদের মতো রাজনীতি করে, কার্যত তাদের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের খুব বেশি সাম্পর্কিক লেনদেন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হয় এবং হচ্ছে। আর এসব কারণেই ক্ষমতাসীন সংগঠন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
এগুলোর ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দেউলিয়াপনা সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। কীভাবে? শিক্ষকদের অনেকেই হয়তো বলেবেন, ‘আমাদের কিছুই করার নেই বা থাকে না।’ আসলেই কী তাই? সেগুলো নিয়ে কথা যে হয় না একেবারেই তা নয়। বহুবার আলোচনায় এসেছে তোষামোদে শিক্ষকরাও। তবে তা আমলে নেওয়া হয় না। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের হলগুলোতে বেশিরভাগ কক্ষের সিটের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণেই থাকে। সেখানে নেতারা নিজেদের মতো করেই পলিটিক্যাল রুম তৈরি করেন এবং অন্যান্য বেশিরভাগ রুমের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতেই থাকে। শিক্ষকদের হাতে সিট বরাদ্দ থাকে না বলেই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা এলাকার ‘বড় ভাই’-এর পেছনে ঘোরে হলে একটুখানি জায়গা পাওয়ার আশায়। কারণ বর্তমানে যেসব শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় তাদের একটা বড় অংশ আসে অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল পরিবার থেকে। তাই হলে থাকাটা তাদের জন্য এক ধরনের বাধ্যবাধকতার মধ্যেই চলে আসে। আর শিক্ষার্থীদের এই সুযোগ কাজে লাগায় ক্ষমতাসীন সংগঠন। হলের প্রশাসনিক শিক্ষক এই প্রক্রিয়াকেই এক ধরনের অনুমোদন দেন।
মেয়েদের হলগুলোতে ততটা না হলেও ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীরাও তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে কিছু কক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। তাদের চাওয়া-পাওয়ার মতো করেই হল চালান। তাদের খুশি রাখাই্ হয়ে পড়ে হল প্রশাসনের বড় কাজগুলোর একটি।
কেন এ্ই ধরনের সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে চর্চিত হচ্ছে? প্রশাসনিক শিক্ষকরা কেন হল চালানোর দায়ত্বি ছাত্র নেতানেত্রীদের ওপর ছেড়ে দেন? ছাত্রনেতাদের তারা ভয় পান? তাদের পদচ্যুতি যেন না ঘটে সেজন্য করেন? অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানোর জন্য করেন? অপমানের ভয়ে করেন? আর এ-ও সত্যি যে, যারা নিজ থেকে বা বাধ্য হয়ে ক্ষমতাসীন সংগঠন করেন তারাও শিক্ষকদের কথা শুনতে চান না, তারা ছাত্রনেতাদের মানেন এবং তাদের কথামতো চলেন। কারণ তারাও জেনে গেছেন এই সমাজ-রাষ্ট্রে কে বেশি ক্ষমতাবান?
এর বাইরের চিত্রও আছে। অনেক শিক্ষকই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট পেতে কিংবা সরকারের বিভিন্ন কমিটিতে যাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীদের খুশি রাখেন। কেন একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থী নেতাকে খুশি রাখতে আপনি আপনি করে; জি ভাই, জি, ভাই’ বলে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয় (এমন নয় যে, তিনি সব শিক্ষার্থীকে আপনি করে সম্বোধন করেন. এমনকি জুনিয়র সহকর্মীকেও আপনি বলেন না)? অনেক উপাচার্য ছাত্রনেতাদের জন্য অনুষ্ঠানে আধা ঘণ্টা-এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। কেউ কেউ আরেকটু তোষামুদে, ছাত্রনেতাকে ‘স্যার’ ডাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপাচার্যের পাশে ছাত্র নেতানেত্রীরা বসে থাকেন। অনেক শিক্ষকই বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কোনো কোনো শিক্ষক নিজে বসার আসন ছেড়ে দিয়ে ছাত্রনেতাকে বসতে অনুরোধ জানান। অনেকেই আবার নিজেরাই ছাত্র নেতানেত্রীদের ডেকে নিয়ে আসেন অন্য পক্ষকে শাসাতে। এসবই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্র। আর এভাবেই আমরা সবার জন্য সমসুযোগ দেওয়ার পরিবর্তে কিছু নেতানেত্রীর সেবক হিসেবে নিজেদের হাজির করার মধ্য দিয়ে আমাদের করণীয় কাজের পরিবর্তে এক তোষামুদে চাটুকারে পরিণত করি। কারণ আমরা জেনে গেছি এখন এটাই পদ-পদবি পাওয়ার সংস্কৃতি।
প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম, গেস্টরুম যেমন রয়েছে, তেমনি আছে পলিটিক্যাল রুম বা রাজনৈতিক রুম। ছাত্র রাজনীতি নিয়ে এক যুগ ধরে বহু কথা হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ রাখার পক্ষে অনেকেই মত দিয়েছেন। কিন্তু তার পরও আমরা বিশ্বাস করতে চাই ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য থাকুক। কিন্তু যখন এটি অধিকার রক্ষার চেয়ে কেড়ে নেওয়ার পক্ষে কাজ করে তখন ছাত্র রাজনীতি নয়; বরং ক্ষমতা চর্চার প্রক্রিয়া এবং তার সঙ্গে জড়িতদের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
কেন আবাসিক হলগুলোতে সিট সংকট হয়? প্রতিবছর প্রশাসন থেকে চিঠি দেওয়া হয় অবৈধ এবং ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের হল ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কারা হল ছাড়ে আর ছাড়ে না সেগুলো আমরা জানি। আর ক্ষমতাসীন সংগঠনের শিক্ষার্থীরা হল ছাড়ে না বলেই হলে আসন সংকট দেখা দেয়। পলিটিক্যাল রুম নামে হলগুলোতে যেসব রুম আছে সেখানেই মূলত এই নেতানেত্রীরা বছরের পর বছর থাকেন এবং কোনো কোনো হলে তারা বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকেন। ফলে ‘সাধারণ’ শিক্ষার্থীরা আসন সমস্যায় ভোগেন এবং নেতানেত্রীদের শরণাপন্ন হন একটু মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য। কীভাবে আবাসিক হলগুলোতে পলিটিক্যাল রুম নামে কিছু রুম থাকে? কেন আমরা সেই রুমগুলোকে সমীহ করি? সেই রুমগুলোতে কী হয়? কেন সেগুলো নিয়ে কথা বলতে আমরা সাহস বা স্বাচ্ছন্দ্য কোনোটিই বোধ করি না? আমরা কীভাবে যুগের পর যুগ এই্ ‘পলিটিক্যাল রুম’ থাকার অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছি?
জোবাইদা নাসরীন : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়