বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১০:১৬ পূর্বাহ্ন

ভূগোল বদলায়, বদলায় না ইতিহাস

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৪ মার্চ, ২০২০
  • ২৯৬ বার

হ্যাঁ, ভূগোল বদলায়। আমাদের জীবদ্দশায় অন্তত দুবার এই ভূখণ্ডের ভূগোল বদলাতে দেখেছি আমরা। একবার ১৯৪৭-এ, আরেকবার ১৯৭১-এ। সাতচল্লিশে ১৯০ বছর ১ মাস ২৩ দিন; অর্থাৎ প্রায় দু শ বছর রাজত্ব করার পর ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যায়। তাদের প্রস্থান ছিল ভারতবর্ষবাসীর দীর্ঘদিনের আন্দোলন দেন-দরবার জেল-জুলুমের পরিণতি। তখন তাদের পরিত্যক্ত সাম্রাজ্যের শাসনভারের দাবিদার ছিল ভারতবর্ষের প্রধান দুই জাতি—রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন হিন্দু ও দু শ বছর আগে সাগরপারের ইংরেজের হাতে কয়েক শ বছরের নিরবচ্ছিন্ন রাজত্ব খোয়ানো মুসলমান জাতি, যারা মুসলিম লীগের নেতৃত্বে একটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন করছিল। সুপার চালাক ব্রিটিশ বেনিয়ারা বানরের পিঠা ভাগের মতো ভারতবর্ষকে ভাগ করে হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতির হাতে তুলে দিয়ে যায় এই উপমহাদেশকে। জন্ম হয় পাকিস্তান নামক এক নতুন রাষ্ট্রের। আর আমরা, যারা এখন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক, তাদের ললাটলিখন নির্ধারিত হয় স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফ সাহেবের ভাগ-বাটোয়ারার পেনসিলের খোঁচায়। তিনি অবিভক্ত বাংলাকে দুই টুকরো করে হিন্দুপ্রধান পশ্চিমাংশকে রাজধানী কলকাতাসহ দিয়ে দিলেন ইন্ডিয়াকে। (শোনা যায়, ফাউ হিসেবে কিছু কিছু মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাও ইন্ডিয়ার পাতে পড়ে)। আর কোনো হিসেবেই বিপুল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বৃহত্তর সিলেট জেলা ইন্ডিয়াকে দিতে না পেরে শুধু ওই জেলাতেই ‘রেফারেন্ডাম’ বা গণভোটের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানেও নাকি ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ আশ্রয় নিয়ে গণভোটের রেজাল্ট উল্টাপাল্টা করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকাকে ইন্ডিয়ার হাতে তুলে দেয় ব্রিটিশরা।

যা হোক, এভাবে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের ভৌগোলিক অবস্থার পরিবর্তন হয়। আর আমরা, মানে বাঙালিরা এগারো শ মাইল দূরবর্তী এক পুরোপুরি মুসলিম অধ্যুষিত ভূখণ্ডের অধিবাসীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে শুরু করলাম এক নতুন জীবন, যে অধিবাসীদের সঙ্গে একমাত্র ধর্মীয় সাযুজ্য ছাড়া আর কোনো বিষয়েই আমাদের মিল ছিল না—না ভাষায়, না অশনে-বসনে, না কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে। তবু অনেক প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা শুরু হলো আমাদের। কিন্তু অতি দ্রুতই মোহভঙ্গ হলো, যখন আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৬ শতাংশ) হয়েও আমরা বঞ্চিত হচ্ছি দেশশাসন ও উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে। এমনকি দেশের ৫৬ শতাংশ লোকের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দিয়ে বাকি ৪৪ শতাংশের তথাকথিত ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা’ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হলো। তারপরের ইতিহাস বাঙালি জাতির রক্ত দিয়ে লেখা ভাষার ইতিহাস ও পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাস, যে ইতিহাসের পথ ধরে এলো ১৯৭১, যখন আমরা ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’। সেই রক্তস্নাত অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে আবারও বদলাল এই ভূখণ্ডের ভূগোল।

ভূগোল শুধু এই ভারতবর্ষে নয়, ভূগোল যুগে যুগে বদলায় সব দেশে, সব কালে। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা সবখানে ভূগোল বদলায়, কোথাও যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে অনেক রক্তপাতের পরিণতিতে, কোথাও রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলন-অভ্যুত্থানের কারণে। বিলুপ্তি হয়, অঙ্গহানি হয়, কত রাষ্ট্রের। জন্ম হয় নতুন নতুন রাষ্ট্রের। আর এত সব ডামাডোলের মধ্যে মহাকাল অলক্ষ্যে নীরবে-নিভৃতে লিখে চলেছে নব নব ইতিহাস। অনপনেয় কালিতে লেখা সে ইতিহাস কোনো কোনো মানুষ পাঠ করে না, করতে চায় না। সে তার নিজের সুবিধামতো ঘটনাবলির বিন্যাস করে, নায়ক-খলনায়ক সৃষ্টি করে। কখনো বা নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করে ইতিহাস। আবার কখনো বশংবদ লেখকদের দ্বারা লিখিয়ে নেয় ‘কাস্টম টেইলার্ড হিস্ট্রি’। এ সবই ইতিহাসের বিকৃতি, যা হয়তো কিছু মানুষকে কিছুকালের জন্য বোকা বানাতে সফল হয়; কিন্তু সেই স্বৈরাচারী চেঙ্গিস খাঁ বা হিটলারের পতনের পর মহাকালের লেখা ইতিহাস কালো পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে আবার দ্যুতি বিচ্ছুরণ করতে থাকে। আর মহাকালের লেখা সেই ইতিহাস যদি হয় শহীদের খুনে লেখা রক্তলাল ইতিহাস, তবে সেই অমেয়-অজেয় দলিল কে বদলাতে পারে? সাধ্য আছে কারো?

২.

প্রিয় পাঠক, আপনি নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন আমি এই সুখ-দুঃখের, গৌরবের মার্চ মাসের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে এসব অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ কেন তুলছি। কোথায় আমি অবিরাম আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা বয়ান করব, কোথায় নান্দীপাঠ করতে করতে ঝাঁকের কৈ ঝাঁকে মিশে যাব, কোপ মারব ঝোপ বুঝে, আর গুরুজনদের উপদেশামৃত মেনে খড় শুকাব এই রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিবসে, তা না মিছেমিছি ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে মতলব চাচা, সুবিধাবাদী মামা আর জে জে টি টি (যখন যেমন তখন তেমন) খালুদের পা মাড়াতে শুরু করেছি। এই ‘অপরাধে’ অবশ্যই আমার সাতবার ফাঁসি হওয়া উচিত। রিমান্ড ছাড়াই, রিমান্ডের নাম শুনেই ভয়ে আমি আমার অপরাধ স্বীকার করছি। তবে মহামান্য আদালত কি জানেন যে আমাকে জেলে পাঠাবার আদেশ দিয়ে কলমের কালি শুকাবার আগেই তিনি বদলি হয়ে যেতে পারেন এবং কাঠগড়া থেকে নামার আগেই আমাকে দেশপ্রেমিক নাগরিকরা আমার বৃষস্কন্ধে কয়েক টন ফুলের মালা (বেশির ভাগই কাগজের) দিয়ে কাঁধে তুলে শহরে মিছিল বের করতে পারে? যদি জানেন তবে আর কিছু না হোক নিজের আণ্ডাগণ্ডা কাচ্চাবাচ্চাদের অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ভেবে দেখবেন আমি দোষী জেনেও আমাকে শাস্তি দেবেন, না আপনিও ঝাঁকের কৈ…ইত্যাদি।

এবার আসুন মার্চ মাস এলেই আমি হঠাৎ কেন এমন দার্শনিক হয়ে যাই সে কথা একটু খুলে বলি। প্রথমেই বলে রাখি, মার্চ মাস বা একাত্তর, এমনকি বায়ান্ন সম্বন্ধে আমি বা আমার বয়েসি সবাই কোনো শোনা কথার ওপর ভর করে বয়ান দিই না। বায়ান্নতে আমি ছিলাম ক্লাস সেভেনের ছাত্র, যখন বগুড়া জিলা স্কুলের আমার পরম শ্রদ্ধেয় স্যারদের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও পরোক্ষ সম্মতি নিয়ে দিনের পর দিন ক্লাস বাদ দিয়ে আমরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ ‘…র কল্লা চাই’ ইত্যাদি নাতিশীতোষ্ণ, উষ্ণ ও অত্যুষ্ণ স্লোগান দিয়ে শহরের সাতমাথা ও প্রধান প্রধান সড়ক গরম করেছি। আর তখন দেশে টিভি জন্মলাভ করেনি, রেডিওও ছিল সারা শহরে হাতে গোনা দু-চারটা। খবরের কাগজ ঢাকা থেকে বগুড়া পৌঁছাত এক দিন পর। তাই সই। ঢাকায় কী হচ্ছে না-হচ্ছে মোটামুটি সব খবরই পেতাম আমরা। আমাদের বগুড়ার ‘ছইল’ (ছেলে) গাজীউল ভাই (মরহুম গাজীউল হক—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম সারির ছাত্রনেতা) স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে বগুড়ায় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আর একাত্তরে তো আমার বয়স তিরিশ ছুঁই ছুঁই। সে বছর জুন মাস পর্যন্ত আটকে পড়েছিলাম (পশ্চিম) পাকিস্তানের এক প্রত্যন্ত মহকুমায়—মন্ডি বাহাউদ্দিন, জেলা গুজরাত। আমি ছিলাম ওখানকার মহকুমা প্রশাসক। তারপর হঠাৎই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে বদলি হয়ে আসি কুমিল্লা। তখন জুলাই মাস থেকে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি চোখের সামনে। পাক আর্মির বর্বরতা যেমন দেখেছি, মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সাহসিকতাও প্রত্যক্ষ করেছি খুব কাছে থেকে। আমি ও আমার প্রজন্মের যাঁরা তখন বাংলাদেশে ছিলেন তাঁরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের একেকজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী, আই উইটনেস। কাজেই মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাবলি ও কীর্তিকাহিনি নিয়ে কেউ উল্টাসিধা কিছু বললে স্বভাবতই মনের ডায়েরির পাতা উল্টাতে শুরু করি।

হ্যাঁ, মার্চ একাত্তরে আমি বাংলাদেশে ছিলাম না, ছিলাম (পশ্চিম) পাকিস্তানে। আমার অন্য অনেক সিএসপি সহকর্মীও ছিলেন ওখানে। আমাদের সবার একটাই আফসোস, ওই আপৎকালীন সময়ে আমরা পরিবার-পরিজন ও দেশবাসীর কাছে ছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধেও আমরা কেউ যেতে পারিনি। তবে দেশে ফিরে যা দেখেছি যা শুনেছি, বিশেষ করে পঁচিশে মার্চের তাণ্ডবলীলা ও পরবর্তী মাসগুলোতে পাক আর্মির নির্বিচারে বাঙালি নিধন ও নারী নির্যাতন, তা এককথায় পৈশাচিক। ওই সময় বাংলাদেশ ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য। বঙ্গবন্ধুকে ২৫ তারিখেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছিল খানসেনারা। বাকি সব আওয়ামী লীগ নেতা তখন গা-ঢাকা দেন। বেশির ভাগই বোধ হয় পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। সেই শূন্য মঞ্চে তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন পাক বাহিনীর দোসর মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলাম-পছন্দ দলের নেতারা। সাধারণ মানুষের প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত প্রায়। কখন কাকে খানসেনারা ধরে নিয়ে যায়, কার বাড়িতে আগুন দেয়, মা-বোনদের ওপর নেমে আসে পৈশাচিক অত্যাচার—সারাক্ষণ এই দুশ্চিন্তাতেই তখন আচ্ছন্ন ছিল বাঙালির মন। সেই সঙ্গে ছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের উৎপাত। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও কোনো বাঙালি স্বস্তিতে ছিল না, ছিল না দুশ্চিন্তামুক্ত। আমরা যারা সরকারি চাকরি করতাম তারাও সারাক্ষণ তটস্থ থাকতাম কখন কোন ‘দোষে’ মিলিটারিদের রোষানলে পড়ি। এক কথায় মার্চ থেকে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত সবাই বেঁচে ছিলাম ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘ফ্রম মোমেন্ট টু মোমেন্ট’, এক পল থেকে আরেক পল পর্যন্ত। তবে লড়াইয়ের ময়দানে বা গেরিলাযুদ্ধে যেসব মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে, জানটা হাতে নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করেছে তাদের তুলনায় এসব কিছুই না। অসামরিক বাহিনীর এসব যোদ্ধা জীবনে কোনো দিন একটি গাদা বন্দুকও হয়তো দেখেনি। দেশ স্বাধীন যদি কেউ করে থাকে তবে এরাই। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের তাই সারা জীবন জানাই লাখ সালাম।

৩.

দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর কৃতিত্বের দাবিদার হলেন অনেকে। যোদ্ধা-অযোদ্ধা, বক্তা-সুবক্তা, কুবক্তা কেউ বাদ নেই। এটা অবশ্য স্বাভাবিক। সেই যে ইংরেজি প্রবাদ বাক্য, ‘সাকসেস্ হ্যাজ ম্যানি ফাদারস্, ফেইলিআর ইজ অ্যান অরফেন’, নিজেকে সাফল্যের বাপ বলে দাবি করেন অনেকেই, ব্যর্থতা বেচারা অনাথ—সেই রকম আর কি। আল্লাহর অসীম করুণায় একাত্তরে এক দানবীয় পরাশক্তির বিরুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছিলাম, তা না হলে পরাজয়ের দায়ভার নিতে কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। যেমন আগস্ট ’৭৫-এর মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ড  প্রতিহত করতে, ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এগিয়ে না আসার ব্যর্থতার দায়ভার কেউ নেয় না। অজ্ঞাত কারণে এ ব্যাপারে কোনো তদন্তও বোধহয় হয়নি।

আর সেদিন বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে লড়াই করেছিল কারা? শুধু কি মুসলমান? শুধু কি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান? কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীই কি শুধু শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল? এই সব প্রশ্নের উত্তর একটাই—না। একাত্তরে কেবল মুষ্টিমেয় কিছু ধর্মব্যবসায়ী, কিছু পাকির উচ্ছিষ্টপুষ্ট তাঁবেদার ব্যতীত সেই সময়ের পুরো সাড়ে সাত কোটি-পৌনে আট কোটি মানুষ ইস্পাতকঠিন ঐক্য নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল হামলাকারীদের বিরুদ্ধে। কাজেই দেশ স্বাধীন করার কৃতিত্ব পাকিদের পদলেহী স্বাধীনতাবিরোধী কতিপয় মানুষরূপী অমানুষ ব্যতীত একাত্তরের এ দেশের সকল স্বাধীনতাকামী মানুষের। তবে সর্বাগ্রে যাদের নাম উচ্চারিত হতে হবে তারা হলো ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ নির্যাতিতা মা-বোন। এখানেই এই বিতর্কের অবসান হওয়া উচিত। আর যত দিন বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে তত দিন সালাম জানাতে হবে একাত্তরের রণাঙ্গনের সকল শহীদ ও তাদের সহযোদ্ধাদের। সালাম জানাতে হবে অন্য সব শহীদদের। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে…।’

বলছিলাম একাত্তরের আমাদের জাতীয় ঐক্যের কথা, যা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি। আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি ছিলাম বলেই সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে একটি আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার পরপরই আমাদের ঐক্য গেল টুটে। আমরা বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ বাদ দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নিজ নিজ দল ও গোষ্ঠীর স্বার্থ নিয়ে। সেই সঙ্গে অতি দ্রুত নিজেদের আখের গোছানোর ধান্দায় মেতে উঠলাম।

তারপর পার হয়ে গেছে কয়েক যুগ। স্রোতহীন বুড়িগঙ্গার তলদেশে জমেছে কয়েক লক্ষ টন পাঁক, পলিথিন ও অন্যান্য অজৈব পদার্থ। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের মনের কোণে জমেছে হিংসা-লোভ-লালসা ও দুর্নীতির হিমালয় পর্বত। আমরা এখন ছলে-বলে-কৌশলে একে ল্যাং মেরে, ওকে কনুইয়ের গুঁতোয় ফেলে দিয়ে কী করে হপ-স্টেপ-অ্যান্ড জাম্প দিয়ে সবাইকে ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যাব তার সুলুকসন্ধানে ব্যস্ত কাল কাটাই। অর্থবিত্ত—তা নর্দমার ময়লা ছেনে হোক অথবা কারো গলায় ছুরি ধরে হোক—উপার্জন করে রাতারাতি বড়লোক হওয়া, সমাজে কেষ্টবিষ্টু হওয়াকে জীবনের মোক্ষ মনে করি আমরা। হায়, আমরা কী করে এত দ্রুত ভুলে গেলাম পাকিস্তানি আমলের ২৪ বছরের অবজ্ঞা-অবহেলা-বঞ্চনা, নির্যাতন-নিপীড়ন। কী করে ভুলে গেলাম রক্তঝরা একাত্তরের করুণ ইতিহাস।

৪.

আমাদের একটি সোনার ডিমপাড়া রাজহংসী উপহার দিয়েছিল একাত্তরের ত্রিশ লক্ষ শহীদ। সেই হাঁসটি তারা আমাদের জন্য কিনেছিল বুকের রক্ত দিয়ে। আর আমরা কিনা রাতারাতি বড়লোক হব বলে, সব সোনার ডিম একবারে পাব বলে, সেই রাজহংসীর পেট কেটে ফেললাম। তারপর কী পেলাম? পেলাম একটি উদ্গত সকরুণ দীর্ঘশ্বাস। আর কিছু না। মহাকাল অলক্ষ্যে সেই ইতিহাসও নিশ্চয়ই লিখে চলেছে। আমরা নয়, ভবিষ্যতের বাঙালি হয়তো একদিন সেই ইতিহাস পাঠ করে দুফোঁটা চোখের জল ফেলবে তাদের পণ্ডিতম্মন্য প্রপিতামহদের জন্য।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com