শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩১ পূর্বাহ্ন

খাদ্যনালীর সুস্থতার মহা ওষুধ

ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৩
  • ৯৪ বার

বর্তমান স্বাস্থ্য বিজ্ঞান গত দশক ধরে তিনটি বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। বিষয় তিনটি হলো- ফাস্টিংয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন, শরীরকে ফ্রি রেডিক্যাল ইনজুরির হাত থেকে সম্ভব রক্ষা করা যাতে মানুষ খুব সহজে বুড়ো না হয়ে বরং এর কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগবালাই থেকে বেঁচে থাকে এবং অটোফেজির গতি বাড়ানোর মাধ্যমে স্বাস্থ্যের উন্নয়ন। এক সময় পাশ্চাত্য বিশ্ব মুসলমানদের না খেয়ে রোজা থাকাকে অনর্থক শরীরকে কষ্ট দেয়ার শামিল মনে করে বিদ্রূপ করত। আর এখন গত এক দশকে শুধু রোজার মতো ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং নিয়ে ইন্টেস্টাইনের উপকারিতা নিয়েই গবেষণাপত্র বেরিয়েছে দেড় লক্ষাধিক। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে আমরা খাবার খাই। আর এই খাবারকে হজম করে খাদ্যনালী। সেই হজমকৃত খাবার শক্তিতে রূপান্তর ঘটে চলার পথের শক্তি জোগায়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু খাদ্য হজম করাই খাদ্যনালীর একমাত্র কাজ নয়; বরং পুরো খাদ্যনালীর সাবমিউকাস লেয়ারে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য লিম্ফোটক ফলিকল যাদের মূল কাজের সময় মানুষ যখন বিশ্রামে বা ঘুমে থাকে; আর মিউকাস মেমব্রেনে যে কোটি কোটি গ্ল্যান্ড ও কোষ থাকে, মূলত সেগুলো সক্রিয় হয় খাবার গ্রহণ করার পরপরই।

অবস্থাটি এমনই যে, আমরা খাবার গ্রহণ করার পরপরই খাবার হজম করার জন্য প্রচুর শক্তির দরকার হয়। শক্তি প্রোডাকশনের প্রয়োজনে অন্য সব জায়গায় রক্ত সাপ্লাই কমিয়ে দিয়ে খাদ্যনালীতে বাড়িয়ে দেয় শরীর। এমনকি অধিক পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করলে ব্রেইনেও রক্ত সাপ্লাই খানিকটা কমিয়ে খাদ্যনালীর চাহিদা শরীর পূরণ করার চেষ্টা করে। এ জন্যই বেশি খাবার গ্রহণ করলে খাবার গ্রহণের কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝিমুনি বা তন্দ্রা চলে আসে, কারণ ব্রেইনে সাপ্লাই কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে শরীর।

রোজা থাকার কারণে প্রয়োজন হয় না বলে ১৪-১৬ ঘণ্টা কোষগুলো অনেকটা বিশ্রামে থাকে এবং খাদ্যনালীতে তেমন কোনো রস নিঃসৃত হয় না। এই সময়ে এখানকার কোষগুলোর মূল কাজ হলো গারবেজ পরিষ্কার করা, অ্যান্টিবডি তৈরি করা এবং এনার্জি সঞ্চয় করে রাখা। রোজা থাকার কারণে খাদ্যনালী এই অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত এক মাস রোজায় খাদ্যনালীর কোষসমূহ ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে যায়।

রোজা তথা ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং মূলত স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে কোষ পরিষ্কার করার ব্যায়াম যা ক্রমবর্ধমান সংখ্যক বিস্তৃত গবেষণা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেল্যুলার স্তরে রিজেনারেশন শুরু হলে এটি সমস্ত টিস্যু এবং অঙ্গ সিস্টেমকে প্রভাবিত করতে থাকে। ১২-১৬ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে উপবাস করলে অটোফ্যাজি ঘটে। অন্ত্রের মাইক্রোঅর্গানিজম অন্ত্রের টিস্যুতে বেশ কিছু উপকারী প্রভাব রয়েছে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।

ল্যাকনোস্পাইরেছি নামক খাদ্যনালীর জীবাণু একটি শর্টচেইন ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি করে যার নাম বিউটাইরেট, যা অন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়; যেমন বিউটাইরেট ইমিউন সিস্টেমে প্রদাহ-বিরোধী সঙ্কেত পাঠায়, যা ব্যথা এবং অন্ত্রের কর্মহীনতার অন্যান্য উপসর্গ কমাতে সাহায্য করতে পারে। বিউটাইরেট এ ছাড়াও অন্ত্রের ইমিউন ফাংশন উন্নত করে। আপনারা জেনে আশ্চর্যই হবেন যে, আমরা খাদ্য গ্রহণ করে শুধু একাই বেঁচে আছি, তাই নয়। খাবার খাওয়া না খাওয়াতে আমাদের যেমন সুবিধা-অসুবিধা হয় তেমনি খাদ্যনালীতে বসবাস করা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মাইক্রোঅর্গানিজমের জীবনেও ঘটে পরিবর্তন। শরীরের বিভিন্ন জায়গা যেমন, ত্বক, রেসপিরেটরি ট্রাক্ট এবং খাদ্যনালীতে সিমবায়োসিস প্রক্রিয়ায় বসবাস করছে শরীরের কোষ সংখ্যার দশগুণ বেশি মাইক্রোঅর্গানিজম। তবে ল্যারিনক্স, ট্রাকিয়া, ব্রঙ্কাই, ব্রঙ্কিউলস, ফুসফুস, খাদ্যনালীর ইসোফেগাস, পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্তের বেশির ভাগ অংশ, লিভার, পিত্তথলি, পেরিটোনিয়াম, মস্তিস্ক, রক্ত, রক্তনালী, হার্ট ও জয়েন্টসমূহ ইত্যাদি জায়গায় সাধারণ সুস্থ অবস্থায় কোনো মাইক্রোঅর্গানিজম বসবাস করতে পারে না। তারপরও একজন পূর্ণ বয়ষ্ক মানুষের ওজন গড়ে ৬০-৭০ কেজি অথচ সংখ্যায় অনেকগুণ বেশি মাইক্রো অর্গানিজমগুলোর মোট ওজন গড়ে মাত্র সাড়ে সাত গ্রামের মতো। এই মাইক্রো অর্গানিজমগুলোর বেশির ভাগই আমাদের কাজে লাগে। উপবাসকালীন সময়ে আমরা যেমন স্বাস্থ্যগত সুবিধা পাই, খাদ্যনালীতে বসবাসরত জীবাণুগুলোও চাপে পড়ে অনেক সুবিধা দেয় যেটি ভরা পেটে দিতে পারে না।

প্রথমে, আসুন, কেন একটি সুস্থ অন্ত্রের জন্য জীবাণুগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ সে সম্পর্কে কথা বলি। যখন আপনার অন্ত্রের জীবাণুুগুলো খাদ্যের ফাইবার হজম করে, তখন তারা এমন যৌগ তৈরি করে যা গবেষকরা খাদ্যনালীর কাজ এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। আপনার অন্ত্রের জীবাণুগুলো এমনকি আপনার আবেগ ও জ্ঞানকে প্রভাবিত করে, মস্তিষ্ক এবং পাচনতন্ত্রের মধ্যে সঙ্কেত পাঠায়।

লস অ্যাঞ্জেলেসের সিডারস সিনাইয়ের এফ উইডজাজা ফাউন্ডেশন ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল অ্যান্ড ইমিউনোবায়োলজি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মাইক্রোবায়োমা গবেষণার পরিচালক সুজান দেবকোটা, পিএইচডি, বলেন, ‘আমরা সত্যিই তাদের ওপর নির্ভর করি এবং তাদের প্রয়োজন। তারা আমাদের জন্য একটি মৌলিক পুষ্টির ভূমিকা পালন করে।’

তিনি বলেন, ‘আপনার জীবাণুকে সঠিক জিনিস খাওয়ান, ভারসম বজায় থাকবে, আপনাকে প্রধান স্বাস্থ্য সুবিধা দেবে। যখন অন্ত্রে জীবাণুরা সুস্থ ও ভারসাম্য থাকে, তখন এটি অনেক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী রোগ থেকে রক্ষা করে যার মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, হাঁপানি, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, বিরক্তিকর পেটের সমস্যা, মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা।

শুধু কি তাই, উপবাসের সময় ল্যাচনোস্পাইরাসি নামক অ্যানেরোবিক ব্যাকটেরিয়ার একটি বিশেষ পরিবার বিকাশ লাভ করে। এই গ্রুপের ব্যাকটেরিয়া, ক্লোস্ট্রিডিয়ালস পরিবারের অংশ, অন্ত্রে বুট্রিওজেনেসিস নামক একটি প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী, যার উপকারী বিপাকীয় এবং বার্ধক্য বিরোধী প্রভাব রয়েছে (১)।

এই জীবাণুগুলোও শরীর যখন ফাস্টিংয়ে এবং বিশ্রামে থাকে তখন রিপেয়ার-রিজেনারেশনের কাজটি করে।
মানুষের ইনটেস্টাইনে বসবাস করে যাদের প্রজাতির সংখ্যা ৩০০ থেকে এক হাজার এবং মোট সংখ্যা ১০০ ট্রিলিয়নের চেয়েও বেশি। এদের মধ্যকার ৯৯ শতাংশ ব্যাকটেরিয়া হলো মাত্র ৩০-৪০ প্রজাতির। ৯৯ শতাংশ ব্যাকটেরিয়া আবার অক্সিজেন ছাড়াই বাঁচতে পারে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মানুষের যত সংখ্যক জিন তার চেয়েও শতগুণ বেশি জিনের সমন্বয়ে তৈরি এ মাইক্রো অর্গানিজমগুলো। খাদ্য হজমের পর যে মল তৈরি হয় এবং পায়খানার সাথে বের হয়, সেখানেও শুকনা মলের ৬০ শতাংশ থাকে এই মাইক্রো অর্গানিজম। ইনটেস্টাইনে এদের কাজ হলো কলোনাইজেশন, অন্য ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে না দেয়া, ইনটেস্টিনাল এপিথেলিয়ামের ইন্টেগ্রিটি রক্ষা করা, খাবারের সাথে প্রবেশ করা ডায়েটারি ফাইবারগুলোর মেটাবোলাইজ করা এবং অ্যান্টিবডি প্রোডাকশন রেগুলেট করে ইমিউন ফাংশন কন্ট্রোল করা। এই সমস্ত ব্যাকটেরিয়া ডায়েটারি ফাইবারকে ব্যবহার করে শর্ট চেইন ফ্যাটি এসিড যেমন অ্যাসেটিক এসিড, প্রপিওনিক এসিড ও বিউটাইরিক এসিড তৈরি করে যা আমরা কাজে লাগাই। এদের সহযোগিতা ছাড়া কিছু কিছু স্টার্চ, ওলিগোসেকারাইড ডাইজেস্ট হতে পারে না। এ ছাড়াও এরা ভিটামিন বি-১২, বায়োটিন, ফলিক এসিড, ভিটামিন কে ইত্যাদি তৈরি করে। মানুষের শরীর কিন্তু প্রয়োজনীয় ভিটামিন কে এবং বি-১২ তৈরি করতে পারে না। অথচ এগুলোর একটি অংশ তৈরি করে দেয় এই মাইক্রো অর্গানিজমগুলো। শুধু তাই নয়, ইনটেস্টাইনের এই মাইক্রো অর্গানিজমগুলো প্রো-বায়োটিক হিসেবেও কাজ করে। প্রোবায়োটিক গুণের অধিকারী মাইক্রো অর্গানিজমগুলো অন্য প্রি-বায়োটিক (ডায়েটারি ফাইবার) এবং সিনবায়োটিকের (ফুড ইনগ্রেডিয়েন্ট) সাথে পরস্পর হাত ধরাধরি করে কাজ করে থাকে যেন প্রকৃতিই আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে কিভাবে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করে বেঁচে থাকতে হয়।

অতিরিক্ত শর্করা ভক্ষণের ফলে ইনটেস্টিনাল ব্যাকটেরিয়া ফারমেন্ট করে বদ হজম করে আর কম শর্করা ভক্ষণে ভালো হজম করে। আবার এই মাইক্রোঅর্গানিজমগুলোর কোনো কোনো প্রজাতির সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে ইনফ্লামেটরি বাউয়েল ডিজিজ বা আইবিডি রোগের উৎপত্তি হতে পারে। এদের ভুল হ্যান্ডলিংয়ের কারণে মানুষ স্থূলকায় এবং কলনিক ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। রোজা রাখার ফলে ইন্টেস্টাইন যখন কোনো ধরনের খাদ্য গ্রহণ না করার কারণে অনেকটা বিশ্রামে থাকে তখন উপকারী ইনটেস্টিনাল ব্যাকটেরিয়ার মোট সংখ্যা এবং এদের বিভিন্ন প্রজাতির সংখ্যাও বেড়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। সারা দিন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকার কারণে আমাদের শরীরের কোষগুলো দিনের বেলা বা কর্মকাণ্ডের সময় প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দেয়। এই সমস্ত কাজ করতে গিয়ে যে সেল ড্যামেজ বা ইনজুরি হয় তা প্রয়োজনে মেরামত, ব্যবহার বা রিজেনারেট করতে হয়। আবার অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর অংশ খেয়ে ফেলা বা বের করে দেয়ার কাজটিও করতে হয়। এই রিজেনারেশন ও রিপেয়ারের কাজটির বেশির ভাগ কাজ বিশ্রামের সময়ই হয় বেশি। এ জন্যই আমরা দেখতে পাই, অপারেশনের পরে কিংবা মানুষ অসুস্থ হলে চিকিৎসাকালীন সময়ে বিশ্রামে থাকতে বলা হয়। গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল ট্রাক্ট বা খাদ্যনালী পূর্ণ ১২-১৬ ঘণ্টা কোষগুলো রোজায় খাবার না পেয়ে এক ধরনের বিশ্রাম পায়। এই বিশ্রামকালে রিপেয়ার-রিজেনারেশনের কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করে। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে সাহরি, ইফতার, তারাবির নামাজ ইত্যাদি সম্পন্ন করার কারণে শরীরের বায়োলজিক্যাল ক্লক নতুন করে সেটআপ হয়। এই নতুন সেটআপ মতোই চলে রোজার ৩০ দিন।

আমাদের খাদ্যনালীর লাইনিং এপিথেলিয়ামের ঠিক নিচে শরীরের সবচেয়ে বেশি ইমিউন সেল থাকে যাদেরকে ‘গাট অ্যাসোসিয়েটেড লিম্ফয়েড টিস্যু’ বা ‘গাল্ট’ বলে। এরা মূলত চারটি মৌলিক কাজ করে থাকে। প্রথমত, বাইরের রোগজীবাণু থেকে রক্ষা করা; দ্বিতীয়ত, এ জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি করা; তৃতীয়ত, ইনটেস্টাইনে বসবাসরত কোটি কোটি জীবাণুর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ এবং চতুর্থত, সব ধরনের অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা করা।

যেহেতু সমস্ত রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত কাজ শরীরের বিশ্রামকালীন সময়ে বেশি ঘটে থাকে, সেহেতু রোজায় খাদ্যনালীর অপেক্ষাকৃত বিশ্রাম থাকাকালে উপরোক্ত চারটি কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করে।

লেখক : ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলাজ, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com