যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপকে গত ১৫ বছর এভাবে দেখার সুযোগ কারও হয়নি। চীনে হাজার হাজার মানুষের করোনায় আক্রান্ত হওয়া দেখে তাকে গুরুত্বহীন মনে করে পশ্চিমাঞ্চলের মানুষজন। সময়ের পরিক্রমায় সেসব মানুষ এখন নিজেকে আইসোলেটেড করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাঁচার প্রয়োজনে সময়ের প্রয়োজন সত্যিকার অর্থে কেউ বের হচ্ছে না ঘর থেকে। ব্রিটেনে এবং ইউরোপে বড় বড় সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, এবোলা ভাইরাসের করাল থাবা বসিয়েছে, কিন্তু কখনো মানুষকে এত আতঙ্কিত হতে দেখা যায়নি যতটা আতঙ্কিত করেছে করোনা।
চিরচেনা লন্ডনের রাতের চিত্র বা দিনের চিত্র দেখে যে কেউ এখন থমকে যাবেন। এ যেন অচেনা এক নগরী। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত নগরীর অন্যতম লন্ডনের চারদিক এখন খাঁ-খাঁ করছে। রাজপথ, হোটেল, রেস্তোরাঁ, পাব-সব শূন্য। এ যেন ঠাকুরমার ঝুলির গল্পের ভূতের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া কোনো শহর। আগে মানুষের বসবাস ছিল। এখন নিস্তব্ধ চারদিক। কোথাও জনমানুষের দেখা নেই। ভৌতিক পরিবেশ। এমন লন্ডনকে দেখে গা শিউরে উঠবে- কোথায় এসে পড়লাম। থিয়েটার জনশূন্য, পাবেরও একই দশা।
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জনসাধারণকে ঘরেই অবস্থান করার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, ১২ সপ্তাহ সামাজিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলতে। এ সময়ে ঘরে বসেই কাজ করার কথা বলেন তিনি। বরিস জনসন সব অপ্রয়োজনীয় কাজ বন্ধ রাখতে বলেন। এড়িয়ে চলতে বলেছেন অত্যাবশ্যকীয় না হলে ভ্রমণও।
গত সোমবার রাতে এমন পদক্ষেপকে ‘ড্রাকোনিয়ান’ বা কঠোর বলে স্বীকার করেছেন। তবে বলেছেন, জীবন রক্ষার জন্য এটি করতে হবে। জনকোলাহলে উপচেপড়া লন্ডনের রাজপথ এখন শুধুই হাহাকার। খুব ব্যস্ত চায়না টাউনের রাস্তা দেখে গা শিউরে ওঠে। চলার সময়ে এখানেই মানুষের গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগত। সেখানে এখন তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। একটু সামনে এগিয়ে দেখা গেল ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন দু-একজন। ওয়েস্ট এন্ডের পাবগুলো ছিল ভীষণ ব্যস্ত, সেখানে এখন বিরাজ করছে কবরের নিস্তব্ধতা। ট্রেন স্টেশন ও বাস স্টেশনগুলোর সবই ফাঁকা। হিথরো বিমানবন্দর পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমানবন্দর। সেখানে প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে একটি বিমান ওঠানামা করে। সেই বিমানবন্দর এখন অনেকটা নিস্তব্ধ। লন্ডনের ২৭০টি পাতালট্রেনের স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫ মিলিয়ন যাত্রী আসা-যাওয়া করে। বর্তমানে স্টেশনগুলো দিনে-দিনে ভুতুড়ে পরিবেশের দিকে এগোচ্ছে।
বরিস সরকার প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে করোনা ঠেকাতে। ইতোমধ্যে ৭০ বছর বয়সের ওপরের মানুষকে ঘর থেকে বের না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নতুন যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে গ্রান্ড ন্যাশনাল ও প্রিমিয়ারশিপ রাগবি ৫ সপ্তাহের জন্য স্থগিত। মিডিয়াগুলো প্রথম থেকে সচেতন করতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।
গত দুদিন আগে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তার বক্তব্যে বলেন, সবাইকে সতর্ক থাকবে, হয়তোবা আমাদের অনেক স্বজনকে হারাতে পারি। উল্লেখ্য, শনিবার পর্যন্ত ইউকেতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪০০০ জন। মারা গেছেন ১৭৮। এ পর্যন্ত তিনজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি মারা গেছেন। এই টাওয়ার হ্যামলেটসের সর্বাধিক বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হলো হোয়াইটচ্যাপেল। এখানে আছে দুটো আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন। বিস্তৃত কাঁচাবাজার, ৫টি হাইস্ট্রিট ব্যাংক, নানা ধরনের বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইউকের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইস্ট লন্ডন মসজিদ অ্যান্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার। আছে আলতাব আলী পার্ক, শহীদ মিনার এবং কত কিছু। এসব এলাকায় দিনরাত প্রবাসী বাংলাদেশিদের আনাগোনা লেগে থাকত। এখন সেসবের কিছুই নেই। সব কিছুই কেমন বদলে গেল। করোনা ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে প্রাণচঞ্চল্য। সবার মধ্যে চাপা আতঙ্ক। একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখা হলে এখন আর আগের মতো জড়িয়ে ধরে না। আন্তরিকতা দেখাতে কনুইর সঙ্গে কনুই মিলিয়ে দূরে থাকার চেষ্টা করছেন।
ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের খাবার মজুদ করতে অনেকেই ভিড় জমাচ্ছেন মার্কেটে। ব্রিটেনের সুপার স্টোরগুলোয়ও ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে পণ্য সংকটের। এদিকে করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে শুক্রবার থেকে ব্রিটেনের সব স্কুল পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুল বন্ধের পাশাপাশি আগামী মে ও জুন মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্ধারিত পরীক্ষাগুলোও স্থগিত থাকবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ২০ হাজার সেনাসদস্যকে।
লন্ডনের ৪০টি পাতালরেল স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রাতে আন্ডারগ্রাউন্ড বন্ধ থাকবে। সুপার স্টোরগুলোও ২৪ ঘণ্টার পরিবর্তে রাত ১০টা পর্যন্ত চালু রাখা হয়েছে। পাবলিক বাস-ট্রেন চালু থাকলেও তা সীমিত হয়ে আসবে। শুধু ডাক্তার, নার্স বা সেবা প্রদানকারীদের জন্য এই গণপরিবহন চালু থাকবে।