বাংলাদেশে অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ সব পক্ষ অনুভব করছে। ২০১৪ সালের একতরফা ও ২০১৮-এর নিশি নির্বাচনে অভিযুক্ত বর্তমান সরকারও কথাবার্তায় তা প্রকাশ করছে। সদ্য সফর করা মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনায়ও বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক দেশগুলোর প্রতিনিধিদের ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন, তারা একটি অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এটি কিভাবে করবেন; সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। শুধু ফাঁকাবুলি শোনানো হচ্ছে। অথচ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে প্রতিযোগী দলগুলো তাদের প্রতি কোনো আস্থা রাখে না। এ ব্যাপারে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্যের কোঠায়।
আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় ধস, মানবাধিকারের অবনতি ও গণতন্ত্রের ক্ষয় নিয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্ব উদ্বিগ্ন। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা উপর্যুপরি সফর করছেন। তারা জানতে চান, কিভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারা ফিরবে, মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত হবে। সফররত মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। বৈশ্বিক মানবাধিকার সমুন্নত রাখার অংশ হিসেবে মার্কিন উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা এই সফর করছেন। ক্ষমতাসীনদের পক্ষে বলা হচ্ছে, তারা প্রতিনিধিদলকে একটি অবাধ স্বচ্ছ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার দিয়েছেন। মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়েও আন্তরিক বার্তা দিচ্ছেন। একই প্রতিশ্রুতি দেশবাসীকেও প্রতিনিয়ত দিচ্ছে সরকার। তবে বাস্তবতার সাথে এর মিল নেই।
সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কথা প্রতারণাপূর্ণ। শুধু উপস্থিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় যেখানে যা বলা দরকার সেখানে তাই বলছেন। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসির বিশ্বাসযোগ্যতা অত্যাবশ্যক। অথচ বর্তমান ইসি সরকারের বশংবদ। এর পরেও আইন করে সরকার এর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরো জোরালো করা হয়েছে। এখনকার ইসি-কে বিরোধী দলগুলো সামান্যও বিশ্বাস করে না। এদিকে প্রশাসনের ওপর একচ্ছত্র প্রভাব খাটিয়ে সরকারের লোকজন সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করছেন। বিরোধীদের বঞ্চিত করার নীতি এখানেও বহাল রয়েছে। সেজন্য বিরোধীরা বলে যাচ্ছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবেন না। এ অবস্থায় সরকার পরিচালনায় কোনো কার্যকর পরিবর্তন না এনে দেশী-বিদেশীদের এসব ব্যাপারে আশ্বস্ত করার অর্থ কী?
দেশের মানুষের সাথে অন্যায়-অনিয়মের মাধ্যমে বিরোধীদের দমন করে ক্ষমতা ধরে রাখার যে নীতি সরকার নিয়েছে; সেটি বিদেশীদের সাথেও শঠতার সাথে করতে চান ক্ষমতাসীনরা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে গণতন্ত্র মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সমানে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এভাবে কতদিন বিদেশীদের চোখে ধুলা দেয়া যাবে। এই কৌশল ক্ষমতাসীনদের জন্য শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হতে বাধ্য। নিজ দেশের নাগরিকের সাথে অন্যায় করে পার পাওয়া গেলেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার যদি না শুধরায়, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো পদক্ষেপ নেবে না, এটি ভাবা বোকার স্বর্গে বাস করার শামিল। র্যাব ও এর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও অমর্যাদাকর ভিসানীতি চাপানো হয়েছে সরকারের এমন শঠতাপূর্ণ আচরণের কারণে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গভীর সঙ্কট চলছে। অথচ সরকারি দলের নেতাদের কথা শুনলে মনে হয়, সব ঠিক আছে। সরকারকে প্রথমে এ ব্যাপারে স্বীকৃতি দিতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার যে অঙ্গীকার বিদেশীদের কাছে করছে তার প্রমাণ দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করতে হবে। সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে বিরোধীদের কটাক্ষ করার নীতি বাদ দিতে হবে। সবার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। প্রতারণাপূর্ণ নীতি পরিবর্তন করতে হবে। তাহলে সমঝোতার পথ তৈরি হতে পারে। প্রকৃত বাস্তবতায় সমাধান দেশের ভেতর থেকে হতে হবে। সে লক্ষ্যে সরকারকে সততার সাথে অগ্রসর হতে হবে।