ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, বাংলা ভাষা তিন ভাগে বিভক্ত : প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০ খ্রি.), মধ্যযুগ (১২০১-১৮০০) ও আধুনিক যুগ (১৮০০-বর্তমান)। প্রাচীন যুগে ৪৭টি চর্যাপদ বা বৌদ্ধধর্মীয় গীতিকবিতা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। ফলে বাংলা ভাষার প্রধানত দুই যুগ। মধ্যযুগে বিকাশ, আধুনিক যুগে সমৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ।
মধ্যযুগ একচেটিয়া মুসলমানদের
মধ্যযুগে মুসলমান শাসক ও অমাত্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক নবজাগরণের সূচনা হয়। তাঁদের বদান্যতায় হিন্দু-মুসলমান উভয় কবিরা সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। তবে একমাত্র মুসলমান কবিরাই অতিপ্রাকৃতের বেড়াজাল ছিন্ন করে মধ্যযুগের সাহিত্যে মানবীয় কাহিনি সন্নিবেশ করেন। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের মর্যাদা লাভ করে।
দ্বাদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ। এ সময়ের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমে বাংলা মুসলিম সুলতানদের অধীনে চলে আসে। ফলে প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসা বাংলা সাহিত্যে ব্রাহ্মণ্যবাদের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হয়। মুসলিমদের সংস্পর্শে এসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এক নতুন রূপ এবং আঙ্গিক গ্রহণে প্রস্তুত হয়ে ওঠে। উদারপন্থী মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার বিষয়টি সমাজের সর্বস্তরের অধিকারে চলে আসে। তৈরি হয় নতুন চেতনার সমাজ ও সাহিত্যের জগৎ নির্মাণের কাজ।
বাংলা ভাষার ১২০১ থেকে ১৩৫০ সনের যুগকে ড. হুমায়ুন আজাদ ও সৌমিত্র শেখর ‘অন্ধকার যুগ’ বলেছেন। সম্ভবত ধারণা ইসলামবিদ্বেষ থেকে এসেছে। তাঁদের দাবি, এ সময়ের কোনো রচনা পাওয়া যায় না। প্রশ্ন হলো, রচনা পাওয়া না যাওয়া রচনা না থাকার দলিল হতে পারে না। ড. আজাদ তাঁর লাল-নীল দীপাবলি বা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিষয়টি এনেছেন।
বখতিয়ার খিলজির বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা
ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জানা যায়, ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেন। তাঁর আগে এ অঞ্চলে বাংলা রাষ্ট্রভাষা ছিল না।
দেখুন : The Rise of Islam and The Bengal Frontire, রিচার্ড এম ইটনের পিএইচডি অভিসন্দর্ভ।
বাংলায় : ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ, হাসান শরীফ অনূদিত, ইফা. জুন ২০০৮।
রামায়ণ ও মহাভারত অনুবাদ করেছেন মুসলমানরা
সুলতান হোসেন শাহের সেনাপতি ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্তা লস্কর পরালগ খানের পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর ‘মহাভারত’-এর বেশির ভাগ অনুবাদ করেন। পরে পরালগ খানের ছেলে ছুটি খানের আদেশে সভা কবি শ্রীকর নন্দী ‘মহাভারত’-এর বাকি অংশ অনুবাদ করেন। (দীনেশ চন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৮২)
এর আগে কবি কৃত্তিবাস গৌড়ের একজন মুসলিম শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘রামায়ণ’ কাব্যের বাংলা অনুবাদ করেন। এর আগে ব্রাহ্মণরা সাধারণ হিন্দুদের রৌরব নরকের ভয় দেখিয়ে ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ থেকে বিরত রাখত। (মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুম, ব্রিটিশ আমলে বাংলার মুসলিম শিক্ষা সমস্যা ও প্রসার, বাংলা একাডেমি, ২০০৮, পৃষ্ঠা-১৮)
বাংলা নামটি মুসলমানদের দেওয়া
বাংলা একাডেমির অভিধান মতে, বাংলা শব্দটির ফারসি রূপ হলো বঙ্গালাহ্। বখতিয়ার খিলজি বাংলা বিজয়ের সময় ‘বাঙ্গালা’ নামে কোনো দেশ ছিল না। ইতিহাসবিদ মিনহাজ-ই সিরাজ কোথাও ‘বাঙ্গালা’ নামের ব্যবহার করেননি। মিনহাজ-পরবর্তী ইতিহাসবিদ জিয়া উদ্দীন বারনী সর্বপ্রথম ‘বাঙলা’ শব্দ ব্যবহার করেন। পরে ইতিহাসবিদ শামসে সিরাজ সুলতান ইলিয়াস শাহকে ‘শাহে বাঙলা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
তাই বলা হয়, ‘বাঙ্গালা’ নামের প্রচলন ইলিয়াস শাহের আমল থেকে হয়েছে। (বাংলাদেশের ইতিহাস, ড. আব্দুর রহিম, আব্দুল মমিন, এ বি এম মাহমুদ ও ড. সিরাজুল ইসলাম, নওরোজ কিতাবিস্তান, নভেম্বর ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ১৯-২০)
এই ইতিহাসের আলোকে জানা যায়, বাংলা শব্দটি মুসলমানদের দেওয়া।
ঐতিহ্য ছিনতাই!
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে নতুন ধারার সংস্কৃতিসম বাংলা প্রবর্তন করা হয়। সর্বপ্রথম শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাইবেল অনুবাদ করা হয়। উইলিয়াম কেরিসহ আটজন হিন্দু পণ্ডিত নিয়ে আরবি-ফারসিমুক্ত বাংলা চালু করা হয়। (বাংলাপিডিয়া)
আর বাংলা ভাষা সংস্কৃতি থেকে আসার দাবি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান তাঁর বাংলা ভাষার ইতিহাস গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ড. শহীদুল্লাহসহ বহু মনীষী এ মত খণ্ডন করেছেন।
পাঁচ থেকে সাত শ বছর ধরে একটানা মুসলিম শাসনামলে আরবি-ফারসি সমন্বয়ে মিশ্র প্রক্রিয়ায় সহজভাবে ভাব প্রকাশের জন্য বঙ্গদেশে একটি ভাষার উদ্ভব হয়েছিল, সেটাকে বলা হতো চলতি ভাষা। অনেকে বলত মুসলমানি ভাষা। এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন : ‘আজ পর্যন্ত বদ্বীপ অঞ্চলের কৃষক মুসলমান। নিম্নবঙ্গে ইসলাম এতটাই বদ্ধমূল যে এটি এক নিজস্ব ধর্মীয় সাহিত্য ও লৌকিক উপভাষার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। হিরাতের ফারসি ভাষা থেকে ভারতের উর্দু যতখানি পৃথক, ‘মুসলমানি বাংলা’ নামে পরিচিত উপভাষাটি উর্দু থেকে ততখানি পৃথক।’ (W. W Hunter-Indian Musoleman’s, P-146.)
এই ভাষার পরিচয় যে যেভাবেই উপস্থাপন করুক না কেন, এটা ছিল হিন্দু-মুসলিম-নির্বিশেষে এ দেশের সব মানুষের মুখের ভাষা। তা সত্ত্বেও গোঁড়া হিন্দু পণ্ডিতরা এই ভাষাকে অবজ্ঞা-অবহেলার চোখে দেখতেন। এর কারণ সম্ভবত এ ভাষাতে ছিল আরবি-ফারসি উর্দু শব্দগুলোর মিশ্রণ। তা ছাড়া এর মধ্যে ছিল মুসলিম সংস্কৃতির স্বাচ্ছন্দ্য প্রবেশাধিকার।
শতাব্দীর পর শতাব্দী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে এর বিরুদ্ধে হিন্দু পণ্ডিতরা সক্রিয় অবস্থান নিতে পারেননি। মুসলিম শাসকদের ঔদার্যের কারণে তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুদের অনেক ধর্মীয় গ্রন্থও অনুবাদ করা হয়। কিন্তু এসব গ্রন্থ সাধারণ হিন্দুদের পাঠের ব্যাপারে হিন্দু পণ্ডিতরা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখেন। তাঁরা বলেন, অষ্টাদশ হিন্দু পুরাণ রামচরিত যে মানব পড়বে, তার ব্যবস্থা হবে রৌরব নরকে। তাদের এই নিষেধাজ্ঞা পুরো হিন্দু সমাজকে চলতি বাংলা ভাষা চর্চার ব্যাপারে অনীহাপ্রবণ করে তোলে। ভাষা চর্চার ব্যাপারে তারা সংস্কৃত আশ্রিত হয়ে ওঠে।
ওদিকে খ্রিস্টান মিশনারিরা হিন্দুদের ওপর প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে তাদের উপযোগী সাহিত্য সৃষ্টির জন্য সংস্কৃত ভাষাকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করে। তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়। একদিকে তারা ভাষাকে আরবি-ফারসির ছোঁয়া থেকে রক্ষা করে। অন্যদিকে হিন্দুদের কাছে সেটাকে গ্রহণযোগ্য করে। এ উদ্দেশ্যে নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড (Halhed) ১৭৭৮ সালে A Grammar of the Bengali Literature নামে বাংলা ব্যাকরণ প্রণয়ন করেন। শ্রীরামপুর প্রেস থেকে তা প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল প্রথম বই, যাতে প্রথম বাংলা অক্ষর ব্যবহৃত হয়। এরপর শুরু হয় এর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়ামে বাংলা বিভাগ খোলা হয়। উইলিয়াম কেরি ছিলেন এর অধ্যক্ষ। ভাষা সংস্কারের জন্য তাঁর অধীনে আটজন পণ্ডিত নিযুক্ত হন। সংস্কৃত স্টাইলের বাংলা ভাষায় মুসলমান বিবর্জিত বিষয়বস্তু নিয়ে পুস্তক প্রকাশ শুরু হয়। গবেষক আবদুল মওদুদ লিখেছেন : ‘এই মিশ্রনীতির বাংলা ভাষায় সাহিত্য গড়ে উঠার মুখেই বণিকের তুলাদণ্ড হলো রাজদণ্ডে রূপান্তরিত এবং বণিকের তল্পীবাহক মিশনারিরাও দিলেন সাহিত্যের ভাষার মোড় পরিবর্তন করে।… পাশ্চাত্যের শিক্ষার প্রবর্তকরা বাংলা ভাষার কাঠামোকেও নতুন ছাঁচে তৈরি করে দিলেন। আর এটিও হয়েছে সুপরিকল্পিত সাধনায়। হিন্দু পণ্ডিতরা এতে উল্লসিত হলেন। তার দরুন সংস্কৃত ভাষা ও কৃষ্টির নব প্রবর্তনের সম্ভাবনায় এবং মিশনারিকুল তৎপর হয়েছিল মুসলমানদের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তাকে সাহিত্য ও কালচারের দিক দিয়েও নিঃস্ব করে দিতে।’ (আব্দুল মওদুদ, মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ, পৃষ্ঠা-৩৮৫)
মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার এই বিস্মৃত ইতিহাস পুনঃপাঠ জরুরি।