ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অপকর্ম করলে তাদেরও ধরা হচ্ছে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি করা হচ্ছে। এমন কিছু দৃষ্টান্ত দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল সাম্প্রতিক সময়ে। ক্যাসিনো কাণ্ডে এই দলীয় লোকেদের বেআইনি কার্যক্রমের নানা কেচ্ছা-কাহিনী প্রকাশ পেয়েছে। বস্তা বস্তা টাকার ইতিবৃত্ত মিডিয়ার মাধ্যমে জাতির সামনে উঠে এসেছে। পাপিয়া কাণ্ডে দলীয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপিসহ নেতাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের দুই নেতার বাড়ি থেকে ১৫ বস্তা এক হাজার টাকার নোট উদ্ধার করা হয়েছে, যার মূল্য মান ২৬ কোটি ৫৫ লাখ। পাওয়া গেছে এক কেজি স্বর্ণ ও ৯ হাজার ইউএস ডলার। তারা দুইজন সহোদর। ২০০০ সালের পর থেকে গত ২০ বছরে ১৫৬টি ফ্ল্যাট ও ২২টি বাড়ির মালিক হয়েছেন তারা। আর ঢাকায় তাদের আছে ছোট বড় ৭০টি জমি। এইসব খবর নানা কারণে প্রকাশ করে এবং দু-চারজনকে গ্রেফতার করে ধারণা দেয়া হচ্ছে, বর্তমান সরকার ‘সব রকম স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে উঠে’ আইন প্রয়োগ করছে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের সব স্তরের নেতাকর্মী বা সমর্থকরাই দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা ইত্যাদি উপায়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ নয় শুধু, বটগাছ হয়েছেন এবং হচ্ছেন। এদের সংখ্যা হবে লাখ লাখ। এর মধ্যে মাত্র হাতে গোনা ক’জনকে ধরা হচ্ছে। এতে করে অপরাধীদের বৃহত্তর অংশই ‘নিরাপদ’ থাকবে।
অপরাধী হলেই যে তার বিরুদ্ধে এ দেশে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায় না, তারই একটি ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত দেখা গেল গত মঙ্গলবার পিরোজপুরের আদালতে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি এ কে এম এ আউয়াল ও তার স্ত্রী জেলা মহিলা লীগের সভানেত্রী লায়লা পারভীন দুদকের দুর্নীতি মামলার আসামি। সে মামলায় তাকে জামিন না দিয়ে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান। এই অপরাধে তাৎক্ষণিকভাবে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি এবং বদলির আদেশ পেয়েছেন তিনি। আইন মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ গতিতে তাকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ, অন্যত্র বদলি এবং আরেকজনকে দায়িত্বে বহাল করার কাজগুলো সম্পন্ন করেছে। এরপর ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আসামিদের জামিন দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তারা ওই বিচারক মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগসংবলিত ফাইল স্বল্পতম সময়ে চালাচালি করে, উচ্চ আদালতের অনুমোদন সংগ্রহ করেছেন এবং তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
এর আগে, আদালত জামিন নামঞ্জুর করার পর আউয়াল ও লায়লার অনুসারীরা আদালত প্রাঙ্গণ ও শহরে তাণ্ডব সৃষ্টি করেন বলে জানিয়েছে জাতীয় সংবাদপত্রগুলো। তারা পিরোজপুর শহর থেকে সার্কিট হাউজ পর্যন্ত রাস্তার কয়েক জায়গায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ও আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন। পাড়েরহাট সড়ক অবরোধ করা হয়। জোর করে দোকানপাট বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে ব্যবসায়ীদের। এমনকি বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবিসংবলিত বিলবোর্ডগুলোও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।
এরপরই মন্ত্রণালয় সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে পরিস্থিতি অনুকূলে নিয়ে আসে। ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজকে দিয়ে শুনানি করে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে ওই নেতার জামিনের আদেশ বের করে আনা হয়।
এসব ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এক বিবৃতিতে আসক বলেছে, সড়ক অবরোধের এ ঘটনার মধ্য দিয়ে জনসাধারণের প্রতি এমন বার্তা দেয়া হলো যা থেকে মনে হতে পারে, বর্তমান কিংবা সাবেক একজন আইনপ্রণেতা প্রচলিত বিচারিক কার্যক্রমের ঊর্ধ্বে। আমরা মনে করি, এ ধরনের আচরণ বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার শামিল।
আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের সামর্থ্যরে প্রশংসা করি। তবে এ পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ নিঃসন্দেহে। আশা করি, এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বিচার বিভাগ যথাশিগগিরই কাক্সিক্ষত রায় ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ হবে।